
রক্তমাখা চাঁদের আলো অথবা নিজের কথা
পর্ব ৬
জাকির তালুকদারপ্রকাশিত : এপ্রিল ২৯, ২০১৯
মোহাম্মদ রফিকের একক কবিতা পাঠের আয়োজন করা হয়েছিল কলকাতায় প্রতিক্ষণ দপ্তরে। সন্দীপন চট্টোপাধ্যায় ঢুকলেন। জানতে চাইলেন, এখেনে হচ্চেটা কী? দেবেশ রায় উত্তর দিলেন, বাংলাদেশের বিশিষ্ট কবি মোহাম্মদ রফিকের কবিতা শুনছি আমরা। সন্দীপন বললেন, যে দেশের প্রধান কবি চামচু, সেই দেশের কবির কবিতা আবার শোনার কী দরকার! (চামচু মানে শামসুর রাহমান)।
সত্তরের দশকে শওকত ওসমানকে সঙ্গে করে বইয়ের দোকানগুলো ঘুরতে গিয়ে আহমদ ছফা বললেন, দ্যাখেন, কোনো দোকানে আপনার একটা বই পর্যন্ত নেই। সব ভারতীয় লেখকের বই। এই দেশটা কি বাল ছিঁড়তে স্বাধীন করেছি আমরা?
পশ্চিমবঙ্গের সাথে আমাদের দেশের লেখক-কবিদের সম্পর্কটা পরিষ্কার নয়। দ্বন্দ্ব-মিলনে জটিল। কারণও অনেক। দেশভাগের পরে সাহিত্য ও প্রকাশনার সবকিছুই ছিল কলকাতায়। ঢাকাকে সব শুরু করতে হয়েছে শূন্য থেকে। ঢাকার বইয়ের দোকানগুলো যে কলকাতার বই দিয়েই ভরা থাকবে, সেটাই স্বাভাবিক ছিল। কারণ, পাঠক তো কলকাতার লেখকদেরই চেনে। তখন কলকাতার মতো এত সংখ্যক ভালো লেখক-কবি বাংলাদেশে ছিলও না। বাংলাদেশের কোনো লেখক-কবিকে সামনে তুলে ধরার মতো কোনো প্রক্রিয়াও তখন পর্যন্ত শুরু করা যায়নি। অল্প কিছু ব্যতিক্রম বাদে আমাদের সব কবি-সাহিত্যিকের চোখ ছিল কলকাতার পত্রিকার দিকে। লেখক-কবিরা তাকিয়ে থাকতেন কলকাতার স্বীকৃতির দিকে।
১৯৯৩ সালে নাটোরে আবিদ আজাদের শিল্পতরু প্রকাশনীর বইমেলা হয়েছিল তিনদিন। সেখানে আল মাহমুদ এসেছিলেন। দেখলাম, তিনি গাড়ি থেকে নামছেন হাতে পশ্চিমবঙ্গের একটি বিখ্যাত পত্রিকা নিয়ে। পত্রিকাটি আমি আগেই পড়েছিলাম। সেখানে আল মাহমুদ সম্পর্কে দুই-তিন লাইনের প্রশস্তি লেখা ছিল। তিনি সেই লাইনগুলো হলুদ মার্কারে চিহ্নিত করে পত্রিকা হাতে নিয়ে ঘুরছেন। তার সাথে অনেক গল্প, তর্ক-বিতর্ক হয়েছিল খোলামনে। একদিন তিনি উত্তেজিত হয়ে বললেন, শামসুর রাহমান আনন্দবাজারের পা চাটে, কলকাতার পা চাটে। আমি হেসে তার হাতে বয়ে নিয়ে চলা পত্রিকা দেখিয়ে বললাম, আপনি কার পা চাটছেন?
বাংলাদেশের সব লেখক-কবি তখন কলকাতার কাগজে লেখার জন্য উৎসাহী ছিলেন খুবই। ব্যতিক্রম বোধহয় হাসান হাফিজুর রহমান আর সৈয়দ শামসুল হক। কলকাতার কোনো কাগজে লেখা পাঠাতেন না তারা। আরো কয়েকজনের সাথে মিলে বাংলাদেশের সাহিত্য জগৎটাকে নির্মাণের দায়িত্ব নিয়েছিলেন কাঁধে তুলে।
বহুবছর লেগেছে বাংলাদেশের লেখক-কবিদের নিজেদের দেশে নিজেদের পাঠক গড়ে তুলতে। লাগারই কথা। আমেরিকা-অস্ট্রেলিয়া-কানাডার লেখকরা বছরের পর বছর ইংলণ্ডের স্বীকৃতির জন্য মাথা খুঁড়ে মরেছেন। টিএস ইলিয়ট ইংলন্ডে কল্কে পাওয়ার জন্য কত কিছুই না করেছেন। এমনকি নিজের ক্যাথলিকত্ব বিসর্জন দিয়ে প্রটেস্ট্যান্ট পর্যন্ত হয়েছেন। এখন আমেরিকান, অস্ট্রেলিয়ান কবি-লেখকরা নিজেদের জায়গা তৈরি করতে পেরেছেন।
শুধু শামসুর রাহমান, আল মাহমুদ নয়, বাংলাদেশের খ্যাতিমান লেখক-কবিদের মধ্যেও পশ্চিমবঙ্গমুখিনতা ব্যাপক। ড. আনিসুজ্জামান, হাসান আজিজুল হক, আবুবকর সিদ্দিক, নির্মলেন্দু গুণ, মহাদেব সাহা, মুহম্মদ নূরুল হুদা, অসীম সাহা, গোরাম মুরশিদ, সেলিনা হোসেনরা প্রচণ্ডভাবে পশ্চিমবঙ্গমুখিন। বেলাল চেীধুরী তো কলকাতা ছাড়া কিছু বুঝতেই চাইতেন না। শুনলে অবাক মনে হবে, এমনকী আবদুল মান্নান সৈয়দও কলকাতার দিকে তাকাতেন। ব্যতিক্রম বদরুদ্দিন উমর, সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী, শওকত আলি, আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ। সত্তরের লেখকদের মধ্যে মঈনুল আহসান সাবের কলকাতার ব্যাপারে কখনোই কোনো আগ্রহ দেখাননি। সবচেয়ে বেশি কলকাতামুখি হচ্ছে বাংলা একাডেমির নির্বাহীগণ আর বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের শিক্ষকরা।
আমার নিজের কথা বলি। পশ্চিমবঙ্গ নিয়ে আমার মোহ বা বিতৃষ্ণা কোনোটাই নেই। তবে আগে নিজের দেশ। নিজের দেশের সাহিত্যে যদি নিজেকে অপরিহার্য করে তোলা যায়, তাহলে অন্যদেশের লেখক এবং সিরিয়াস পাঠকরা তার দিকে কম-বেশি মনোযোগ দেবেনই। পশ্চিমবঙ্গের সাথে আমাদের যে ‘দেবে আর নেবে মিলিবে মেলাবে’-র সম্পর্ক তৈরি হবার দরকার ছিল তা হয়নি। বহুবিধ কারণ আছে। একটা হলো তাদের লেখক-প্রকাশকদের উন্নাসিকতা। বাংলাদেশের বাঙালরা আবার কী লিখবে! আরেকটি কারণ হচ্ছে, সত্যিসত্যিই পশ্চিমবঙ্গের লেখক-কবিরা অনেকদিন পর্যন্ত লেখা এবং চিন্তায় আমাদের চাইতে অগ্রগামী ছিলেন। এবং সেটি ঐতিহাসিক বাস্তব কারণেই। তৃতীয়ত তাদের প্রকাশক-পরিবেশকরা আমাদের দেশের লেখক-কবিদের সাথে পশ্চিমবঙ্গের পাঠকরা পরিচিত হোন, সেটি চাইতেন না। হয়তো সেখানকার বড় লেখকরাও চাইতেন না। তারা চাইতেন বাংলাদেশ তাদের সাহিত্যের উপনিবেশ হয়ে থাকুক।
এখন পরিস্থিতি পাল্টেছে। পশ্চিমবঙ্গের লেখক-কবিরা বাংলাদেশের সাহিত্যের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হয়েছেন। বাংলাদেশের লেখক-কবিরা যোগ্যতা দিয়েই তা অর্জন করেছেন। দুই দেশের মধ্যে সাহিত্যচিন্তার বিনিময় এখন রোজকার বিষয়। সারাবছর কলকাতার লেখক-কবিরা আসছেন বাংলাদেশের রাজধানী-মফস্বলের অনুষ্ঠানে। একুশের বইমেলাতে দলে দলে আসেন সেখানকার সাহিত্যিকরা। ফলে মতবিনিময় এখন অনেক সহজ। কলকাতার সাহিত্যকে এখন হিন্দির আগ্রাসন মোকাবেলা করতে হচ্ছে। বাংলাদেশের পাঠকরা তাদের পাশে না দাঁড়ালে পুরো বাংলাসাহিত্যই ক্ষতিগ্রস্ত হবে।
বাঙালি জাতির একমাত্র স্বাধীন রাষ্ট্র হিসাবে বাংলা সম্পর্কিত সবকিছুর দায়িত্ব প্রধানত পালন করতে হবে এই দেশের মানুষকেই। রাষ্ট্র পরিচালনায় যারা আছেন, তারা এই ভাবনাটা কতখানি ভাবেন জানি না। তবে বাঙালিত্বের স্বার্থে এই দেশের মানুষরা নিজেরাই এগিয়ে আসছেন। পশ্চিমবঙ্গের অনেক লেখক-সম্পাদক, যারা বাংলাদেশের সাথে ঘনিষ্টভাবে পরিচিত হয়েছেন, তাদের বলতে শুনি-- বাংলাদেশের সরকার আর বাংলাদেশের মানুষ এক নয়। বাংলাদেশের মানুষ সম্পর্কে জানলে তাদের শ্রদ্ধা না করে উপায় নেই। কথাটা দুই বাংলার সাধারণ মানুষ সম্পর্কেই সত্যি।
লেখক: কথাসাহিত্যিক