
রক্তমাখা চাঁদের আলো অথবা নিজের কথা
পর্ব ১০
জাকির তালুকদারপ্রকাশিত : মে ০৩, ২০১৯
পশ্চিবঙ্গের কথাসাহিত্যে মতি নন্দী-শ্যামল-সন্দীপন-সুনীল-শীর্ষেন্দুবাবুদের পরে একটি অত্যন্ত শক্তিশালী প্রজন্ম উঠে এসেছেন। তবে তারা কেউ উপরোক্তদের মতো একই সাথে বাণিজ্যসফল নয়। সাধন চট্টোপাধ্যায় তো লিটল ম্যাগাজিন ছাড়া অন্য কোথাও লেখেন না। তবে অন্যেরা সব কাগজেই লেখেন। নব্বই দশকের শুরুতে পড়েছি সাধনদার গল্প। স্বপ্নময় চক্রবর্তীর ‘অষ্টচরণ ষোলোহাঁটু’, অভিজিৎ সেনের ‘রহু চণ্ডালের হাড়’, অনিল ঘড়াইয়ের ‘নুনবাড়ি’, আফসার আমেদ, ভগীরথ মিশ্র, বীরেন শাসমলের গল্প পড়েছি বিচ্ছিন্নভাবে। তখন হাতে এসেছিল এইগুলোনই। পরে অন্য শক্তিশালী লেখকদের পরিচয় পেয়েছি। তবে প্রথম আমি যার সংস্পর্শে যাওয়ার সুযোগ পেয়েছিলাম, তিনি অনিল ঘড়াই। সেটি ছিল আমার সদ্য শুরু হওয়া লেখকজীবনের জন্য একটি বিশাল আশীর্বাদ।
আমার প্রথম কলকাতা গমন সরকার আশরাফ এবং বগুড়ার শোয়েব শাহরিয়ারের সাথে। সন্দীপ দত্ত তার লিটল ম্যাগাজিন লাইব্রেরি ও গবেষণা কেন্দ্রের পক্ষ থেকে প্রতিবছর দুই-তিনটি লিটল ম্যাগাজিনকে পুরস্কার দিতেন। সেই বছর পুরস্কারের জন্য মনোনীত হয়েছিল সরকার আশরাফ সম্পাদিত ‘নিসর্গ’। সাল-তারিখ আমার মনে থাকে না। আসলে মনে রাখার চেষ্টাও তেমন করি না। আমি তো ইতিহাস লিখি না। মানুষ এবং ঘটনাই মুখ্য। কলকাতা পৌঁছে আমরা উঠলাম শেয়ালদার কাছে একটা হোটেলে। ফোন করা হলো সন্দীপ দত্তকে। জানানো হলো আমাদের কলকাতায় পৌঁছানোর কথা। তিনি শুনলেন। নিরুত্তাপ কণ্ঠে বললেন, কাল বিকেলে স্টুডেন্ট হলে চলে আসুন। ওখানেই অনুষ্ঠান।
এমন নিরুত্তাপ অভ্যর্থনায় বড্ড মুষড়ে পড়েছিলেন সরকার আশরাফ। পুরস্কার গ্রহণের আমন্ত্রণে এখানে আসা। অথচ আয়োজক কি না একবার জিগ্যেসও করলেন না কোথায় আছি আমরা! এ কেমন অভদ্রতা! শুধু অভদ্রতা নয়, সরকার আশরাফের মনে হচ্ছিল, এ একেবারে অপমানের চূড়ান্ত। নিজেরা খেতে না পেলেও অতিথিকে মুরগি জবাই করে খাওয়ানোর সংস্কৃতিতে অভ্যস্ত মানুষদের কাছে এমন আচরণ গ্রহণযোগ্য হবে না, এ তো জানা কথা। সরকার আশরাফ একবার জিগ্যেস করলেন, এমন আচরণের পর কাল অনুষ্ঠানে যাওয়া কি আমাদের উচিত হবে?
আমি বলটা তার কোর্টেই ঠেলে দিলাম, আপনেই সিদ্ধান্ত নেন। আমি এইখানে কোনো ফ্যাক্টর না। আমি আইছি কলকাতার লেখক-কবিদের দেখতে। কথা কওয়ার সুযোগ হলে কবো, না হলে শুনে-টুনে বিদায় নিব। শোয়েব শাহরিয়ার বললেন, এতদূর যখন এলাম, চলেন অনুষ্ঠানটা সেরেই যাই। কোনো ভালোকিছুর প্রত্যাশা না নিয়ে গেলে হতাশা তৈরি হবে না। আমরা তো বুঝেই গেলাম, ওরা ভাবছে, পুরস্কার দিয়েই আমাদের ধন্য করে দিয়েছে। আতিথেয়তা বোধহয় এদের রক্তে নাই।
পরদিন স্টুডেন্ট হল। সরকার আশরাফ মুখ গোমড়া করেই পুরস্কার নিলেন। পুরস্কার মানে একটা পেতলের থালায় খোদাই করা কয়েকটি বাক্য। আর একটা কাগজের প্যাকেটে তিনটে লুচি এবং বোঁদে। অনুভূতি ব্যক্ত করার সময় সরকার আশরাফ কথা শুরু করলেন, আসসালামু আলাইকুম বলে। দুই মিনিটে শেষ করে দিলেন কথা। আমি পেছনের দিকের সারিতে বসে ছিলাম। একজনকে ব্যঙ্গ করে বলতে শুনলাম, ওই থালাটা নিতে সুদূর বাংলাদেশ থেকে এসেছেন দাদারা! হে হে হে!
বিরতিতে বাইরে খণ্ড খণ্ড আড্ডা। বীরেন শাসমল ডেকে নিলেন আমাদের। আরো কয়েকজন ছিলেন। অমৃতলোক সম্পাদক সমীরণ মজুমদারের কথা মনে আছে। একজনকে দেখা গেল কাঁধে একটা ট্রাভেল ব্যাগ ঝুলিয়ে কথা শুনছেন নীরবে। মাঝারি উচ্চতার মানুষ, সোঁদামাটির মতো গায়ের রং, চেহারায় ক্লান্তির ছাপ। তার দিকে চোখ পড়াতে বীরেন শাসমল বললেন, আসুন পরিচয় করিয়ে দিই। ইনি হচ্ছেন অনিল ঘড়াই। শোয়েব শাহরিয়ার অবিশ্বাসের ভঙ্গিতে বললেন, আপনিই অনিল ঘড়াই!
ফিটফাট মফস্বলি শহরের মানুষ তিনি। কোনো লেখক যে এতটা গ্ল্যামারহীন হতে পারে, তা বোধহয় তার ধারণাতেই ছিল না। যাহোক, কিছু কথাবার্তা হলো। জানলাম, অনিলদা কলকাতায় থাকেন না। পশ্চিমবঙ্গের বাইরে থাকেন। সেই জায়গার নাম চক্রধরপুর। তখন সেটি বিহারের মধ্যে। এখন ঝাড়খণ্ডে। নাটোর থেকে কলকাতা যতদূর, চক্রধরপুর থেকে কলকাতা তার চেয়ে বেশি দূরে। অনিলদা অনুষ্ঠানের খবর পেয়ে এত রাস্তা বয়ে এসেছেন বাংলাদেশের লেখক-সম্পাদকদের সাথে দেখা হবে ভেবেই। রাতের ট্রেনেই আবার ফিরে যাবেন চক্রধরপুরে। মুগ্ধ দৃষ্টিতে দেখছিলাম ‘জারমানের মা’ ‘পরীযান’ ‘নুনবাড়ি’র লেখক অনিল ঘড়াইকে।
বিরতি শেষে সবাই ঢুকলেন অনুষ্ঠানে। আমি অনিল ঘড়াই, অনুপ সিহি আর মানস কুমার চিনির সাথে গিয়ে বসলাম কফি হাউসে। সেই প্রথম আমার কফি হাউসে ঢোকা। অনিলদা এবং অন্য দুইজনের সাথে ততক্ষণে ফোন নম্বর, ঠিকানা বিনিময় হয়ে গেছে। তিনি আমন্ত্রণ জানালেন চক্রধরপুরে যাওয়ার। আমি একবিন্দু দ্বিধা না করে বললাম, যাব।
জানতে চাইলাম। পরের দিনের পরের দিন আমি যাব। জানতে চাইলাম, একশো-দেড়শো রুপির মধ্যে রাত্রিবাসের হোটেল পাওয়া যাবে কি না।
অনিলদা বললেন, যাবে। তিনি রেলওয়ে টিএন্ডটিতে চাকরি করেন। জানিয়ে দিলেন হাওড়া থেকে আমাকে ইস্পাত এক্সপ্রেসে উঠতে হবে। চক্রধরপুরে তিনি আমাকে রিসিভ করবেন।
মানসকুমার চিনি আর অুনপ সিহি থাকেন খড়গপুরে। তারা বললেন, খড়গপুরে নেমে আমি যেন তাদের সাথে একটা বেলা কাটাই। আমার রাজি না হওয়ার কোনো কারণ নেই।
পরদিন সকালে তিনজন গেলাম বীরেন শাসমলের বাসায়। ভালো গল্পকার। দেশ পত্রিকায় উনার ‘পানপাতা মুখ’ নামের গল্পটি আগে পড়েছি। একটি পত্রিকা সম্পাদনা করেন ‘তীব্র কুঠার’। উন্নতমানের গদ্যের পত্রিকা। বীরেনদা, তার স্ত্রী, শ্বশুরের আপ্যায়ন ছিল যথার্থ আন্তরিক। শ্বশুরমশাই কাছেই একটি বাড়িতে থাকেন। বাংলাদেশ থেকে যাওয়া মানুষ। বাংলাদেশের মানুষের সাথে গল্প করতে এসেছেন।
সরকার আশরাফ আর শোয়েব শাহরিয়ার ভুলতে পারছেন না উদ্যোক্তাদের অবজ্ঞার কথা। তারা সিদ্ধান্ত নিলেন, পরদিন সকালেই ফিরে যাবেন বগুড়ায়। আমি জানালাম, তাদের সাথে ফিরছি না। দুপুরে তারা গেলেন ছেলে-মেয়ে-স্ত্রী-র জন্য কেনাকাটা করতেন। আমি লোকজনের কাছে পথের হদিশ জেনে গেলাম সাহিত্য আকাদেমিতে (বাংলা আকাদেমিও হতে পারে)। সেখানে ‘মিট দ্য অথর’ অনুষ্ঠানে কথা বলবেন অমিয়ভূষণ মজুমদার। এই অনুষ্ঠান ছাড়া যায়!
দেবেশ রায়ের পরিচালনায় অনুষ্ঠানটি ছিল খুবই সুন্দর। একক বক্তা অমিয়ভূষণ মজুমদার। তিনি বললেন খুব স্বাভাবিক ভঙ্গিতে। তার কথা শেষের পরে ছিল প্রশ্নোত্তরের পালা। কেউ কোনো প্রশ্ন করছিলেন না। সম্ভবত অমিয়ভূষণের লেখার সাথে কারো তেমন পরিচয় নাই। দেবেশ রায় প্রায় জোর করেই প্রশ্ন করার নামে শ্যামল গঙ্গোপাধ্যায়কে ডেকে তুললেন মঞ্চে। তিনি বললেন যে আসলেই অমিয়ভূষণের লেখা তার তেমন পড়া নেই। চলে গেলেন অন্য কথায়। শুনতে খুব ভালো লাগছিল। বিশেষ করে যখন নির্দ্বিধায় বললেন, প্রতিষ্ঠা পাওয়ার জন্য অনেক বছর নীরব থেকেছি। চোখের সামনে অনেক অন্যায় দেখে না দেখার ভান করে সরে এসেছি। এখন আমাদের সত্য বলা উচিত। আরও বেশি দেরি করলে বোধহয় বলার সুযোগটাই আর পাওয়া যাবে না।
বিদায় নিলেন দুই সফরসঙ্গী। আর আমি দুপুরে হাওড়া স্টেশনে গিয়ে উঠে বসলাম ইস্পাত এক্সপ্রেসে। তখনো আমার কোনো বই প্রকাশিত হয়নি। গল্প ছাপা হয়েছে গুটিকয়েকমাত্র। সাথে দুইটি পত্রিকা, যেখানে আমার গল্প আছে। এই পুঁজি নিয়ে আমি যাচ্ছি বাংলাগল্পের অসাধারণ এক লেখকের কাছে। অনিল ঘড়াইয়ের কাছে। বিন্দুমাত্রও ধারণা নেই যে সেই সফর এবং সঙ্গলাভ হবে আমার ভবিষ্যৎ লেখকজীবনের এক বিশাল মোড় পরিবর্তনের সূচনা। চলবে
লেখক: কথাসাহিত্যিক