
রক্তমাখা চাঁদের আলো অথবা নিজের কথা
পর্ব ৫
জাকির তালুকদারপ্রকাশিত : এপ্রিল ২৮, ২০১৯
এসবের অনেক আগেই আমার হাজতবাস এবং হুলিয়া মাথায় নিয়ে পালিয়ে বেড়ানোর অভিজ্ঞতা হয়ে গেছে। হাজতবাস যে দীর্ঘায়িত হয়নি, তার পেছনে ছিল সেই সময়ের এসপি মোস্তাফিজুর রহমানের অবদান। কী এক অজ্ঞাত কারণে তিনি আমাকে ও আমাদের পুরো ব্যাচটাকে পছন্দ করতেন।
আমরা তখন বিশাল একটা ব্যাচ। দর্শনীর বিনিময়ে কবিতা পাঠের আসর করি, শহরের মোড়ে মোড়ে গণসঙ্গীত আর পথনাটক করি, পত্রিকা বের করি, চিত্র প্রদর্শনী-ভাস্কর্য প্রদর্শনীর আয়োজন করি, আবৃত্তি-নাটকের ওয়ার্কসপ করি। এইসবের পাশাপাশি আমরা এমন কিছু কাজ করতাম যেগুলো সচরাচর সংস্কৃতি জগতের লোকেরা করে না। ন্যায্যমূল্যের চিনি ব্ল্যাক হয়ে যাচ্ছে শুনলে আমরা সেই চিনির ট্রাক আটকে দিতাম। বন্ধুর বোনকে রাস্তায় জ্বালাতন করায় জাতীয় পার্টির সবচাইতে দুর্ধর্ষ ক্যাডারকে পিটিয়েছিলাম। এরশাদের দালালদেরকে নানাভাবে হেনস্থা করতাম।
ওরা আমাকে বাগে পেয়েছিল এরশাদ রাষ্ট্রধর্ম বিল পাশ করার পরে। খুব কড়া একটা লেখা লিখেছিলাম। সঙ্গে সঙ্গে জাতীয় পার্টি আর জামায়াতে ইসলামী মুমিনদেরকে সংগঠিত করে রাস্তায় মিছিল বের করল আমার বিরুদ্ধে। জনসভা করে মুরতাদ ঘোষণা করল আমাকে। বাড়িতে হামলা চালিয়ে আমাকে না পেয়ে অপমান করল আব্বাকে।
লেখাটি কেউ পড়ার সুযোগ পায়নি। কারণ সব পত্রিকা গায়েব করে দিয়েছিল তারা। বাংলাদেশের মোমিনদের শুধু এটুকু বলাই যথেষ্ট যে, অমুক ইসলামের অবমাননা করেছে। তাহলেই তারা ফাঁসির দাবি নিয়ে ছুটবে।
সেই কারণেই হাজত। ডিসি অর্ডার দিয়ে রেখেছে একমাসের ডিটেনশন। কিন্তু এসপি মোস্তাফিজুর রহমান সাহেব আমাকে ছেড়ে দিয়ে বললেন, আজকের মধ্যে শহর ছাড়বে। সকালে তোমাকে পেলে অ্যারেস্ট না করে উপায় থাকবে না। ওপরের চাপ বেশিক্ষণ আমি সামাল দিতে পারব না।
অতএব আমাকে সরে পড়তে হলো। পরবর্তী একটা মাস যে কত অপরিচিত মানুষের বাড়িতে থেকেছি, কত বাড়িতে খেয়েছি তা হিসাব করা মুশকিল। কী অসাধারণ মমতার সাথে তারা আমাকে আগলে রেখেছেন, যত্ন-আত্তি করেছেন, চলে আসার সময় হাতে টাকা গুঁজে দিয়েছেন। পরিস্থিতি থিতিয়ে পড়ার পর এলাকায় ফিরলাম। কিন্তু মামলাটা কাঁধের ওপর ছিলই এরশাদের পতন হওয়া পর্যন্ত।
সময় আমাকে কত রকম অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে যে নিয়ে গেছে! আর নিজের উপলব্ধি হচ্ছে, লেখকের জন্য কোনো অভিজ্ঞতাই অকাজের নয়। সে অভিজ্ঞতা মধুরতমই হোক, আর চরম তিক্তই হোক। লেখকের কোন লেখায় যে অভিজ্ঞতাটি অবদান রাখবে তা লেখক নিজেও জানেন না।
আমার প্রথম গল্পগ্রন্থ ‘স্বপ্নযাত্রা কিংবা উদ্বাস্তুপুরাণ’ বের হয়েছিল নিসর্গ পত্রিকারই ব্যানারে। সরকার আশরাফ ব্যাপক পরিশ্রম করেছিলেন। বলা চলে, তার একক পরিশ্রমেরই ফসল সেই বই। তবে তিনি বিপণনের ব্যাপারে ছিলেন নিতান্তই অনিচ্ছুক। হয়তো ব্যাপারটি তার কাছে তেমন গুরুত্বপূর্ণও ছিল না। আমি আবার নিজের বই হাতে নিয়ে কোথাও যাওয়ার ব্যাপারে চরম লাজুক। বিদ্যাপ্রকাশের খোকা ভাইয়ের বদান্যতায় বইমেলাতে তার আরেকটি স্টলে প্রদর্শিত হয়েছিল বইটি। আর বাকি ভূমিকা রহমান হেনরী, মারুফ রেজা বায়রন এবং বদরে মুনীরের। তারাই বইটাকে আজিজ মার্কেটের সব দোকানে দোকানে গুঁজে দিয়েছিল। বিক্রি হয়েছে কি না সেই খোঁজ কোনোদিনই নেয়া হয়নি। লজ্জাতেই নিইনি। কারণ যদি শুনতে হয় যে, সেই বইটা কেউ-ই স্পর্শই করেনি। আমার মতো অখ্যাত লেখকের বই যে তারা স্টলে রেখেছেন, এটাই আমার কাছে ছিল অনেক।
ডাকযোগে এবং লোক মারফত পাঠানো হয়েছিল অন্তত পঞ্চাশজন বড়-মাঝারি লেখকের কাছে। কেউ পৃষ্ঠা উল্টে দেখেছিলেন কি না জানি না। তবে তিনজনের কথা জানি, যারা বইটা পড়েছিলেন। প্রথম জন ইমতিয়ার শামীম। তিনি জনকণ্ঠের সাহিত্য সাময়িকীতে বইটা নিয়ে একটি আলোচনা লিখেছিলেন। দ্বিতীয় জন সুশান্ত মজুমদার। তিনি সেই সময়ের সর্বাধিক প্রচারিত দৈনিক ভোরের কাগজ সাময়িকীতে বইয়ের সালতামামি লিখেছিলেন। সেখানে সেই বছরের সবচাইতে প্রতিশ্রুতিবান সম্ভাবনাময় বই হিসেবে দুইটি বইকে চিহ্নিত করেছিলেন। একটি আকমল হোসেন নিপুর ‘জলদাসের মৎস্যঘ্রাণ’, অপরটি আমার গল্পগ্রন্থ।
আর তৃতীয় জনের ব্যাপারটি ছিল আমার কল্পনার বইরে। রবীন আহসানের প্ররোচনায় আহমদ ছফাকে বইটি দিয়ে এলাম তার উত্থানপর্বের ঘরে। সেটি আজিজ মার্কেটেই ছিল। মাঝখানের সিঁড়ি দিয়ে দোতলায় উঠে ডাইনে মোড় নিয়ে প্রথম যে ঘরটি আছে সেটাই ছিল ছফা ভাইয়ের ঘর। আমি বইটা তার টেবিলে রেখে উধাও। দুই-তিনদিন পরে শুনলাম ছফা ভাই আমাকে খুঁজছেন। গেলাম ভয়ে ভয়ে। ছফা ভাই ধমকের সুরে বললেন, বইটা রেখে চলে গেছো, তারপরে আর পাত্তা নাই কেন?
আমার মুখে উত্তর জোগায় না। উনি বললেন, বসো। চা-সিগারেট খাও। আমি না না করছিলাম। ছফা ভাই বললেন, খাও খাও, এত সুন্দর গল্পগুলি লিখেছ, একটু চা তো খেতেই হবে। শোনো, আমি বইটা নিয়ে বাসায় গেলাম। রাত নয়টায় পড়তে শুরু করলাম। ভোর চারটায় দশটা গল্পই পড়া শেষ হলো। এক সিটিং-এ দশটা গল্প অনেকদিন পড়িনি। তোমার গল্পের প্রধান যে বৈশিষ্ট্য তা হচ্ছে সততা। যে মানুষদের নিয়ে লিখেছ, তাদের তুমি সত্যি সত্যি চিনেই লিখেছ। আর বইটাতে একঘেয়েমিত্ব নাই। তোমার দশটা গল্প দশ রকমভাবে লেখা। যে গল্প যে ভাষায় লেখা দরকার, তুমি ঠিক সেই ভাষায় লিখেছ।
প্রথম বইয়ের জনক আর কী চাইতে পারে!