রক্তমাখা চাঁদের আলো অথবা নিজের কথা

পর্ব ১২

জাকির তালুকদার

প্রকাশিত : মে ০৫, ২০১৯

কিশোরপুত্র বাবলুকে রোজ বিকালে মাঠে-পথে-নদীর ধারে বেড়াতে নিয়ে যেতেন বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়। একবার বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়কে বক্তা হিসাবে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছে শ্রী অরবিন্দের স্মরণ সভায়। কলকাতার বিদগ্ধ জনেরা বলবেন সেখানে। অনুষ্ঠানটিতে আলোচক হতে পেরে বিভূতিভূষণ আনন্দিত হয়েছিলেন। বেশ প্রস্তুতি নিয়েছিলেন তিনি। অনুষ্ঠানের দিন স্ত্রী তাকে পরিয়ে দিলেন গরদের পাঞ্জাবি, শান্তিুপুরি ধূতি। এমনিতে বিভূতিভূষণের সবসময়ের পোশাক ছিল হাঁটু পর্যন্ত ঝুলের মোটা ধুতি আর ফতুয়া। সেদিন অমন একটি গুরুত্বপূর্ণ সভায় যাওয়ার জন্য স্ত্রীর অনুরোধে বিশেষ পোশাক পরলেন তিনি। স্ত্রী হাতে তুলে দিলেন ছাতা। তিনি বেরুতে যাবেন, ঠিক সেইসময় পুত্র বাবলু তার পাঞ্জাবির ঝুল ধরে বলল, বাবা আজ আমাকে বেড়াতে নিয়ে যাবে না?

এক মুহূর্ত ভাবলেন বিভূতিভূষণ। তারপর ছাতা রেখে দিলেন মেঝেতে। বললেন, শ্রী অরবিন্দ আমার মাথায় থাকুন! তাঁকে নিয়ে বলবার লোকের অভাব হবে না। কিন্তু আমার বাবলুকে বেড়াতে নিয়ে যাওয়ার জন্য আমি ছাড়া আর কেউ নেই। চলো বাবা আমরা বেড়াতে যাই।

সেইভাবে পুত্রকে সময় দিতে পারিনি আমি। চাকুরিসূত্রে সপ্তাহে ছয়দিন দূরে থাকতে হয়েছে। কখনো কখনো একটানা অনেকদিন। অসুস্থ হয়ে পড়ার কারণে পুত্রের সান্নিধ্য পেয়েছিলাম অনেক বেশি। ঘরবন্দি আমি। সারাদিন একটু একটু করে লেখালেখি করি। একটানা বেশিক্ষণ লিখতে পারি না। এসে বিছানায় শুয়ে পড়ি। আমার কিশোরপুত্র তখন আমার বুকের ওপর মাথা রেখে শুয়ে থাকে। বুকের বামপাশে ঠিক হৃৎপিণ্ডের ওপরে কান ঠেকিয়ে। আমার হৃৎপিণ্ড টিক টিক করে আর পুত্র সেই তালে তালে টোকা দেয় আমার হাতে বা শরীরের অন্য কোথাও। সেই সান্নিধ্য-সংযোগের কোনো তুলনা আর কোনোকিছুর সাথে হয় না।

পুত্র বড় হতে থাকে। আমার সাথে দূরত্ব বাড়তে থাকে। বাবা এবং সন্তানের সাথে সাহিত্যের সরাসরি সম্পর্ক কমই থাকে। রণজিৎ দাশের একটি কবিতায় পড়েছিলাম, বাবাকে তিনি বলছেন তার জীবনযাপন এবং সাহিত্য থেকে কিঞ্চিৎ দূরের মানুষ। পুত্রের সাহিত্য আর পিতার অবস্থানের মাঝখানে কিছুটা দূরত্ব থাকে। যেমন শহর থেকে একটু দূরেই থাকে পাওয়ার স্টেশন। মুগ্ধ হয়ে গিয়েছিলাম রণজিৎ দাশের কবিতাটি পড়ে। অনেক সময় ধরে চুপচাপ বসে ছিলাম। আর কবিতাটি বয়ে যাচ্ছিল আমার শিরায় শিরায়। পাওয়ার স্টেশন শহরের মধ্যে থাকে না। একটু দূর থেকে সে শহরকে বিদ্যুৎ সরবরাহ করে। তা দিয়ে বেঁচে থাকে আধুনিক শহর। সেইরকম পুত্রের সাহিত্য নিয়ে পিতা হয়তো সরাসরি কিছু বলেন না। কিন্তু তার জীবন এবং সাহিত্যে নিরন্তর শক্তিপ্রবাহ সঞ্চার করে চলেন পিতা।

লেখকের জীবন তো অবজ্ঞা, অবহেলা, অপমানের সমানুপাতিক। প্রতিনিয়ত রক্তাক্ত হতে হয় তাকে। সাহিত্যজগতের বাইরের মানুষদের কাছ থেকে যেমন, তেমনই সাহিত্যজগতের মানুষের কাছ থেকেও। বৈষয়িক মানুষদের, তথাকথিত সফল মানুষদের, ক্ষমতাধর মানুষদের অবজ্ঞাকে পাল্টা অবজ্ঞার মাধ্যমে নিস্তেজ করে দেওয়া যায়। কিন্তু সাহিত্যজগতের মানুষদের অবজ্ঞা এবং উন্নাসিকতা অনেককেই লেখা ছেড়ে দিতেও বাধ্য করে। আমার লেখকজীবনের শুরু থেকে এসব আমার সঙ্গী। মজার ব্যাপার হচ্ছে, বিভিন্ন সময়ে যারা আমাকে অবজ্ঞা দেখিয়েছেন, তাদের সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশটিকেই আর সাহিত্যজগতে খুঁজে পাওয়া যায়নি। তারা বেঁচে থেকেও হারিয়ে গেছেন। অথবা তলানিতে চলে গেছেন। আমি চেষ্টা করেছি মন থেকে তাদের দুর্ব্যবহারের কথা ভুলে যেতে। অন্তত প্রতিশোধ নিতে চাইনি। চাই না। কারণ কিছু কিছু প্রাপ্তি সব অপ্রাপ্তির কথা ভুলিয়ে দেয়। সেই রকম প্রাপ্তি আমার লেখকজীবনে এসেছে। একটা প্রাপ্তির কথা জানাই।

আমার শত যুক্তিও পুত্রকে পারল না ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে রাজি করাতে। তার মাকেও বোঝাতে ব্যর্থ হলাম আমি। সে কমপিউটার সায়েন্স পড়তে গেল আমেরিকান ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটিতে। আমার সবচেয়ে বড় আপত্তি ছিল এই কারণে যে, সেখানে পড়ে তো দেশের পয়সাঅলা ঘরের ছেলেমেয়েরা। তাদের কালচার হচ্ছে বাংরেজি কালচার। এক অর্থে সংস্কৃতিহীন হয় তারা। তাদের সাথে সাথে আমার ছেলেটাও সাংস্কৃতিকভাবে উন্মূল হয়ে যাবে! কিন্তু আমি ঠেকাতে পারিনি। আমি তেমন খোঁজ নিই না তার ভার্সিটি সম্পর্কে। আবার সে-ও আগ বাড়িয়ে আমাকে ভার্সিটির গল্প শোনায় না। তবে একদিন বলল, বাবা তোমাকে আমার ক্লাসের একটা গল্প বলতে চাই। বললাম, বলো। পুত্রের একজন শিক্ষক হাতে বাংলা উপন্যাস নিয়ে ক্লাসে এসেছেন। ছেলেমেয়েরা অবাক। একে বাংলা, তায় আবার উপন্যাস!
স্যার আপনি এইসব পড়েন?
স্যার উত্তর দিলেন, গল্প-উপন্যাস তো পড়তে হবে। তোমরা বিজ্ঞানী হবে, প্রযুক্তিবিদ হবে। তার জন্য কল্পনাশক্তি বাড়ানোর দরকার। কল্পনাশক্তি ছাড়া কোনো আবিষ্কার হয় না। আর গল্প-উপন্যাস না পড়লে তোমাদের কল্পনাশক্তি বাড়বে কীভাবে? কয়েকজন লেখকের বই তোমাদের পড়া উচিত।
কার কার বই স্যার?
শিক্ষক আরো কয়েকজন লেখকের পাশাপাশি জাকির তালুকদারের নামটাও বললেন। তারপর জনতে চাইলেন জাকির তালুকদারের কোনো লেখা কেউ পড়েছে কি না।
খুব স্বাভাবিকভাবেই একটা হাতই উঠল। শিক্ষক জিগ্যেস করলেন, তুমি পড়েছ! বাহ! কী কী বই পড়েছ উনার?
উত্তর এলো, প্রায় সবই।
শিক্ষক অবাক হলেন, প্রায় সব বই পড়েছ উনার! পিতৃগণ পড়েছ?
পড়েছি স্যার।
হাউ ইট পসিবল? উনি তো তেমন জনপ্রিয় লেখক নন। তার বই খুঁজে খুঁজে পড়তে হয়। তুমি তার সম্পর্কে এত ইন্টারেস্টেড কীভাবে হলে?
ছাত্র হেসে বলল, জাকির তালুকদার আমার বাবা।
ঘটনাটি শুনিয়ে পুত্র বলল, আই অ্যাম প্রাউড অফ ইউ বাবা!

আমি অসীম সান্ত্বনা পেয়েছিলাম সেদিন। অন্তত একটা দিনের জন্যে হলেও পুত্র তার পিতাকে নিয়ে গর্বিত হবার সুযোগ পেয়েছে।

লেখক: কথাসাহিত্যিক