রওশন আরা মুক্তার গদ্য ‘হেমন্তের দুপুরে’

প্রকাশিত : জানুয়ারি ০৮, ২০২১

মধ্যরাতের যেমন একটা নীরবতা থাকে, মধ্য দুপুরেরও এমন একটা সময় থাকে; যখন সব যেন থেমে আসে। সব আসলে চলতে থাকে কিন্তু কেমন যেন স্থির। হাজার বছরের পুরাতন কোনো ঘটনার মতো প্রতিদিন একটা দুপুর হয়। ঝনঝনে দুপুর। রাতের নৈঃশব্দ্য ভাঙে নিশুতি রাতের মায়ার পাখি; আর ভরদুপুরের এই নীরবতাকে ভাঙে কোনো একটা মায়াময় কণ্ঠ।

এ মায়ার সাথে পাখির ছায়া মিশে দুপুরটি হয়ে ওঠে আরো হৃদয় বিদারক। জনারণ্যেও নীরবতা থাকে, ফিসফিস করে মায়ার কণ্ঠ কিছু বলে গেলেও শুনে ফেলে কেউ; অজস্র শব্দের ভিতর। রাতকে এফোঁড় ওফোঁড় করে দিয়ে চলে যায় জারিয়ার ট্রেন। যে নদী আছে বলে জানি, অথচ দেখিনি। পাতালে না ভূমিতে কোথায় সে নদী, জানা নাই।

নদীটি ভরদুপুরে শান্ত হয়ে শুয়ে থাকে গৌরীপুরের রোদের নিচে। নানা রকম শব্দ ভাসে বাতাসে, ধানক্ষেতের মাঝখান দিয়ে পায়ে হাঁটা সরু পথ জানায়, এখানে আছে জ্ঞান। আর কিছু বিদ্যা।

বাতাসে যারা থাকে তারা ধানের শীষের সাথে কথা বলে, সরসর শব্দগুলো শুনতে পাওয়া যায়, ধানের ক্ষেতে বর্ষার রেখে যাওয়া মৃদু পানি। ছোট ছোট মাছ এদিক ওদিক ছোটাছুটি করে। মাথায় একটা রূপালি রঙের ফোঁটা। ওদের বোনরা ওদের খুব ভালোবাসত। বিধাতার কাছ থেকে চেয়ে এনেছে তাই এই স্থায়ী ভাই ফোঁটা।

ভাই বোনটার কপালে ছুঁয়ে দিয়েছে কপাল। ভাইয়ের কপালে দিলাম ফোটা যম দুয়ারে পড়ল কাঁটা। বোনের কপালে দিলাম ফোটা যম দুয়ারে পড়ল কাঁটা।
 
বাতাস এসে দোলা দেয় তাদেরও। হালকা ঢেউ খেলা করে ওদের মনে। ধান গাছের গোঁড়া ছুঁয়ে ছুঁয়ে ভাইবোনের এই প্রেম চলতে থাকে। কপালে রূপালি টিপ পড়া মাছদের সাথে ধান গাছেরও একটা প্রেম হয়। সে প্রেমের মায়ার ইতিহাস ধান ধারণ করে রাখে।

গেরস্থ ঘরের মেয়েরা যখন এ ধান শুকায়, রোদের নিচে শুকাতে দেয় এমনি ভরদুপুরে, তাদের মন কেমন যেন করে ওঠে। ধানের বুকে গচ্ছিত মাছেদের মায়ার ইতিহাস গেরস্থ ঘরের মেয়েদের উদাস করে তোলে। শাড়ির আঁচল খসে পড়তে চায় তাদের।

যে প্রেম সে পায়নি, যে প্রেমিকের মুখ শুধু স্বপ্নে আসে তার জন্য তার গচ্ছিত রাখা শরীর আকুল হয়ে ওঠে। কখনও কখনও ধান পায়ে কাঁটা হয়ে ফুটে তার। পৌঁছে যায় বুক অবধি।
 
বিকেলের দিকে প্রাচীন কুয়ার ঠাণ্ডা পানিতে গোসল করে সে ব্যথা দূর করতে চায় গেরস্থ ঘরের মেয়েরা। ধানের শরীরে মাখা মাছেদের মায়া তাদের বর্শাহত মাছের মতো ব্যাকুল করে তোলে। রাতে ছাতিমের গন্ধ যখন তার রঙ দেখায়, এই নামছি নামছি শীতের মৃদু কুয়াশা যখন ছাতিমের চেহারা আঁকে, ঘুম ভেঙে যায় তাদের। সুর করে কাঁদে গেরস্থ ঘরের মেয়েরা।

স্বপ্নে তারা ভরদুপুরের শান্ত নদীর নিচে মাছ হয়ে পথ চলতে থাকে। সব চলতে থাকে ভরদুপুরে। কিন্তু কেমন যেন স্থির।

লেখক: কবি ও কথাসাহিত্যিক