রংবাজ

উপন্যাস ৮

আশিকুজ্জামান টুলু

প্রকাশিত : সেপ্টেম্বর ২৫, ২০১৮

পরদিন।
সকাল ১১টা। বেঘোরে ঘুমাচ্ছে বাবু। ওকে দেখে মনে হচ্ছে, কতযুগ ও ঘুমায় না। মা ওকে অন্য সবদিনের মতো একবারের জন্যও বলে না, ‘বাবু ওঠ, বেলা ১২টা বেজে গেছে।’ বারোটা নাগাদ বাবু উঠে পড়ে। উঠে চুপচাপ বসে থাকে বিছানায়, নামতে ইচ্ছা করে না। মা বিছানায় খাবার এনে দেয়। বাবু কিছু মুখে দিতে পারে না, মা এসে একটু রুটি আর আলুভাজি ওর মুখে তুলে দেয়। কোনোরকমে চিবিয়ে গিলে ফেলে। মাঝে মাঝেই মনে ফিরে আসতে থাকে দুঃস্বপ্নের রাত। মেইন দরজায় কে যেন কড়া নাড়ে। বাবুর কান খাড়া হয়ে ওঠে। রোকেয়া রান্নাঘর থেকে চিৎকার করে জিজ্ঞাসা করে, কে?

কারো সাড়া নাই। রোকেয়া রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে মেইন দরজার কাছে চলে যায়। দরজা খুলে দাঁড়ায়। দুজন লোককে দেখতে পায়। জিজ্ঞাসা করে, কারে চান?
বাবু সাহেব আছেন?
রোকেয়া ঠিক ঠাওর করতে পারে না কাকে খুঁজছে এরা। বাবু সাহেব বলে তো এই বাসায় কেউ নাই। ও আসলে একটু কনফিউজড হয়ে যায়। একবার ওদের বাবুর কথা মনে এসেছিল, কিন্তু বাবুকে কেউ কোনোদিন সাহেব বলে সম্বোধন করে নাই বিধায় ও ঠিক চিনতে পারছিল না। ও লোকগুলোকে বলে, খাঁড়ান আপনারা, নানিরে ডাকি। এই বলে ও চলে আসে ভিতরে এবং বাবুর মাকে ডাক দেয়। বাবুর মা দরজার কাছে চলে যায়। লোক দুটোর দিকে প্রশ্ন নিয়ে তাকায়। লোকগুলো বলে ওঠে, আপা আমরা থানা থেকে এসেছি। আমাদের একটা ভুল হয়ে গিয়েছে, আমরা একটু বাবু সাহেবের সাথে দেখা করতে চাই।
কি ব্যাপারে?
আমাদের একটা বিরাট ভুল হয়ে গিয়েছে। আমরা একেবারেই জানতাম না যে, আপনারা আইজি স্যারের আত্মীয়। আমরা ভুল করে বাবু সাহেবের গায়ে হাত তুলেছি, আমরা ওনার কাছে ক্ষমা চাইতে এসেছি।
বাবুর মা খুবই আশ্চর্য হয়ে যায়। ভালোমতো লোকদুটোকে পরখ করে দেখতে থাকে। হঠাৎ ওনার মনে পড়ে যায় যে, এই লোকদুটোকে উনি সুত্রাপুর থানাতে দেখেছিলেন। হ্যাঁ, এরা পুলিশের লোক। বাবুর মা আশ্চর্য হয়ে বলেন, কি বলছেন আপনারা! আপনারা যখন একটা নিরাপরাধ বাচ্চাকে মারলেন তখন মনে পড়ে নাই যে অন্যায় করছেন? এখন আবার অতটুকু একটা বাচ্চার কাছে মাফ চাইতে এসেছেন?
আপা আমাদের আপনারা মাফ করে দেন। আমাদের ছোট ছোট বাচ্চা আছে সংসারে, বুড়া মা বাবা আছে, আইজি স্যার আমাদের সাসপেন্ড করে দিয়েছেন। আমাদের পেটে লাথি দিয়েন না আপা, আমাদের মাফ করে দেন। আমাদের একবার মাফ চাওয়ার সুযোগ দেন বাবু সাহেবের কাছে। আমরা এ জীবনে এরকম ভুল আর করবো না। আপনারা যদি আইজি স্যারকে একটু বলে দেন তাহলে আমরা বালবাচ্চা নিয়ে বেঁচে যাই।

বাবুর মা’র খুব খারাপ লাগে শুনে যে ওরা চাকরি থেকে সাসপেন্ড হয়ে গিয়েছে। একমুহূর্ত কী যেন ভেবে উনি বলেন, একটু দাঁড়ান। বাবুর মা ভিতরে যান এবং বাবুকে বলেন, ওই পুলিশ দুইটা এসেছে যারা তোকে মেরেছিল। এই কথাটা শুনে বাবুর গলা শুকিয়ে যায় ভয়ে। কাঁপা গলায় মাকে জিজ্ঞাসা করে, কেন এসেছে?
ওরা তোর কাছে মাফ চাইতে এসেছে।
মাফ চাইতে? কিসের মাফ?
ওরা বলছে যে তোকে ভুল করে মেরেছে।
না মা, আমার ভয় লাগছে, ওরা আবার আমাকে ধরে নিয়ে যাবে না তো?
আরে না, পাগল নাকি তুই? তোকে আমরা বেইল করে এনেছি, কেউ তোর কিছু করতে পারবে না।
বাবু কিছু বলেনা, চুপ করে থাকে। মা চলে যায় এবং ওদেরকে নিয়ে আবার ফিরে আসে। ওরা এসে সামনের চেয়ারে বসে। কথা বলতে বলতে হঠাৎ বাবুর পায়ের কাছে চলে আসে এবং উদ্যত হয় বাবুর পা ধরে মাফ চাইতে। ‘স্যার আমাদের মাফ কইরা দেন, আমাদের পেটে লাথি দিয়েন না। আমাগো ছোট ছোট বাচ্চা আছে সংসারে, সব না খাইয়া মইরা যাইবো, আমাদের ভুল হইয়া গেছে। আমরা বুঝি নাই যে, আপনাগো আত্মীয় আইজি স্যার। আমাগো সাসপেন্ড কইরা দিছে উনি। আপনে একটু কইয়া আমাগো চাকরিটা একটু বাঁচান।
বাবু: ঠিক আছে মাফ করে দিচ্ছি। কিন্তু আপনাদের চাকরির ব্যাপারে আমি কিছু জানি না, ওইটা আমি ওনাকে বলতে পারবো না।

আরও কিছুক্ষণ ওদের কান্নাকাটির অভিনয় চলে এবং একসময় ওরা চলে যায়। বাবুর কেমন যেন একটা স্বস্তি আসে মনের এক কোনায়।

যেদিন বাবু মুক্তি পায়, তার ঠিক দুইদিন পর ওর মেট্রিক পরীক্ষা। সারা গায়ে বিষের মতো ব্যথা আর জ্বর। কিন্তু উপায় নেই, পরীক্ষা ওকে দিতে হবেই। পরীক্ষার দিন চলে যায় বাবু পরীক্ষা দিতে। বেঞ্চে ঠিকমতো বসতে ওর খুব কষ্ট হয়। কোনোমতে পরীক্ষাগুলি শেষ করে। এর মধ্যে কয়েকটা দিন কেটে যায়। বাবু ফার্স্ট ডিগ্রি মার্ডার কেসে ফেঁসে যায়। ওকে বানানো হয় প্রধান আসামি। কেসটা এভাবে সাজানো হয়, বাবু কিসমতের সাথে আগের দিন পানি নিয়ে ঝগড়ার একপর্যায়ে ওকে খুন করার থ্রেট দেয় এবং বন্ধুবান্ধব নিয়ে পরের দিন রথখোলার মোড়ে কিসমতকে পেয়ে হোন্ডা থেকে গুলিবর্ষণ করে হত্যা করে। রিপন ও সাবুকে যথাক্রমে দ্বিতীয় ও তৃতীয় আসামি করা হয়েছে কেসে। রিপন ও সাবুর বাসায়ও পুলিশ গিয়েছিল কিন্তু ওদের পায় নাই এবং ওরা ওদের ফ্যামিলির প্রভাবে কোর্টে গিয়ে জামিন নিয়ে নিয়েছে। পুলিশের মার যা খাওয়ার বাবু একাই খেয়েছে। শুরু হয়ে যায় কোর্টে যাওয়া আসা। প্রতি মাসেই হাজিরা দিতে হয় ওদের, সাথে কেস চলতে থাকে। থানার আইও চার্জশীট দাখিল করে কোর্টে। শুরু হয়ে যায় কেস ।

চলবে