
রক্তমাখা চাঁদের আলো অথবা নিজের কথা
পর্ব ৮
জাকির তালুকদারপ্রকাশিত : মে ০১, ২০১৯
আহমদ ছফা কি ভারতবিদ্বেষী ছিলেন? আমি দ্বিধাহীনভাবেই বলব, তিনি কিছুটা ভারতবিদ্বেষী ছিলেন। কতটা? বাংলাদেশের একজন দেশপ্রেমিক নাগরিকের যতখানি ভারতবিদ্বেষী হওয়া উচিত, তিনি ছিলেন ততটাই। ভারত রাষ্ট্রের কিছু বাংলাদেশবিরোধী পদক্ষেপ, ভারতীয় করপোরেট, ভারতীয় সাহিত্যজগতের করপোরেটদের বিরুদ্ধে ছিল তার অবস্থান। ভারতের শোষিত মানুষ এবং তাদের দল বা গোষ্ঠীগুলোর প্রতি তাঁর ছিল নিঃশর্ত সহমর্মিতা।
কিন্তু আহমদ ছফার চিন্তার কেন্দ্রে ছিল বাংলাদেশ। দেশপ্রেম। জানতেন, বিপ্লব ছাড়া বাংলাদেশের মানুষের মুক্তি নাই। তাই বিপ্লবের পথের সন্ধান করতেন সবসময়। মাঝে মাঝে অতিবিপ্লবী ঝোঁকেও আক্রান্ত হতেন। ভুলও যে হয়নি তা নয়। কিন্তু উদ্দেশ্য ছিল সবসময়ই সৎ। গাদ্দাফির ইসলামি সমাজতান্ত্রিক পথের কথা আকৃষ্ট করেছিল আহমদ ছফাকে। গাদ্দাফির লেখা ‘গ্রিন বুক’ বাংলায় অনুবাদ করেছিলেন নিজের গরজে। কিন্তু মোহ ভাঙতে সময় লাগেনি। লিবিয়াতে কর্নেল ফারুক-রশিদসহ বঙ্গবন্ধুর খুনীরা চরম সন্ত্রাসবাদীদের ট্রেনিং করানো শুরু করলে আহমদ ছফা গাদ্দাফির স্বরূপ চিনতে পারেন। তাকে নিয়ে আর কথা বলেননি কখনো। ছফাবিরোধীরা প্রচার করে, টাকার লোভে এই কাজ করেছিলেন তিনি। এই একটা ব্যাপারে আমি শতভাগ নিশ্চয়তা দিতে পারি। টাকার জন্য কিছু করতেন না আহমদ ছফা। তাকে টাকা দেবার লোকের অভাব ছিল না। সেই সময়কার সরকারগুলোও ছফা ভাইকে পদ-পদবি-পুরস্কার দিতে প্রস্তুত ছিল। কিন্তু সেকথা ছফা ভাইয়ের কাছে উত্থাপন করার সাহস তাদের ছিল না। অ্যাজমাতে কষ্ট পেতেন খুব। একবার তার ভক্তরা আমেরিকায় নিয়ে গিয়েছিলেন। ফিরে এলেন আরো বেশি অ্যাজমার কষ্ট নিয়ে। বললাম, আমেরিকাতে একটু চেকআপ-চিকিৎসা নিতে পারতেন।
ধমক দিয়ে বললেন, আমেরিকাতে কেন ডাক্তার দেখাতে যাব? আমাদের দেশের ডাক্তাররা কি কম যোগ্য? নিবেদিতপ্রাণ ডাক্তার তো কম নেই এদেশে। আমি সবসময় দেখাই মগবাজারের কমিউনিটি হাসপাতালে। ডা. কামরুজ্জামানের হাসপাতাল। মানুষকে কত নিষ্ঠার সাথে সেবা দিচ্ছে তারা।
আমি যাতে হেলথ ইকনোমিক্সের পড়াশোনা শেষ করে আগের চাকরিতে ফিরে না গিয়ে ঢাকাতেই থাকি, তার চেষ্টা করতেন তিনি। অনেক প্রতিষ্ঠানের কর্তাব্যক্তিকে বলতেন, জাকিরকে ঢাকাতে রাখতে হবে। একদিন একটা চিঠি দিয়ে আমাকে পাঠিয়েছিলেন ডা. কামরুজ্জামানের কাছে। গোপন এবং গুরুত্বপূর্ণ চিঠি মনে করে আমি তড়িঘড়ি মগবাজার কমিউনিটি হাসপাতালে গেলাম। ডা. কামরুজ্জামান চিঠিটা পড়ে আমাকে জিজ্ঞেস করলেন, তোমার মাস্টার্স কবে শেষ হবে? শেষ করে জয়েন করতে চাও নাকি এখনই জয়েন করবে?
আমি তো আকাশ থেকে পড়লাম। যে চিঠি আমি বয়ে এনেছি, তাতে আমাকেই সেখানে নিয়োগ দেবার প্রস্তাব করা হয়েছে! এমন অপ্রস্তুত তখন আমি! বললাম, না না জামান ভাই, এমন কথা আমি ভাবিনি।
ডা. জামান হেসে বললেন, তোমার ভাবনা ছফা ভাই নিজের কাঁধে নিয়ে নিয়েছে। যা-ই হোক, তুমি সময়মতো আমাকে জানিয়ো।
আমি তার সামনে থেকে পালাতে পারলে বাঁচি। একটু উষ্মার সাথেই ছফা ভাইয়ের কাছে জানতে চেয়েছিলাম, এমন কাজ কেন করলেন? তিনি বললেন, মাছের পচন শুরু হয় মাথা থেকে। আমাদের দেশের পচনও রাজধানী থেকে শুরু হয়েছে। চিকিৎসাও শুরু করতে হবে মাথা থেকেই। তাই রাজধানীতেই থাকতে হবে তোমাদের মতো ছেলেদের।
কার সামনে কোন কথা বললে স্বার্থহানি ঘটতে পারে, তা বাঙালি মধ্যবিত্ত খুব ভালো বোঝে। ছফা ভাই যে কাউকে রেয়াত করে কথা বলতেন না তার কারণ হচ্ছে নিজের স্বার্থ নিয়ে তিনি কখনোই বিন্দুমাত্র ভাবিত ছিলেন না।
আমাদের একুশের বইমেলায় কলকাতার বই ঢুকছিল অবাধে। আহমদ ছফা কয়েকজন ছেলেমেয়েকে সঙ্গে নিয়ে বুকে প্ল্যাকার্ড বেঁধে বইমেলাতে পর পর কয়েকদিন অবস্থান করে প্রতিবাদ জানালেন। বন্ধ হলো একুশের বইমেলায় ভারতীয় বইয়ের প্রবেশ। ছফা ভাইয়ের সাফ কথা, একুশের বইমেলা আমাদের জাতীয় মেলা। বাংলাদেশের লেখক-প্রকাশকদের মাথা তুলে দাঁড়ানোর সুযোগ করে দেবার জন্য এই মেলা। এটি আন্তর্জাতিক মেলা নয়। এখানে ভারতীয় বা কোনো বিদেশী বই ঢুকতে দেয়া হবে না।
আওয়ামী লীগের ৯৬ সালের শাসনামলে আনন্দ পাবলিশার্স বাংলাদেশে ঢোকার ব্যবস্থা করে ফেলেছিল। এই দেশে কে কে কলকাঠি নাড়ছিলেন, আমার পরিষ্কার জানা নেই। কবি সমুদ্র গুপ্ত তখন জাতীয় কবিতা পরিষদের সাধারণ সম্পাদক। তিনি বলেছিলেন, নেপথ্যে কাজ করছেন ড. আনিসুজ্জামান, বেলাল চৌধুরী, প্রথম আলো-র একটা গ্রুপ। লেখক-প্রকাশকরা আবার দ্বারস্থ আহমদ ছফার। আজিজ মার্কেটে প্রতিবাদ সভার আয়োজন হলো। ছফা ভাই বক্তৃতা শুরু করলেন বসে থাকা বাংলাবাজারের প্রকাশকদের দিকে আঙুল তুলে, বাংলাবাজারের প্রকাশকরা সব চোর। লেখক-কবিদের টাকা মেরে খায়। তাই আনন্দবাজারের মতো সুযোগ সন্ধানীরা সাহস পায় বাংলাদেশে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির মতো ঘাঁটি গাড়তে।
গালি দিলেন বটে, সেইসাথে আন্দোলনের কর্মসূচিও ঠিক করে দিলেন। আর নিজে পুরো সময়জুড়ে সরব রইলেন। আনন্দ পাবলিশার্স ব্যর্থ হয়েছিল।
অরুণ সেন তখন মাঝে মাঝে ঢাকায় আসতেন। সজ্জন মানুষ। বাংলাদেশের সাহিত্য, নাটক, চিত্রকলা নিয়ে তার আন্তরিক আগ্রহ। কলকাতার কাগজে বাংলাদেশ নিয়ে বেশ গভীর পর্যবেক্ষণমূলক লেখা লিখতেন। তাই তিনি ঢাকায় এলে তাকে সংবর্ধনা দেবার ধূম পড়ে যেত সাহিত্যপাড়ায়, নাটকপাড়ায়। আজিজ মার্কেটে যখন আসতেন, তার পেছনে ঢোকার সিনিয়র-জুনিয়র লেখক-কবিদের একটা ছোটখাট মিছিল থাকত। অরুণ সেন এলেন আহমদ ছফার ঘরে। আগেই যোগাযোগ হয়েছিল। তিনি কলকাতার একটি বড় এবং নামী প্রকাশনা সংস্থার পক্ষ থেকে এবার এসেছেন। তারা একই মোড়কে আহমদ ছফার পাঁচটি উপন্যাস ছাপতে চান। অরুণ সেন চুক্তিপত্রটাও নিয়ে এসেছেন। ছফা ভাইয়ের ছোট্ট ঘরে গাদাগাদি করে বসেছে অনেক মানুষ। কেউ কেউ দাঁড়িয়ে। আমি দাঁড়িয়ে আছি ছফা ভাইয়ের চেয়ার ঘেঁষে। অরুণ সেন চুক্তিপত্র বের করলেন। ছফা ভাই আমার দিকে এগিয়ে দিলেন নিঃশব্দে। পুরো চুক্তিপত্র পড়া হয়নি আমার। শুরুতেই দেখলাম ছফা ভাইয়ের নামের বানান ভুল করে লেখা হয়েছে আহমদ ‘সফা’। সেখানে আঙুল রেখে আমি ছফা ভাইয়ের চোখের সামনে তুলে ধরলাম চুক্তিপত্রটি। দেখামাত্র ছফা ভাইয়ের মুখ হয়ে গেল গম্ভীর। চোখ লাল হয়ে উঠল। আকস্মিক পরিবর্তন চোখ এড়াল না কারো। অরুণ সেন থমকে গেলেন। ছফা ভাই তার দিকে চুক্তিপত্রটি ঠেলে দিয়ে বললেন, কার সাথে চুক্তি করতে এসেছেন? এটা তো আমার নাম নয়।
অরুণ সেনও সম্ভবত আগে ভালো করে খেয়াল করেননি। একনজর তাকিয়েই ধরে ফেললেন ভুলটি। এ যে কম্পোজিটারের ভুল তা বোঝা গেল। কিন্তু অরুণ সেন বাড়তি ভুলটা করলেন অজুহাত দিতে গিয়ে। বললেন, আসলে আরবি নামগুলো ঠিকমতো উচ্চারণ করতে আমাদের অসুবিধা হয়। তাই অনেক সময় ভুল হয়ে যায়।
ছফা ভাই ফেটে পড়লেন, আপনাদের মশাই স্প্যানিশ, ফরাসি, ল্যাটিন শব্দ উচ্চারণে অসুবিধা হয় না। অথচ সাতশো বছর একসঙ্গে বসবাস করেও আপনারা বাঙালি মুসলমানদের নাম ঠিকমতো উচ্চারণ করতে শিখলেন না। ধরে ধরে খৎনা করে দিলে বোধহয় তারপরে শিখবেন।
আহমদ ছফা মারা গেলেন আকস্মিকভাবে। সেটাও আওয়ামী লীগ আমলের শেষদিকে। মুক্তিযোদ্ধা হিসাবে তার রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় দাফন হবার কথা। কিন্তু আহমদ ছফা তো মুক্তিযোদ্ধার সার্টিফিকেট তোলেননি। মুক্তিযুদ্ধে নিজের ভূমিকা পালন করেছেন, এটুকুই ছিল তার কাছে যথেষ্ট। আর চেনা বামুনের পৈতা লাগবেই বা কেন? কিন্তু তার মৃত্যুর খবর রেডিয়ো-টেলিভিশনে প্রচারিত হবার পরেও রাষ্ট্রের কোনো উদ্যোগ দেখা যাচ্ছে না। তখন মুক্তিযোদ্ধা সংসদের চেয়ারম্যান আহাদ চৌধুরী। যাওয়া হলো তার কাছে। তিনি বললেন, সার্টিফিকেট ছাড়া মুখের কথার কোনো দাম নেই। আহমদ ছফা কে তা তিনি জানেন না।
আসলে এইদেশে এসব ওপরের পদে যেসব লোক থাকে তাদের যোগ্যতার অন্যতম মাপকাঠি হচ্ছে আহমদ ছফার মতো মানুষদের না চেনা। রাষ্ট্রীয় মর্যাদা বা গার্ড অফ অনার ছাড়াই দাফন করা হয়েছে আহমদ ছফাকে। মৃত্যুর ওপার থেকে কথা বলার সুযোগ থাকলে আহমদ ছফা বলতেন, আমি ওদের থোড়াই কেয়ার করি। হয়তো আরেকবার উচ্চারণ করতেন তার প্রিয় গালিটি, ওরা সব বিশুদ্ধ কুকুরের বাচ্চা।
লেখক: কথাসাহিত্যিক