রংবাজ

উপন্যাস ৭

আশিকুজ্জামান টুলু

প্রকাশিত : সেপ্টেম্বর ২৪, ২০১৮

সকালে ঘুম ভেঙে যায় সেন্ট্রির ডাকে। নিজেকে আবিষ্কার করে ও ঘরের এক কোনায়। মাথার নিচে ময়লা কাপড় দিয়ে প্যাঁচানো একটা দশ ইঞ্চি ইট। ও বুঝে ফেলে, এটা গোপালের স্নেহ। হাজতে কাউকে ও দেখতে পায় না, পুরো ঘরটা খালি। ও বেঘোরে ঘুমাচ্ছিল। সুঁই ফুটানো আঙুল দুটোতে প্রচণ্ড ব্যথা, ফুলে গিয়েছে খুব। সারা শরীরেও অসহনীয় ব্যথা। উঠে বসতে ওর বেশ বেগ পেতে হয়। বসতে গিয়ে পশ্চাৎদেশে প্রচণ্ড ব্যথা টের পায়। কালরাতে বেধড়ক মারের ফল এটা। ধীরে ধীরে উঠে দাঁড়ায় ও। সেন্ট্রি ওকে নিয়ে আসে ওই বড় ঘরটায়। ওখানে ওর বড়ভাই, মা, মামা এবং আরও কিছু লোককে দেখতে পায়, ঝরঝর করে কেঁদে দেয় বাবু। মা, মামা মাথায় হাত বুলিয়ে ওকে আদর করে এবং বলে, মোটেই চিন্তা করিস না, আজই তোর বেল হয়ে যাবে। তোর স্কুলের সাকিনা আনোয়ার টিচারের হাসবেন্ড সব ব্যবস্থা করে দেবেন। উনি পুলিশের আইজি।

বাবু কিছুই শুনতে পায় না, শুধু কাঁদে। ওখান থেকে ওকে সেন্ট্রি হিড়হিড় করে টেনে নিয়ে গিয়ে একটা চারদিক বন্ধ ট্রাকে ওঠায়। ও কিছুই বুঝতে পারে না, কেমন মন্ত্রমুগ্ধের মতো চলতে থাকে। ট্রাক ছেড়ে দেয়। ট্র্যাকের ভিতর কোনো বসার জায়গা নাই, দাঁড়িয়ে থাকতে হয় সারা পথ।

বাবুকে পুলিশ রমনা থানায় নিয়ে যায়। ওখানে ঘণ্টা দুয়েক বসার পরে ওকে কোমরে দড়ি বেঁধে চারজন পুলিশের সিপাই ওকে নিয়ে যায় রাস্তার ওপারের ডিবি অফিসে। যাওয়ার সময় পথে দেখা হয়ে যায় ওর কয়েকজন স্কুলের বন্ধুর সাথে। ওরা খুব আশ্চর্য হয়ে ওর দিকে তাকায় এবং জিজ্ঞাসা করে, কি হয়েছে তোর?
বাবু: না দোস্ত, কিছু না। নাটকের শুটিং চলছে, সরে যা।

বন্ধুরা আশ্চর্য হয়ে বাবুর দিকে তাকায়। মনে মনে ভাবে, বাবু আবার নাটক ধরলো কবে! এই ভাবতে ভাবতে বাবু ওদেরকে পার করে পৌঁছে যায় ডিবি অফিসের দরজায়। ওরা স্তম্ভিত হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। ডিবি অফিসে নিয়ে বাবুকে আবার জিজ্ঞাসাবাদ করা হয় তবে এবার জানোয়ারের মতো মারধোর করা হয় না। বাবু তার একটাই উত্তর এখানে রিপিট করে, আমি জানি না কিভাবে কিসমতের মৃত্যু হয়েছে।

পরদিন ওকে কোর্টে নিয়ে যায়। গিয়ে ওঠে কোর্ট হাজতে। অসম্ভব নোংরা একটা পরিবেশ এই কোর্ট হাজতের। একটা ৩৫ ফিট বাই ৩৫ ফিট রুমের মধ্যে একশো জনের উপরে লোকের দাঁড়িয়ে বসে থাকা। রুমের কোনায় তিন ধারে দেয়াল দেয়া একটা বাথরুম। দেয়ালগুলো মাত্র দুই ফিট উঁচু। ওই বাথরুমেই সবাই সবার সব কাজ সারছে, কারো কোনো বিকার নাই। সবার ভিতরেই ত্রাহি ত্রাহি অবস্থা। কেউ চুরির আসামি, কেউ খুনের, কেউ ডাকাতির, কেউবা আবার পাচানি কেসের।

বিবিধ ধরনের মানুষের সমাগম। জনমানুষের ভিড়ে বাবু কোথায় যেন এককোণে হারিয়ে যায়। ওর সমস্ত শরীরে ক্ষত চিহ্ন, গিঁটে গিঁটে ব্যথা, নড়াচড়া করার শক্তি নাই। টেনশনে টেনশনে মনোবল বলে কিছুই অবশিষ্ট নাই। গলা শুকিয়ে কাঠ হয়ে গিয়েছে, তবু ওই নোংরা বাথরুমের একফোঁটা পানিও ওর ছুঁতে ইচ্ছে করছে না। এভাবে কখন যেন দুপুর পেরিয়ে যায়। বিকেল ৩টা নাগাদ ওর ডাক পড়ে কোর্টে। ওকে নিয়ে যায় কোর্ট পুলিশ এসে। কোর্টরুমে ঢুকে ওকে এজলাসে দাঁড়া করানো হয়। ওর কিছুই বলতে হয় না, একজন উকিল ওর হয়ে সব বলে দেয়। ও ওর মা ও মামাকে বসে থাকতে দেখে সামনে। উকিল আর জজ কী সব বলাবলি করে, ও কিছুই বুঝতে পারে না। ওর বোঝার শক্তি কোথায় যেন হারিয়ে গিয়েছে। কিছুক্ষণ পর ওকে এজলাস থেকে নামিয়ে ওর মা ও মামার কাছে হস্তান্তর করা হয়। মা ওকে জড়িয়ে ধরে, ও কেঁদে দেয়। এই কান্নাটা কেমন যেন অসহায়ের কান্না। ওকে ধরে ধরে মামা নিয়ে যায় রাস্তায় এবং অতঃপর একটা রিক্সায় উঠায়।

বাবু বাসায় চলে আসে কিন্তু মনের ভিতরটা ক্ষতবিক্ষত হয়ে থাকে। কেমন যেন একটা ভয়ে মনের ভিতরটা কুঁকড়ে থাকে। বারবার মনে হতে থাকে, যদি ওই পুলিশগুলো আবার আসে ওকে ধরে নিয়ে যাওয়ার জন্য? আবার যদি থানায় নিয়ে ওকে পশুর মতো মারধোর করে? ওর কিছুতেই এই ভয়টা দূর হয় না মন থেকে। রাত হয়ে যায়, ও কিছুই খেতে পারে না, একবারে কোনো খিদা ওর নাই। মুখটা একেবারে বিস্বাদ হয়ে আছে। মা তবুও জোর করে ওকে এক গ্লাস দুধ খাওয়ায়। ও বাধ্য হয়ে কোনোরকমে দুধটা গিলে ফেলে। সাথে গা ব্যথা ও জরের ওষুদ। কারণ বাবুর গায়ে প্রায় ১০২ জ্বর। ওকে মা ঘুমাতে বলে, ও আজ মা’র সাথে শুয়েছে। কিছুতেই ঘুম আসে না। এক সময় সারাবাড়ি ঘুমিয়ে পড়ে, শুধু জেগে থাকে বাবু একা। রাত বাড়তে থাকে, নীরবতা চারদিকটাকে গ্রাস করে ফেলে। তবুও বাবুর চোখে কোনো ঘুম আসে না। ওর স্মৃতির প্রতিটা কোনায় কোনায় মারধোরের সময়টা ফিরে ফিরে আসতে থাকে। ও চোখ বুজতে ভয় পায়, অন্ধকারের মধ্যেই চোখ খুলে রাখে। কিছুই দেখতে পায় না ও। অন্ধকারটা এতই গাঢ় যে, ও বুঝতে পারে না ওর চোখ খোলা না বোজা। এভাবে কখন যেন বাবু গভীর ঘুমে ঢলে পড়ে। দুইদিন এক মুহূর্তের জন্য ওর সাউন্ড স্লিপ হয় নাই।

চলবে