
রক্তমাখা চাঁদের আলো অথবা নিজের কথা
পর্ব ২
জাকির তালুকদারপ্রকাশিত : এপ্রিল ২৫, ২০১৯
আমার গল্পে-উপন্যাসে ইসলামী অনুষঙ্গ প্রয়োগের ব্যাপারটি সচেতন পাঠকের দৃষ্টি এড়ায়নি। এই কাজটি আমি যে খুব সচেতনভাবে শুরু করেছিলাম তা নয়। তবে সবসময় মনে হয়েছে, বাঙালি মুসলমান হিসাবে দুইটি সাংস্কৃতিক ধারার সম্মিলিত উত্তরাধিকার অর্জন করেছি আমি। একটি আবহমান বাংলা, দ্বিতীয়টি বাংলার মাটি-বাতাস দ্বারা পরিশ্রুত এবং মিশ্রিত ইসলামি সংস্কৃতি।
ইসলামের সাথে পরিচয়ের জন্য কোনো আমাকে কোনো মোল্লা-মাদ্রাসার দ্বারস্থ হতে হয়নি। কারণ আমি বড় হয়েছি পৃথিবীর অন্যতম শ্রেষ্ঠ একজন বাঙালি মুসলমানের তত্ত্বাবধানে। তিনি উম্মে ছাবিরন নেছা। আমার দাদি। কলকাতায় স্কুলশিক্ষা পেয়েছিলেন তিনি। কিন্তু বিয়ে হয়ে যায় অল্প বয়সে। তাই প্রাতিষ্ঠানিক পড়াশোনা আর হয়নি। কিন্তু শিক্ষা জীবনভর অব্যাহত ছিল তার। আমার পিতা যখন তার গর্ভে, সেই সময় আমার দাদা দ্বিতীয় বিয়ে করেন। উম্মে ছাবিরন নেছা গর্ভস্থ আমার পিতাকে নিয়ে সেই যে পিত্রালয়ে চলে আসেন, আর কখনোই স্বামীগৃহে যাননি। দাদির পৈত্রিক সূত্রে পাওয়া সেই বাড়িতেই জন্ম আমার পিতার এবং আমারও।
ফজরের নামাজ পড়ে মহল্লার শিশুদের কোরআন এবং নামাজ শেখাতেন দাদি। বারান্দায় মাদুর, পাটি, সপ বিছিয়ে লাইন ধরে বসে আছে ১০-১২ জন শিশু-কিশোর-কিশোরী। কেউ পড়ছে আমপাড়া-সিপারা। কেউ কোরআন। এই পাঠদান ছিল সম্পূর্ণ বিনামূল্যে। আমি নিজেও এই বারান্দা-মাদ্রাসারই ছাত্র। মহল্লার ফ্রি প্রাইমারি স্কুলে ভর্তি হবার সঙ্গে সঙ্গেই আরবি পড়াও শুরু। ক্লাস টু-তে পড়ার সময় প্রথম কোরআন খতম। নামাজ এবং প্রয়োজনীয় মসলা-মাসায়েল দাদির কাছেই শেখা।
দুপুর বেলাটা বিশ্রাম নিতেন দাদি। সেই সময় তার কাছে শুনতাম রামায়ণ-মহাভারতের গল্প, কাসাসুল আম্বিয়ার গল্প, বিষাদ সিন্ধুর কাহিনী। আসরের নামাজের পরে মুখে পান নিয়ে যেতেন মহল্লার বিভিন্ন বাড়িতে। যার অসুস্থতার খবর পেতেন, দেখতে যেতেন তাকেই। হিন্দু-মুসলমান নেই।
স্বাধীনতার পর পর অসম্ভব দারিদ্র্য এবং অভাব সর্বত্র। রোজার সময় আমাদের সেমাই তৈরির মেশিনে তার সাথে মিলে বানাতাম সেমাই। আমি হ্যান্ডেল ঘোরাতাম মেশিনের। আর তিনি ময়দা-মসলা ঠেসে দিতেন মেশিনের মধ্যে। মোটা সেমাই শুকানো হতো রোদে বিছানো পাটিতে। শুকানো পর্যন্ত কোনো পাখ-পাখালি বা কুকুর-বেড়াল যাতে নষ্ট করতে না পারে, সে কারণে পাহারায় বসে থাকতে হতো আমাকেই। ঈদের দুইদিন আগে সেমাইয়ের একটি করে পোটলা আর কাগজের ঠোঙায় আধাসের পরিমাণ চিনি পৌঁছে দিতেন দাদি মহল্লার গরিব মুসলমানদের বাড়িতে বাড়িতে।
আমাদের বাড়ির পেছন দিকে বাঁশঝাড়। তার পেছনেই ধোপাপাড়া। চার-পাঁচটি পরিবার। টগর জ্যাঠা, মোহিত জ্যাঠা, রণজিৎ কাকা, নিতাইদা আর তাদের পরিবারের মানুষজন। ঈদের দিন তাদের সবার দাওয়াত। গায়ে গা লাগানো প্রতিবেশিকে সাথে না নিয়ে আনন্দ করা ঠিক না।
বাড়িতে ছিল মাসিক মোহাম্মদী পত্রিকার অনেকগুলো বাঁধানো সেট। আর বেশ কিছু বই। আর ছিল মধ্যযুগের অনেক পুঁথির বটতলার সংস্করণ। সব বুঝতাম না। কিন্তু পড়তে তো ভালোই লাগত।
এককথায় দাদির জীবনই আমার কাছে ইসলামের উদাহরণ।
ইসলামি এবং প্রাক-ইসলামি এইসব মিথ, কথা-কাহিনী, অনুষঙ্গ আমার গল্পনির্মাণে কাজে লেগেছে।
পরবর্তীতে আমি খেয়াল করি যে, চল্লিশের দশকে ঢাকার মুসলিম সাহিত্য সমাজ বা শিখা গোষ্ঠীর সদস্যরাই মুসলমানদের মধ্যে সর্বশেষ লেখক-চিন্তাবিদ গোষ্ঠী যারা মুসলমানদের নিয়ে ভেবেছেন এবং লিখেছেন। তারা নির্যাতিতও হয়েছেন।
কিন্তু তারপরেই এই দেশের আধুনিক লেখক-কবি-চিন্তাবিদরা নিজেদের পুরোপুরি সরিয়ে নিয়েছেন ইসলাম থেকে। ইসলামকে ছেড়ে দিয়েছেন মুসলিম লীগ, জামাতে ইসলামী, নেজামে ইসলামীর মতো দলের হাতে। ছেড়ে দিয়েছেন মোল্লা-মাদ্রাসার হাতে, তবলিগ-কওমীদের হাতে। এরা ইচ্ছামতো ইসলামকে ব্যবহার করেছে ক্ষমতার হাতিয়ার হিসাবে, প্রগতিশীলদের কোণঠাসা করার কাজে, চাঁদাভিক্ষা আর জালসার নামে ইসলামের বিকৃত ব্যাখ্যার কাজে। ফলে বাঙালি মুসলমানের চেতনার মান হয়েছে আরো অধোগামী, তাদের সাংস্কৃতিক চেতনা হয়েছে বিকৃত এবং অসংলগ্ন, জীবনমান হয়েছে আরো নিম্নগামী।
বিশ্বজুড়ে কয়েক শ বছর ধরে মুসলমানদের পরাজয়, পিছুহটা এবং পিছিয়ে পড়ার জন্য প্রধানত দায়ী মুসলমানরা নিজেরাই। তারা মুখ ফিরিয়ে থেকেছে জ্ঞান-বিজ্ঞান, শিল্প-সাহিত্য, সংস্কারমুখি চিন্তাধারা থেকে। তার সঙ্গে আছে আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্র, যা অনুধাবণে মুসলমানরা অক্ষম। অক্ষম আত্মসমালোচনা করতেও।
নিজেদের ওপর সারা বিশ্বজুড়ে নেমে আসা অত্যাচার তারা প্রতিহত করতে গেছে ব্যক্তিগত এবং গোষ্ঠীগত সন্ত্রাসের মাধ্যমে। তার ফলে তাদেরকে সন্ত্রাসী হিসাবে চিহ্নিত করার সুযোগ আরো বেড়ে গেছে প্রতিপক্ষের। সেইসাথে বেড়ে গেছে তাদেরকে প্রয়োজনে ব্যবহার করে পরে ইচ্ছেমতো ছুঁড়ে ফেলার সুযোগও। ফিলিস্তিন, কাশ্মির, আফগানিস্তান, ইরাকসহ সমগ্র মধ্যপ্রাচ্য তার উদাহরণ। বাংলাদেশেও উগ্রবাদ বিষাক্ত ছোবল হেনেছে অনিবার্যভাবেই।
এই পটভূমিই আমাকে দিয়ে লিখিয়ে নিয়েছে ‘মুসলমানমঙ্গল’। কারো কাছে সেটি উপন্যাস, কারো কাছে না-উপন্যাস, কারো কাছে অ্যান্টি-উপন্যাস। তা যে নামেই ডাকা হোক, এটি একটি প্রয়োজনীয় রচনা বলেই বিবেচিত হয়েছে বাংলাভাষী চিন্তাশীল মানুষের কাছে। জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক পরিস্থিতি পর্যালোচনা করলে ধারণা করা যায় পাঠক ‘মুসলমানমঙ্গল’ পড়বেন আরো অন্তত ৫০ বৎসর। তা একমত পোষণ করার জন্যই হোক, আর দ্বিমত প্রকাশ করার জন্যই হোক।
তবে আফশোস, এমন একটি বই লেখার জন্য সবসময় অনুপ্রাণিত করতেন যে আহমদ ছফা, তিনি বইটি দেখে যেতে পারেননি। চলবে
লেখক: কথাসাহিত্যিক