রক্তমাখা চাঁদের আলো অথবা নিজের কথা

পর্ব ৩

জাকির তালুকদার

প্রকাশিত : এপ্রিল ২৬, ২০১৯

ঢাকাতে একটি দল বেরিয়েছে লেখক-কবিদের মধ্যে। তারা নিজেদের অভিজাত লেখক মনে করেন। আমাকে দেখিয়ে টিপ্পনি কাটেন, ওই যে যাচ্ছে লেখক, গরিব নিয়ে লেখে। গরিব বেচে খায়।
আমার উত্তরটা পরে জানাচ্ছি।

একাধিকবার পুলিৎজার বিজয়ী লেখক থর্নটন ওয়াইল্ডার অভিজাত বা আভিজাত্যের সাথে ‘ইতর’ শব্দটি বসাতেন। শুধু আভিজাত্য বলতেন না। বলতেন, ‘ইতর আভিজাত্য’। আভিজাত্যের এই ইতরামি দামি কাপড়ের নিচে খোশ-পাঁচড়ার মতো। লুকিয়ে রাখতে চাইলেও বেকায়দা সময়ে চুলকানি ওঠে। জনসমক্ষেই চুলকাতে বাধ্য হতে হয়। তাই প্রচণ্ড মননশীল আবু সয়ীদ আইয়ুবের মুখ থেকেও নিজের অজান্তেই বেরিয়ে আসে তার মনোভাব, তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়! ও তো একটা আস্ত গেঁয়ো!

একই ধরনের কথা বলতেন হুমায়ুন কবিরও। ‘পরিচয়’ পত্রিকায় মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের উপন্যাসের আলোচনা লিখতে গিয়ে বৈদগ্ধের অহঙ্কারে অন্ধ ধূর্জটিপ্রসাদ মুখোপাধ্যায় লেখকের নামটাই বিকৃত করে লিখলেন ‘মাণিকলাল’। আর অভিজাত সুধীন্দ্রনাথ দত্ত সেটি ছাপলেন। মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়কে তুচ্ছ করার যে প্রবণতা ধূর্জটিপ্রসাদ দেখালেন, তাতে সম্মতি জানালেন চূড়ান্ত অভিজাত্য-গর্বিত সুধীন দত্ত। সবচেয়ে অভিজাত, সবচেয়ে উন্নত মানের পত্রিকা ‘পরিচয়’ ছাপতে চায়নি জীবনানন্দ দাশের কবিতাও। ‘ক্যাম্পে’ কবিতাটি সুধীন দত্ত ফেলে রেখেছিলেন। ছাপতে চাননি। বিষ্ণু দে জোর করলেন। তিনিই জীবনানন্দকে চিঠি লিখে ‘পরিচয়ে’ কবিতা পাঠানোর অনুরোধ জানিয়েছিলেন। অবশেষে বাধ্য হয়ে সুধীন দত্ত ছাপলেন কবিতাটি।

এগুলো সবই বাংলাসাহিত্যে আভিজাত্যের ইতরপনার উদাহরণ। আবু সয়ীদ আইয়ুব, সুধীন্দ্রনাথ দত্ত, ধূর্জটিপ্রসাদ মুখোপাধ্যায় গৌণ কেউ নন। কিন্তু তারাশঙ্কর, মানিক, জীবনানন্দের প্রতিভা ও সৃষ্টিক্ষমতাকেও স্বীকার করতে অনীহা। কারণ তারা যথেষ্ট অভিজাত নন। আসলে পয়সাঅলা ধনী নন। ইতর আভিজাত্য তাদের এটাও বুঝতে দেয়নি যে টাকা বানাতে চাইলে তারাশঙ্কর-মানিক-জীবনানন্দ তাদের চাইতে পিছিয়ে থাকতেন না। আর পারিবারিকসূত্রে পাওয়া আভিজাত্য? সে তো প্রাকৃতিক ঘটনা-দুর্ঘটনা। অভিজাত পরিবারে নিজে নিজে তো কেউ জন্ম নিতে পারে না।

এবার আমাদের বর্তমানের অভিজাতদেরকে আমার উত্তরটা জানাই। লেখালেখি তাদের নিয়েই করা যায় যে জনগোষ্ঠী, যে ভূগোল, যে জীবনসংগ্রাম লেখকের সবচাইতে বেশি পরিচিত। আমি যেহেতু আমাদের দেশের লুটেরা-চোর-ভুঁইফোঁড় উচ্চবিত্ত সমাজ থেকে নিজেকে সরিয়ে রাখি, তাই তাদের চিন্তা ও জীবনধারা সম্পর্কে আমার পরিষ্কার ধারণা নেই। আমি চিনি সমাজের নিম্ন-মধ্যবিত্ত, এবং নিম্নবিত্তের মানুষদের। অন্যেরা যখন টাকা উপার্জনের জন্য ঢাকা-দিল্লি-ব্যাংকক করেছে, সেই সময়টায় আমি গ্রামে চলে গেছি। মফস্বলে চলে গেছি। দেখেছি তাদের জীবনকে, ঢুকে পড়েছি তাদের সমাজে। কাজেই আমি লিখব তো তাদের নিয়েই।

অভিজাতরা ব্যঙ্গ করে বলেছে, যাদের নিয়ে লেখেন, তারা তো আর আপনার লেখা পড়তে পারে না। তাহলে লিখে কী লাভ? আমি বলেছি, আপনারা যে ফুল-পাখি নিয়ে লেখেন, সেগুলো কি ফুলপাখিরা পড়তে পারে?

ওপরে চকচকে ভেতরে ফাঁপা অভিজাত লেখকদের মুখ বন্ধ হয়ে যায়। ফুল-পাখি নিয়ে লেখা গদ্য-পদ্য ফুল-পাখি পড়ে না। কিন্তু যারা পড়েন, তারা ফুলের দিকে পাখির দিকে নতুন দৃষ্টিতে তাকাতে শেখেন। এটাই সাহিত্যের প্রায়োগিক দিক। সেই রকম আমি যখন নিরক্ষর, প্রান্তিক, নিরন্তর ও ক্লান্তিহীন জীবনসংগ্রামে মগ্নদের নিয়ে লিখি, তারা পড়তে না পারলেও যারা পড়েন, তারা সেইসব মানুষের দিকে নতুন দৃষ্টিতে তাকাতে চাইবেন। যদি আমি ঠিকমতো এবং শিল্পসম্মতভাবে লিখতে পারি।

বাংলাদেশের এই লেখক-কবিরা কয় প্রজন্মের ধনী? খোঁজ নিলে দেখা যাবে প্রায় সকলের বাপই ইন্ডেন্টিং, আদমব্যবসা, গার্মেন্ট ব্যবসা দিয়ে পয়সাঅলা হয়েছে। আর আছে সরকারি চাকুরির ঘুষ, এবং এনজিও-ব্যবসা। সর্বোপরি রাজনীতি-ব্যবসা। ইহারা অভিজাত নহে। থর্নটন ওয়াইল্ডের ভাষায়, ইতর অভিজাত।

তারা সত্যিকারের লেখক বা সত্যিকারের অভিজাত হলে তাদের লেখায় আমরা তথাকথিত উচ্চবিত্ত শ্রেণির জীবন আর মননের পুঁজগুলো দেখতে পেতাম। তাদের সত্যজীবন দেখতে পেতাম। যেমনটি পেয়েছি বালজাকের লেখায়।

লেখক: কথাসাহিত্যিক