রক্তমাখা চাঁদের আলো অথবা নিজের কথা

পর্ব ৪

জাকির তালুকদার

প্রকাশিত : এপ্রিল ২৭, ২০১৯

চীনাদের মধ্যে একটা প্রবাদ চালু আছে। “তুমি কোনো বৃদ্ধকে থাপ্পড় মারতে পারো। কারণ সে কী তা তুমি জানো। কিন্তু কোনো শিশুকে থাপ্পড় মেরো না। কারণ সে বড় হয়ে কী হবে তা তুমি জানো না।”

আমাদের সাহিত্যজগতে শিশুদেরই, মানে নতুন লেখককে, সবচেয়ে বেশি থাপ্পড় খেতে হয়, প্রচুর গ্লানির মধ্য দিয়ে যেতে হয়। আমার সাহিত্য-শৈশব গ্লানি, অবজ্ঞা আর অপমানে পরিপূর্ণ। সেসব মনে পড়লে মাঝে মাঝে আত্মহত্যা করার ইচ্ছা পর্যন্ত হয়। কিন্তু প্রতিজ্ঞা করেছিলাম, আত্মহত্যা নয়, আত্মমর্যাদা নিয়েই মাথা উঁচু করে বাঁচব। সকল গ্লানির উত্তর দেবে আমার রচনা।

পুরোপুরি কথাসাহিত্যে মনোনিবেশ করার সময় আমার সামনে কয়েকজন যুবকের দাপট। মামুন হুসাইন, শাহাদুজ্জামান, মহীবুল আজিজ, ইমতিয়ার শামীম। তারা সত্যিই প্রতিভাবান লেখক। হাসান আজিজুল হক সব জায়গায় বলছেন মামুন হুসাইনের কথা। কখনো কখনো ইমতিয়ার শামীমের কথা। আখতারুজ্জামান ইলিয়াস বলেন মামুন ভাইয়ের পাশাপাশি শাহাদুজ্জামান, মহীবুল আজিজের কথা। আমার কথা বলার প্রশ্নই আসে না। তখন ব্যক্তি-পরিচয় থাকলেও আমার গল্প তো তাদের নজরে আসেনি।

আর কোনো বড় লেখককে তো চিনি না। অনেকেই লেখক-কবি হবার জন্য শিক্ষাজীবন শেষে ঢাকায় হিজরত করেন। সেখানে কোনো বড় বা খ্যাতিমান লেখক-কবির সাগরেদি করেন। তাদের গুণকীর্তন করা থেকে ফাই-ফরমাশ খাটা— সবই করেন তারা তথাকথিত ‘লিফট’ পাওয়ার জন্য। কেউ কেউ পেয়ে যান। পত্রিকা অফিসগুলোতে ঘুরে ঘুরে সম্পাদকদের সাথে পরিচিত হন। খাতির জমান। অভিভাবকের সুপারিশে মিডিয়াতে ঢোকেন। কেউ কেউ ঢোকেন সাহিত্যের কর্তৃত্ত্বকারী প্রতিষ্ঠানগুলোতেও। সেইসব প্রতিষ্ঠানে চাকরি করা মানেই অটোমেটিক বড় লেখক হিসেবে প্রতিষ্ঠা পেয়ে যাওয়া। লেখার মান যে রকমই হোক।

আমার পক্ষে সেই চিন্তা করাও সম্ভব নয়। প্রথমত ব্যক্তিত্বটা তেমন কাজের উপযোগী নয়। দ্বিতীয়ত চাকরি করি দূর মফস্বলে। ন’মাসে ছ’মাসে ঢাকায় যাওয়া হয় এক বা দুইদিনের জন্য। যেটুকু সময় পাই, নিউ মার্কেট, আজিজ মার্কেট থেকে বই আর লিটল ম্যাগাজিন কিনি পকেটের সাধ্য অনুযায়ী। তারপর ফিরে আসি কর্মস্থলে। অতএব কঠিন সাধনার কোনো বিকল্প নেই আমার কাছে। দিনে একশো-দেড়শো রোগী দেখতে হয় আউটডোরে। তবে সুবিধা এটাই যে বিকালে কোনো চাপ থাকে না। ঘুরে বেড়াই এই গ্রামে সেই গ্রামে। উপজেলা পর্যায়ে তখন অফিসারদের ক্লাব হয়েছে। সেখানে তাস-পাশা খেলা, খাওয়া-দাওয়া, আড্ডা হয় অফিসারদের। একদিন বা দুইদিন গেছি। আর যেতে ইচ্ছা করেনি। মন ভরে মিশেছি গ্রামের রাজনীতিবিদ, চৌকিদার, চোরাচালানি, পেশাদার চোর, কৃষক, ক্ষেতমজুর, ভ্যানচালক, বেকার, গায়েন, বাউল, গ্রামবেশ্যা, মসজিদের খাদেম, মন্দিরের সেবায়েত-- সবার সাথে। শুধু গল্প শোনা নয়, তাদের জীবনেও প্রবেশাধিকার পেয়েছি।

আর লেখা এবং পড়ার জন্য প্রতিটি দিন এবং রাত মিলিয়ে বরাদ্দ ছিল কমপক্ষে আট ঘণ্টা। অবিশ্বাস্য মনে হতে পারে। কিন্তু সেটাই করেছি আমি একটানা কুড়ি-বাইশ বছর। এখনো করি। তাই অন্যদের মতো আমার পক্ষে লেখক-কবিদের আড্ডায় সময় কাটানো বেশি সম্ভব হয় না। সাহিত্যের অনুষ্ঠানগুলোতেও যাওয়া হয় তুলনামূলক কম।

বগুড়া থেকে সরকার আশরাফ প্রকাশ করতেন উঁচুমানের পত্রিকা ‘নিসর্গ’। তিনি হাত বাড়িয়ে দিলেন। পরের পর সংখ্যায় ছাপলেন আমার গল্প ‘সোলেমান পয়গম্বরের দেয়াল’, ‘দাস পরম্পরা’। পত্রিকাটিতে পশ্চিমবঙ্গের অনেকে লিখতেন। তাই পশ্চিমবঙ্গেও যেত। এবং সেখানে সিরিয়াস লেখক-পাঠকদের কাছে গৃহীত হয়েছিল। ‘দাস পরম্পরা’ নজরে পড়ে একজন প্রকাশকের। তারা তিন খণ্ডে বাংলাদেশের গল্প প্রকাশের উদ্যোগ নিয়েছিলেন। ‘দাস পরম্পরা’ গল্পটি নিতে চাইলেন। সেকথা জানার পরে আমার আনন্দ হওয়াটাই স্বাভাবিক। প্রকাশক তাদের সম্পাদককে লেখক তালিকা দিয়ে বাংলাদেশে পাঠিয়েছিলেন। সম্পাদকও বাংলাদেশেরই মানুষ। কলকাতায় লেখাপড়া করতে গিয়ে সেখানেই সেটল করেছেন। গৌরাঙ্গ মণ্ডল। আমার পূর্ব-পরিচিত। দেশে থাকতে ঘনিষ্টতাও ছিল। তো তিনি যখন তালিকা নিয়ে হাসান আজিজুল হকের সাথে দেখা করলেন, হাসান স্যার তাকে বলেছিলেন জাকিরকে বাদ দাও। তাকে তো বাংলাদেশের প্রতিনিধিত্বশীল লেখক বলা যাবে না। একথা শুনে আঁতুরঘরে বালিশচাপা দিয়ে কোনো শিশুকে হত্যা করার সময় শিশুটির যে অনুভূতি হয়, সেই একই রকম অনুভূতি হয়েছিল আমার।

পরে ভেবে দেখেছি, হাসান আজিজুল হক অন্যায় কিছু বলেননি। তখন পর্যন্ত আমার গল্প ছাপা হয়েছে মাত্র ৫টি বা ৬টি। বাংলাদেশের কথাসাহিত্যের প্রতিনিধিত্ব করতে পারেন যারা, এত অল্পে তাদের তালিকায় আমার নাম ওঠার কথা নয়।

লেখক: কথাসাহিত্যিক