রক্তমাখা চাঁদের আলো অথবা নিজের কথা

পর্ব ৭

জাকির তালুকদার

প্রকাশিত : এপ্রিল ৩০, ২০১৯

সৃজনশীল লেখকের পক্ষে কি রুটিন মেনে চলা সম্ভব? ঠিক সময়ে খাওয়া, ঘুমানো, ব্যায়াম করা, সংসার দেখা, পেশা চালিয়ে যাওয়া, রুটিনমাফিক প্রেমিকার সাথে ডেট করা? সকালে অফিস করতে হবে, তাই লেখাটিকে অসমাপ্ত রেখে শুয়ে পড়া বা যা পড়ছি অখণ্ড মনোযোগের সাথে, সেটাকে মুড়ে রাখা কি সম্ভব? ছাপোষা জীবনযাপন কি সম্ভব?

লেখাকে সর্বস্ব হিসাবে গ্রহণ করেছেন যিনি তার পক্ষে কি শারীরিকভাবে পরিপূর্ণ সুস্থ থাকা সম্ভব? কাঁধে ব্যথা, কোমরে ব্যথা, চোখে ক্লান্তি, লেখার আঙুল ফুলে ওঠা, অপর্যাপ্ত ঘুমের কারণে শরীর ম্যাজম্যাজ করা তো তার সবসময়ের সঙ্গী। সেইসাথে যোগ হয় বড় বড় রোগও। পেশাগত উন্নতি বা সাফল্য কি সম্ভব?

আমাদের সময়ের তিনজন বড় লেখককে আমি জানি যারা লেখালেখির পাশাপাশি পেশাগত সাফল্যও অর্জন করেছেন। মামুন হুসাইন, শাহাদুজ্জামান। অপরজনের নাম শুনলে অনেকেই অবাক হবেন। তিনি শহীদুল জহির। শহীদুল জহির বরাবর চাকরিতে ঠিক সময়ে প্রমোশন পেয়েছেন। অকালমৃত্যুর সময় তিনি ছিলেন অতিরিক্ত সচিব। তার ব্যাচের খুব কমজনই সেই ধাপে উঠতে পেরেছিলেন।

আমার পক্ষে সম্ভব হয়নি। তবে পরিবারের প্রতি দায়িত্ব আমি ঠিকই পালন করে গেছি। তার জন্য যে বিপুল কষ্ট এবং বাড়তি পরিশ্রম আমাকে করতে হয়েছে, শরীরে ও মনে যত বাড়তি চাপ নিতে হয়েছে, সেসব বছরের কথা ভাবলে এখন শিউরে উঠি।

বছরের পর বছর সেই অমানুষিক পরিশ্রমের মূল্য দিতে হয়েছে ঠিকই। কঠিন এবং অনারোগ্য রোগে আক্রান্ত হয়ে পড়লাম। দেখা গেল, কোনো নোটিশ ছাড়াই, কোনো পূর্ব ঘটনা ছাড়াই অজ্ঞান হয়ে পড়ে যাচ্ছি মাটিতে। প্রথমে এই অজ্ঞান হবার ঘটনা ঘটছিল অনেকদিন পর পর। ক্রমে সময়ের ব্যবধান কমতে থাকল। অজ্ঞান হচ্ছি ঘন ঘন। আর মধ্যবর্তী সবসময় মাথাঘোরা। নিজের মেডিক্যাল জ্ঞানে কুলাচ্ছিল না। দ্বারস্থ হলাম অন্যদের। ডাক্তার হিসাবে সবার কাছেই সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার পেয়েছি চিকিৎসার জন্য। নিউরো, ইএনটি, মেডিসিন, ফিজিক্যাল মেডিসিন, চক্ষু— সব বিভাগের ডাক্তারদের কাছে গেছি। তারা সবাই পর্যাপ্ত সময় এবং মনোযোগ দিয়ে রোগ নির্ণয়ের চেষ্টা করেছেন। এমনকী একসাথে বসে ক্লিনিক্যাল মিটিং-ও করেছেন আমাকে নিয়ে। ওষুধ দিয়েছেন। কিন্তু কোনো উপকার হয়নি।

কী যে অসহায় লাগত তখন! দাঁড়িয়ে আছি। হঠাৎ অনুভব করলাম পায়ের নিচের মাটি সাঁৎ করে আকাশে উঠে গেল। আর আমি চোখে কিছু দেখতে পাচ্ছি না। হাত বাড়িয়ে যা ধরতে পারছি, সেটাই ধরে নিজের পতন ঠেকানোর জন্য প্রাণপণ চেষ্টা করছি।

সুচন্দন সঙ্গে নিয়ে গেল কলকাতায়। সুচন্দন। ভাই আমার। কলকাতা হাইকোর্টের ল ফার্মের আইনজীবী। দুই সপ্তাহের মধ্যে এক মুহূর্তের জন্যেও আমার কাছছাড়া হয়নি। দুই সপ্তাহের মধ্যে একবারের জন্যও কোর্টে যায়নি আমাকে ছেড়ে। কারণ আমি তো একা একা চলাফেরার সাহস পাই না। পথে কখন অজ্ঞান হয়ে যাব জানি না।

কলকাতায় এ-ডাক্তার সে-ডাক্তার। সেখানকার ডাক্তাররাও আমাকে খুব সম্মান এবং মনোযোগের সাথে দেখেছেন। আমি ডাক্তার জেনে সিরিয়াল ছাড়াই যখন-তখন প্রবেশাধিকার দিয়েছেন। কিন্তু কাজের কাজ তো কিছু হলো না। রোগ নির্ণয় সম্ভব হলো না। আসলে ডাক্তারদের দোষ নেই। যে রোগ লাখে একজনের হয়, সেই রোগের কথা মনে থাকে না তাদের।

আমার ভেতরে তখন দুটি জিনিস কাজ করছে। প্রথমত আমার এই ধরনের রোগ নিয়ে ব্যাপক পড়াশোনা করছি। নিজে নির্ধারণের চেষ্টা করছি রোগের ক্লু। সম্ভবত বিশেষজ্ঞদের চাইতে অনেক বেশি পড়ে ফেলেছি এই বিষয়ে। আর দ্বিতীয় যে চিন্তাটি কাজ করছিল তা হচ্ছে, সম্ভবত আমি আর কখনোই সুস্থ হবো না। অথবা বেশিদিন বাঁচব না। তাই লেখালেখি বাড়িয়ে দিয়েছিলাম অনেক বেশি। মৃত্যু অথবা অথর্বতা আসার আগে যতদূর পারি লিখে যাব।

সেই রোগ নিয়ে পড়তে পড়তে মনে হলো একটি ডায়াগনসিসের কাছাকাছি এসে পৌঁছেছি। যোগাযোগ করলাম সিঙ্গাপুরের ওটোনিউরোলজিস্টের সাথে। স্পেশাল বিশেষজ্ঞ। কানের নিউরোলজি হচ্ছে তাদের স্পেশালিটি। তার পরামর্শমতো পরীক্ষা। ধরা পড়ল রোগ। খুবই বিরল। কেন্দ্রিয় স্নায়ুতন্ত্রের অষ্টম স্নায়ুর নাম ভেস্টিবিউলার-ককলিয়ার নার্ভ। দুইটি অংশ। ককলিয়ার পার্টটার কাজ হচ্ছে শ্রবণ নিয়ন্ত্রণ। অর্থাৎ শ্রবণ ক্ষমতার সাথে এটি যুক্ত। আর ভেস্টিবিউলার পার্টের কাজ হচ্ছে শরীরের ভারসাম্য রক্ষায় সাহায্য করা। আমার ডানদিকের ভেস্টিবিউলার পার্ট প্যারালাইজড। তখন যে পরিস্থিতি ছিল, তাতে অপারেশন করলে সুস্থ হবার সম্ভাবনা আধাআধি। খরচ ২০০৪ সালের হিসাবে ৯ লক্ষ টাকা। সেই টাকা আমার ছিল না। স্ত্রী রোশনি আর পিঠাপিঠি বোন মহুয়া মনঃকষ্টে কাটা মুরগির মতো তড়পাচ্ছে। আমিই সান্ত্বনা দিলাম, ভালো হবার সম্ভাবনা যেখানে মাত্র ফিফটি ফিফটি, সেখানে এতগুলো টাকা খরচ করে পুরো পরিবারের ভবিষ্যৎকে অনিশ্চয়তার মধ্যে ফেলার কোনো মানে হয় না।

চাকরি করার মতো শারীরিক অবস্থা তখন আর নেই। ছেড়ে দিলাম। সিঙ্গাপুরের ডাক্তারও অপারেশনের জন্য জোরাজুরি করলেন না। ওষুধ আর ব্যায়াম দিলেন। সেইসাথে কিছু নিয়ম। তারমধ্যে একটি হচ্ছে, একটানা বেশিক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকা চলবে না। আমি যে এখনো কোনো অনুষ্ঠানে বক্তৃতা করতে উঠলে ২০ মিনিটের বেশি বলি না, সে ওই কারণেই। ক্লাস নিতে গেলেও একই সময় মেনে চলি।

অপর একটি উপদেশ হচ্ছে, শরীর এবং মনের ওপর একটানা অতিরিক্ত চাপ নেয়া চলবে না। এটা মানা সবসময় সম্ভব হয় না। কখনো কখনো বাড়তি চাপ নিতেই হয়। বিশেষ করে বাইরে গেলে। তখন তিন-চারদিন যে অনিয়ম হয়, বাড়িতে ফিরে পরবর্তী এক সপ্তাহ ধরে তার মাশুল দিতে হয়। এই একটা কারণে অনেক সময় প্রতিশ্রুতি দিয়েও আমার পক্ষে অনেক অনুষ্ঠানে বা অনেক শহরে যাওয়া হয়ে ওঠে না। কারণ মাথাঘোরাটা হঠাৎ হঠাৎ বেড়ে যায়।

কোনো অনুষ্ঠানে আমন্ত্রণ পেলে আমি স্বভাববিরুদ্ধ কিছু আব্দার করি। যেমন আমাকে আনা-নেয়ার ব্যবস্থাটা যেন আরামদায়ক হয়, আমাকে যেন দুপুরে বিশ্রাম নেবার সুযোগ দেয়া হয়, আর আমার কর্মসূচি যেন খুব ঠাসা না হয়।

উপদেশের মধ্যে আছে বেশিক্ষণ ফোনে কথা না বলা। কানে হেডফোন লাগিয়ে গান শোনা তো যাবেই না। আর আছে এক্সট্রিম ওয়েদার, মানে তীব্র গরম আর তীব্র ঠাণ্ডা এড়িয়ে চলা। এই অবস্থার মধ্যেও আমি একটানা চার মাস লিখে ‘মুসলমানমঙ্গল’ শেষ করেছি। ছয় বছর ধরে ‘পিতৃগণ’ লিখেছি। এই উপন্যাসটি লেখার জন্য হাজার মাইল হাঁটতে হয়েছে আমাকে। বই, পত্রিকার জন্য যেতে হয়েছে দূর-দূরান্তরে। কোনো কোনো দুষ্প্রাপ্য বই বা দলিল ফটোকপি করার জন্য ছুটতে হয়েছে ঢাকা-রাজশাহী-ময়মনসিংহ-রংপুর-কলকাতায়। কথা বলতে হয়েছে শত শত মানুষের সাথে। কিন্তু আমি পেরেছি।

এমন অসুখ সত্ত্বেও নিজেকে আমি ভাগ্যবানই মনে করি। ধরেই নিয়েছিলাম অন্যের সাহায্য ছাড়া বাকি জীবন আমি বোধহয় চলাফেরা করতে পারব না। অথচ পারি। দেশ-বিদেশে একাই চলাফেরা করি। আর লেখালেখি থেকে একদিনের জন্যও দূরে থাকতে হয়নি। আমার বন্ধুরা বলে, মনের জোর। কিছুটা তো বটেই।

অসুখ সঙ্গী হয়ে আছে। পোষ মানিয়ে রেখেছি ওষুধ এবং ব্যায়ামের মাধ্যমে। হয়তো একসময় এটা আমার নিয়ন্ত্রণে থাকবে না। তবে সেই ভবিষ্যতের ভীতি নিয়ে জুবুথুবু হয়ে দিন কাটাতে রাজি নই। কিন্তু উপার্জন তো করতেই হবে। ছোট ভাইবোনদের লেখাপড়া তখনো শেষ হয়নি। আর সন্তানের শিক্ষাজীবনের মাত্র শুরু। এদের প্রতি দায়িত্ব-পালন শেষ করার আগে আমার তো মরাও চলবে না। চাকরি ছাড়ার পরে নিজের শহরে প্রাইভেট প্র্যাকটিসে বসলাম। একেবারে শাপে-বর। লেখার জন্য, চিন্তা করার জন্য, মানুষের সাথে সম্পৃক্ত থাকার জন্য এত সুযোগ আমি আগে পাইনি। তার সাথে এলো স্বচ্ছলতাও। চাকরিতে অনেক টাকা বেতন পেতাম। কিন্তু টাকায় টানাটানি হতোই। কিন্তু প্র্যাকটিসে বসার পরে, সাধ্যমতো মানবিক ডাক্তারি করেও, সেই অর্থনৈতিক টানাটানি চলে গেছে।

প্রধান কারণ হয়তো, খরচ কমে গেছে অনেক। বিশেষ করে বাড়িভাড়া এবং অফিস যাতায়াতের খরচা তো পুরোপুরিই বেঁচে যায়। ঢাকাতে পাঁচজন বন্ধু নিয়ে কোনো সাধারণ রেস্টুরেন্টে বসলেও পাঁচশো টাকা খরচ হয়ে যায়। মদন-সাইফুলের দোকানে দশজন বসলেও খরচ একশো টাকা পার হয় খুব কম। সবচেয়ে বড় কথা, ঢাকার চাকরিজীবনের চেয়ে আমি প্রতিদিন অন্তত চার ঘণ্টা সময় বেশি পাই। লেখার, পড়ার, এবং অলসতার। চলবে

লেখক: কথাসাহিত্যিক