
রংবাজ
উপন্যাস ৪
আশিকুজ্জামান টুলুপ্রকাশিত : সেপ্টেম্বর ২০, ২০১৮
বনগ্রাম আর জুগিনগরের মোড়ে জাহাঙ্গীর রেডিও দোকানটায় জোরে জোরে হিন্দি গান বাজছে। সপ্তদীপা ক্লাবের রকে বসে বখাটে বাবুইল্লাদের বিশাল গ্রুপটা আড্ডায় মশগুল। মুহুর্মুহু সিগারেট আর চায়ের বন্যা বয়ে যাচ্ছে। একটা প্যানাসনিক দুই স্পিকারওয়ালা ক্যাসেট প্লেয়ারে অবিরাম বেজে চলেছে, ‘মেরে নায়না, সাওন ভাদো, ফিরভি মেরা মান পিয়াসা, ফিরভি মেরা মান পিয়াসা।’ ক্লাবের সামনের লাইটপোস্টের লাইটটা বেশ অনেকদিন ধরে ফিউজ হয়ে গিয়েছে বলে ওই জায়গাটা অন্ধকার। আর এই অন্ধকারটাই বাবুইল্লাদের সাপে বর হয়েছে বিভিন্ন কুকর্ম করার জন্য। বহুরাত পর্যন্ত ওরা আড্ডা মারে এখানে। মাঝে মাঝে রাতে মেয়ে মানুষ নিয়ে আসে ক্লাব ঘরে, রাতভর চলে আদিম উল্লাস। এটা ওদের মোটামুটি প্রতিদিনের রুটিন। কারো সাহস হয় না ওদের কিছু বলার। তবে আজ বাবুইল্লারা একটু চঞ্চল হয়ে আছে, কেমন যেন একটা অস্থিরতা! এর মধ্যে ওর এক সাগরেদ দুবার করে মোটরসাইকেল নিয়ে ক্লাবে এলো। মিনিট দশেক বাবুলের সাথে আলাপ করলো এবং চলে গেল।
আজ কিসমত রিক্সা পায়নি। হেঁটে হেঁটে আসছে রথখোলা থেকে টিপুসুলতান রোড হয়ে বনগ্রামের দিকে। টিপুসুলতান রোড থেকে ও বাঁয়ে ঢুকে যায় বনগ্রাম রোডে। ওই কোণাটা ভীষণ অন্ধকার। লোকজন সব দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে পেচ্ছাপ করে। কিসমত খানিকটা সাবধানী হয়ে হাঁটছে। আজ কেন যেন ওর ভালো ঠেকছে না, ঠিক ঠাওর করতে পারছে না যে মনের ভিতরের সঙ্কোচ বা ভয় উৎপত্তির কারণ কি। অতি সমর্পণে হেটে চলেছে ও, তড়িঘড়ি করতে চেষ্টা করছে, তবু আজ পা চলছে না। ভারী হয়ে যাচ্ছে বারবার।
ঠিক ওই সময়েই তাহেরবাগ লেন দিয়ে একটা লাল রঙের হোন্ডা হান্ড্রেড টেন বেশ খানিকটা স্পীডে দক্ষিণের দিকে এসে হেয়ার স্ট্রীটে বাঁয়ে ঘুরে বনগ্রাম রোডের দিকে যেতে থাকে। বনগ্রাম রোডে পৌঁছে হোন্ডাটা ডানে মোড় নিয়ে দ্রুত গতিতে টিপুসুলতান রোডের দিকে যেতে থাকে। ভীষণ পাকা চালক, এত ঘিঞ্জি রোডেও খুব দ্রুত গতিতে এগিয়ে যেতে থাকে। হাল্কা বৃষ্টির রাত, লোকজন কিছুটা কমে গিয়েছে রাস্তায়। সবাই বাড়ি ফিরে গিয়ে হয়তো ক্যাসেট প্লেয়ারটা ছেড়ে গান শুনছে, কেউবা দেখছে সাদাকালো টেলিভিশন। রাস্তা স্যাঁতস্যাঁতে হয়ে আছে কাদায় কাদায়। টুং টাং রিক্সার বেল। সব মিলিয়ে একটু ক্লান্ত কালো রাত আজ বনগ্রামে।
কিসমত ওই অন্ধকার জায়গাটা খুব তাড়াতাড়ি পার করার জন্য পা চালায় দ্রুততার সাথে। প্যাঁচপ্যাঁচে কাদা ঢোকে ওর স্যান্ডেলে, পায়ের চারদিকটা এবং তালুতে কাদা লেগে যায়। কিসমতের গা ঘিনঘিন করে। তবুও থামে না ও, হাঁটতে থাকে দ্রুত। আজ কে ওকে এত দ্রুত হাঁটাচ্ছে, ও নিজে তা টের পাচ্ছে না। যদিও যত জোরে ও যেতে চাইছে, ততজোরে পারছে না। পা চলছে না।
এরই মধ্যে লাল হোন্ডাটা বনগ্রাম রোড ধরে চলে এলো ঠিক ওই অন্ধকার জায়গাটায়। এসেই কচ করে ব্রেক করলো হোন্ডাটা এবং দাঁড়িয়ে গেল। অন্ধকারে হোন্ডার দুজন আরোহির কারও চেহারা পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে না। আলোআঁধারিতে হোন্ডাটাকেও খুব একটা দেখা যাচ্ছে না। কিসমত ঠিকই বুঝতে পারলো যে একটা হোন্ডা এসে ঠিক ওর থেকে ৩০ গজ দূরে দাঁড়িয়ে গিয়েছে আচমকা। ও চেষ্টা করলো আরোহীদের দেখার জন্য, না পারলো না, কিচ্ছু দেখা যাচ্ছে না। কিসমত হঠাৎ দাঁড়িয়ে গেল। ওর পা চলছে না, সারা শরীরে কাঁটা দিয়ে গেল মুহূর্তের মধ্যে। ভয়ে শুকিয়ে গেল গলা। কেন হঠাৎ এত ভয় লাগছে, ও মোটেই বুঝতে পারলো না। ও কাঁপতে শুরু করেছে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে, সাথে দরদর করে ঘামছে। সব কিছু ঘটতে শুরু করেছে মুহূর্তের মধ্যেই।
ওদিকে হোন্ডাটা স্টার্ট দেয়া অবস্থায়ই দাঁড়িয়ে। আরোহীদের দৃষ্টি আটকে গিয়েছে কিসমতের দিকে। এই কোণাটা আজ একেবারে নীরব আর অন্ধকার। টিপটিপ বৃষ্টি হচ্ছে। পিছের লুঙ্গি পরা আরোহী কোমরে গুজে রাখা .45 বোরের রিভলবারটা বের করে। সামনের আরোহীকে জিজ্ঞাসা করে, এইটা না?
সামনের আরোহী: হ, এইটাই।
পিছনের আরোহী: ঠিকমতো দেইখা ক।
সামনের আরোহী: কইলাম তো, এইটাই।
পিছনের আরোহী, আগা।
হোন্ডাটা আস্তে আস্তে কিসমতের দিকে এগিয়ে যেতে থাকে। কিসমত বুঝে ফেলে হোন্ডাটা আসছে ওর দিকে। কিসমত আস্তে আস্তে পিছাতে থাকে একপা একপা করে। হোন্ডাটা আগাতে থাকে ধীরে ওর দিকে। ওর ১০ গজের মধ্যে আসার সাথে সাথে কিসমত হঠাৎ ঘুরে দৌড় দেয় টিপুসুলতান রোডের দিকে।
পিছনের আরোহী: টান দে।
হোন্ডাটা মুহূর্তের মধ্যে সিংহের মতো গর্জন করে টান দেয় এবং সেকেন্ডের মধ্যে কিসমতের একেবারে কাছে পৌঁছে যায় এবং সামনের চাকা দিয়ে কিসমতের পায়ের পিছন দিকটায় প্রচণ্ড জোরে আঘাত করে। কিসমত হুমড়ি খেয়ে সামনের ড্রেনের মধ্যে মুখ থুবড়িয়ে পড়ে যায়। সামনের আরোহী চিৎকার করে বলে ওঠে, চালা।
পিছনের আরোহী আর দেরি করে না। কিসমতের পিঠ লক্ষ্য ঠাস ঠাস ঠাস করে তিনটা গুলি করে। কিসমত চিৎকার করারও সুযোগ পায় না। থেমে যায় ওর হৃদস্পন্দন। গলগলিয়ে গাঢ় লাল রক্ত বেরিয়ে আসে ওর পিঠের বা সাইড থেকে। ড্রেনের ভিতর কিসমতের মুখটা উপুড় হয়ে পড়ে থাকে আর প্রাণহীন দেহটা স্যাঁতস্যাঁতে কর্দমাক্ত রাস্তায়। ড্রেনের পানির গতি এসে আটকে যায় মাথায় এবং মাথাটা পাশ কাটিয়ে একটু বেঁকে চলে যেতে থাকে আগের মতো। রক্তে ভেসে যায় রাস্তা, রক্তের আরেকটা রেখা গিয়ে পড়ে ড্রেনের পানিতে।
সামনের আরোহী বলে: দেখতো মরছে কীনা।
এই বলে হোন্ডাটা নিয়ে আরও কাছে আসে লাশটার। পিছনের আরোহী পর্যবেক্ষণ করে লাশটাকে এবং বলে, শ্যাষ, টান দে।
হোন্ডাটা প্রচণ্ড জোরে টান দিয়ে টিপুসুলতান রোডে গিয়ে ডানে ঘুরে রথখোলার দিকে চলে যায়। কিসমতের প্রাণহীন দেহটা পড়ে থাকে ড্রেনের পাশে। দূরের টিমটিমে লাইটপোস্টের আলোয় আবছাভাবে দেখা যায় কিসমতের পড়ে থাকা দেহটা। কোনো এক গাঁয়ের মাটির ঘরে কিসমতের জন্ম হয়েছিল, মা আদর করে নাম রেখেছিল কিসমত। কিন্তু ডাকতো কিসমইতা বলে। কিসমতের কিসমতটা আসলেই ভালো ছিল না। তা না-হলে এই অপঘাতে মৃত্যু হয়! প্রথমে দুইটা রিকশা এসে থামে লাশটার কাছে এবং আস্তে আস্তে একজন দুজন করে মানুষ আসতে থাকে লাশটা দেখার জন্য। ধীরে ধীরে ভিড় হয়ে যায়।
চলবে