
রক্তমাখা চাঁদের আলো অথবা নিজের কথা
পর্ব ৯
জাকির তালুকদারপ্রকাশিত : মে ০২, ২০১৯
মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় মদ খেতেন। আসলে মদ খেতে বাধ্য হতেন। তা নিয়ে কলকাতার সাহিত্যিকমহলে নানারকম কথাবার্তা চালু ছিল। বিশেষ করে, মানিক যখন কমিউনিস্ট পার্টির সদস্য হয়েছিলেন। বামবিরোধী লেখক-কবি-সম্পাদকরা তাকে নিয়ে মুখরোচক আলোচনা করতেন। মানিকের ঘরে খাবার নেই। সেকথা শুনে তারা ঠোঁট উল্টে বলতেন, মাল খেয়ে সব উড়িয়ে দিলে ভাত জুটবে কোত্থেকে?
কেউ একথা ভেবে দেখেননি, মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় মদ খাওয়া শুরু করলেন কেন এবং কীভাবে? মানিক আক্রান্ত হয়েছিলেন মৃগি রোগে। তখন এই রোগের উন্নত চিকিৎসা বা ওষুধ আবিষ্কৃত হয়নি। ভুক্তভোগিরা জানেন, বা যারা এই ধরনের রোগীর খিচুনি দেখেছেন তারা জানেন, এই যন্ত্রণার কোনো তুলনা হয় না। আর খিচুনি কেটে যাওয়ার পরে রোগী কয়েকদিনের জন্য নিস্তেজ এবং অচল হয়ে পড়ে।
কিন্তু নিস্তেজ অচল হয়ে পড়ে থাকলে তো মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের চলবে না। তাকে লিখতে হবে। লেখার তাড়না থেকে তো বটেই, সেইসাথে ভাতের সংস্থান করার জন্যও লিখতে হবে। তাই নিস্তেজ হয়ে পড়ে থাকার বিলাসিতা সইত না। অবসন্নতা দূর করার জন্য ডাক্তারদের পরামর্শে ভিটামিন খেতেন। কিন্তু তা তাকে চাঙা করতে পারত না। ফল-ফলারি-পুষ্টিকর খাদ্য ব্যয়বহুল। একা তো খেতে পারবেন না। পরিবারের সবার জন্যই সেই ব্যবস্থা করতে হবে। অত টাকা কোথায় পাবেন? নিজেই চিকিৎসা হিসাবে শুরু করলেন একটু-আধটু মদ খাওয়া।
প্রথমদিকে ভালো কাজ দিচ্ছিল। মৃগিজনিত খিচুনি এবং অজ্ঞান অবস্থা কেটে যাওয়ার পরে একটু অ্যালকোহল পান করে ঠিকমতো লিখতে বসতে পারতেন। জানতেন, এই মদ খাওয়া তার জন্য দীর্ঘমেয়াদি ক্ষতির কারণ হবে। কিন্তু রোজকার বেঁচে থাকার গরজের জন্য মদ খেতে বাধ্য হতেন। যেহেতু শেষপর্যন্ত লেখাই ছিল তার জীবিকা, কোনো পত্রিকায় লিখলে অবশ্যই সম্মানী নিতেন মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়। অনেক সময় কেউ লেখা চাইলে আগেই জানতে চাইতেন লেখার জন্য কত টাকা দেয়া হবে তাকে। পরিষ্কার বলতেন, আমি টাকার জন্য লিখি না। তবে লেখার ছাপার জন্য আমাকে টাকা দিতে হবে।
কমিউনিস্ট পার্টি ‘পরিচয়’ পত্রিকাটি কিনে নিয়েছিল সুধীন্দনাথ দত্তর কাছ থেকে। সেই ‘পরিচয়’ পত্রিকাতে ধারাবাহিক উপন্যাস লেখার জন্য প্রতি কিস্তিতে দশ টাকা করে নিতেন মানিক। সে টাকা অবশ্য তিনি দিয়ে দিতেন পার্টিফান্ডে। একবার তাকে টাকাটা না দিয়ে গোপাল হালদার সরাসরি জমা দিলেন পার্টির ফান্ডে। রেগে গিয়েছিলেন মানিক। বলেছিলেন, এটা কেন করলেন? আমার লেখক সম্মানীর টাকা আমার হাতেই দিতে হবে আপনাকে। তাছাড়া এই মাসে টাকাটা তো আমি পার্টিফান্ডে না-ও দিতে পারতাম!
তার বড়ভাই ছিলেন অল ইন্ডিয়া স্ট্যাটিসটিক্যাল বিভাগের পরিচালক। মেজো ভাই কলকাতার বড় সার্জন। পরের ভাই ব্যাংকের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা। অন্য ভাইরা সফল ব্যবসায়ী। বড় ভাইয়ের কাছে টাকা ধার চেয়ে একটি মর্মস্পর্শী চিঠি লিখেছিলেন মানিক। একটি প্রকাশনা ব্যবসা দাঁড় করাতে চাইছিলেন। কোনো উত্তর আসেনি। পৈত্রিক বাড়ি বিক্রি এবং ভাগ-বাটোয়ারার পরে দেড় ঘরের একটি বাসাতে সপরিবারে থাকতেন মানিক। সন্তানদের গর্বে ফুলে ওঠা বাপের জায়গা হয়নি স্বচ্ছল পুত্র-কন্যার ঘরে। অসুস্থ মনভাঙা পিতার ঠাঁই হয়েছিল অকৃতি ডিগ্রিহীন ছোট ছেলে মানিকের ঘরেই। আজ যে হরিহর বন্দ্যোপাধ্যায়ের কৃতি সন্তানদের নাম কেউ জানে না, তিনি যে ভবিষ্যতে কেবলমাত্র মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের পিতা হিসাবেই শ্রদ্ধার সাথে পরিচিত হবেন, সেকথা সম্ভবত তিনি ভাবতে পারতেন না। কেউ-ই পারে না।
মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের মদ খাওয়ার ব্যাপারটা বিপক্ষ শিবির থেকে ফলাও করে প্রচার করা হতো তখন। বামপন্থিদের প্রতি অন্যদের এমনিতেই ঈর্ষা থাকে। বামদের সততা, দেশপ্রেম, মানবপ্রেম, জ্ঞানস্পৃহা, অন্যায়ের প্রতিবাদে চরম ঝুঁকি নিয়েও ঝাঁপিয়ে পড়া, জীবনকে একমাত্রিক দৃষ্টির পরিবর্তে নানা দিক থেকে দেখার চেষ্টার মতো গুণগুলিকে শ্রদ্ধা করত সকলেই। বিপক্ষ শিবিরের ঈর্ষাপরায়ণদের কাছে কোনো বামপন্থির একটা ত্রুটি খুঁজে পাওয়া এভারেস্ট জয়ের শামিল। সেটা তারা পেয়েছিলেন মানিকের মদ খাওয়ার তথ্য পেয়ে। তারা অপপ্রচার চালাতেন, আর মানিক একের পর এক লেখা দিয়ে বাঙালিকে সমৃদ্ধ করার মাধ্যমেই প্রতিবাদ জানিয়ে যেতেন অপপ্রচারের। রাস্তাঘাটে মাতলামি করতে তাকে কেউ দেখতে পায়নি কোনোদিন। দেখবে কী করে? মাতাল হওয়ার জন্য তো মদ খেতেন না মানিক। হাসপাতালে ভর্তি থাকার সময় মানিক অপ্রকাশিত ডায়েরিতে লিখেছিলেন, মদ খাওয়া নয়, আমার আসল রোগ মৃগি আর অভাবজনিত অপুষ্টি। মৃত্যুর পরে ডাক্তাররা যখন জানালেন মদ খাওয়ার কারণে মৃত্যু হয়নি লেখকের, তখন হাসপাতালের এমাথা থেকে ওমাথা পর্যন্ত দৌড়ে দৌড়ে চিৎকার করছিলেন সুভাষ মুখোপাধ্যায়, মানিকবাবু মদ্যপ ছিলেন না। মদ তার মৃত্যুর কারণ নয়। এই যে প্রমাণ! এই যে ডাক্তারের সার্টিফিকেট।
দৃশ্যটা ভাবলেও চোখে পানি চলে আসে। মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় আমার সাহিত্যিক অনুপ্রেরণার অন্যতম নাম। তার লেখা পড়েছি বারবার। চিঠি-ডায়েরি পড়েছি খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে। তার সম্পর্কে নিকটজনদের স্মৃতিকথা পড়েছি। বিপক্ষদের কথাও জানতে চেষ্টা করেছি যতটা সম্ভব।
তাকে নিয়ে একটি গল্প লিখেছিলাম ‘মানিক বাঁড়ুজ্জের সাথে যাবার সময়’ নামে। ছাপতে দিয়েছিলাম দৈনিক কালের কণ্ঠের শিলালিপিতে। তখন সেটি সম্পাদনা করতেন কবি শামীম রেজা। শুক্রবার খুব সকালে ফোন এলো। ফোন করেছেন মোহম্মদ মহসীন। এখন বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজির শিক্ষক। প্রতিভাবান লেখক। আমি ফোন কানে নিয়ে হ্যালো হ্যালো করছি। কিন্তু কোনো উত্তর আসে না। বেশ কিছুক্ষণ পরে এলো ফোঁপানোর শব্দ। কাঁদছেন মহসীন। আমি ভয় পেয়ে গেলাম। না জানি কী ঘটেছে! বারবার প্রশ্ন করছি, কী হয়েছে মহসীন? কী হয়েছে? খুব খারাপ কিছু কি ঘটেছে?
মহসীন কেবল একটি নাম উচ্চারণ করলেন, মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়। তারপরেই কেটে দিলেন ফোন। আর কথা বলতে পারছেন না। আমি তখনো বুঝতে পারিনি ব্যাপারটি ঠিক কী। পত্রিকা আসার পরে দেখলাম ছাপা হয়েছে ‘মানিক বাঁড়ুজ্জের সাথে যাবার সময়’। মহসীনের কান্নার রহস্য তখন পরিষ্কার হলো। নিজের লেখা কোথাও ছাপা হলে আমি সেটা প্রায় কখনোই পড়ি না। বই ছাপা হয়ে গেলে বইটাও খুলে দেখি না কখনো। কিন্তু মহসীনের প্রতিক্রিয়ার ধাক্কায় পড়তে শুরু করলাম নিজের লেখা গল্পটি। পুরোটা পড়ার আগে আমার চোখেও পানি এসে গেল। কীভাবে লিখতে পারলাম আমি এমন একটি বুকভাঙা গল্প!
লেখক: কথাসাহিত্যিক