রক্তমাখা চাঁদের আলো অথবা নিজের কথা

পর্ব ১৪

জাকির তালুকদার

প্রকাশিত : মে ১০, ২০১৯

আশির দশকের লেখক-কবিরা বাংলাদেশের সাহিত্যকে বিরাজনীতিকরণের দিকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার সংঘবদ্ধ চেষ্টা চালিয়েছেন। অথচ রাজনৈতিকভাবে দেশ ছিল তখন অগ্নিগর্ভ। এরশাদবিরোধী আন্দোলনে কাঁপছে সারা দেশ। প্রতিদিন আহত-নিহত হচ্ছেন ছাত্র-শ্রমিক-রাজনীতিবিদরা। দমননীতি যত বাড়ছে আন্দোলনও তত বেশি উত্তাল হয়ে উঠছে। দেশের প্রধান লেখক-কবিরা সেই শেষবারের মতো একত্রিত হয়েছিলেন স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে গণতন্ত্রের সংগ্রামে। শামসুর রাহমান, মোহাম্মদ রফিক, ফয়েজ আহমদ, সৈয়দ শামসুল হক, সমুদ্র গুপ্ত, রুদ্র মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ, মোহন রায়হান, ইকবাল হাসান প্রমুখ টেনে নিয়ে চলেছেন জাতীয় কবিতা পরিষদকে। তাদের সাথে যুক্ত হয়েছেন সারাদেশের প্রবীণ এবং তরুণ কবি-সাহিত্যিকরা। অথচ সেই সময়, আশির দশকে যাদের উত্থান, সেই কবি-লেখকদের দেখা যাচ্ছে সাহিত্যকে রাজনীতি থেকে দূরে সরিয়ে নেবার একাগ্র প্রয়াস।

এমনটি একবার ঘটেছিল ষাটের দশকে। আবদুল্লাহ আবু সায়ীদের নেতৃত্বে ‘কণ্ঠস্বর’ পত্রিকার মাধ্যমে। উজ্জ্বল ব্যক্তিত্ব, বৈদগ্ধ, অসাধারণ বাগ্মীতা, রুচিময়তা দিয়ে তরুণ কলেজশিক্ষক আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ জয় করে নিয়েছিলেন ঢাকার সাহিত্য-সংস্কৃতির জগৎকে। অবিশ্বাস্য মনে হলেও সত্য যে, আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ একসময় ছিলেন এন.এস.এফ. এর সদস্য। আমি পরিষ্কার নই, সেই সময়ে এন.এস.এফ.একটি ছিল নাকি দুটি ছিল? এন.এস.এফ. বলতে আমরা জানি সেই সময় পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট আইউব খানের আশীর্বাদপুষ্ট কুখ্যাত গভর্নর মোনায়েম খানের সৃষ্ট ছাত্র সংগঠনের কথা। এই সংগঠনটিই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রথম সন্ত্রাসী সৃষ্টি ও আমদানি করে। ছাত্রদের মধ্যে সন্ত্রাসী কেউ কেউ ছিল, কিন্তু এন.এস.এফ. এর প্রধান সন্ত্রাসী শক্তি ছিল বহিরাগত দুই মাস্তান। খোকা আর পাঁচপাত্তুর। পাঁচপাত্তুর নাকি ক্যাম্পাসে আসত সাপ হাতে নিয়ে। এরা পরবর্তীতে নিহত হয়।

কিন্তু ভাবতে অবাক লাগে আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ ছিলেন এই সংগঠনের সদস্য। তাতে অবশ্য তার প্রতি আমার ব্যক্তিগত শ্রদ্ধা কমে না। উনার কাছাকাছি বয়সের যেসব লেখক-কবি-বুদ্ধিজীবী এই দেশের সাহিত্যের অঙ্গনকে নেতৃত্ব দিয়ে আসছেন, তাদের মধ্যে আবদুল্লাহ আবু সায়ীদকেই আমি দেখতে পেয়েছি সবচেয়ে বেশি পরমতসহিষ্ণু হিসাবে। তার প্রতিষ্ঠিত বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র দেশের চল্লিশ লক্ষ ছেলেমেয়েকে ম্যাক্সিম গোর্কির ‘মা’ পড়িয়েছে, কৃষণ চন্দরের ‘গাদ্দার’ পড়িয়েছে, পড়িয়েছে আরো অনেক কালজয়ী গ্রন্থ, যা কোনো প্রগতিশীল সংগঠন বা প্রতিষ্ঠান পারেনি। তো আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ ‘কণ্ঠস্বর’-এর মাধ্যমে ঢাকার সাহিত্য অঙ্গনে প্রতিষ্ঠিত করতে চাইলেন কলাকৈবল্যবাদকে। জীবনবাদী লেখকরা, যেমন শওকত আলি, ছিলেন তাদের কাছে ব্রাত্য। অনেকে শুনলে অবাক হবেন, সেই স্রোতে গা ভাসিয়েছিলেন আখতারুজ্জামান ইলিয়াসও। লেখার মতো ইলিয়াসের জিভও ছিল অসম্ভব ক্ষুরধার। তিনি তীর্যক বাক্যবাণের মাধ্যমে জীবনবাদী লেখকদের হেনস্তা করেছেন অনেক। ইলিয়াসকে বাঁচিয়ে দিয়েছে ঊনসত্তরের গণ-অভ্যুত্থান আর একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ। আন্দোলনই তাকে সাহিত্যের সত্যিকারের পথে ফিরিয়ে এনেছিল।

আমি ‘কণ্ঠস্বর’-এর বাঁধানো সেট খুব মনোযোগ দিয়ে পড়েছি। এত নাম-ডাক যে পত্রিকার, এত প্রচার যে পত্রিকার লেখক-কবিদের, সেই পত্রিকায় আমি কিন্তু খুব উন্নতমানের লেখা তেমন একটা খুঁজে পাইনি। ষাট দশকের সেই কলাকৈবল্যবাদী লেখক-কবিদের মধ্যে সবচেয়ে ধারাবাহিক ছিলেন আবদুল মান্নান সৈয়দ। আমৃত্যু লিখে গেছেন তিনি। আহমদ ছফা তাকে পছন্দ করতেন না। বলতেন, ‘মান্নান সৈয়দ হচ্ছে বই পড়ে বই লেখা’ লেখক। কথাটা পুরোপুরি ফেলে দেবার মতো নয়। মান্নান সৈয়দের পঠন-পাঠন ছিল ঈর্ষণীয়। একটানা লিখে চলা আর একটানা পড়ে যাওয়া— এ দুটোই তার নামের সাথে পুরোপুরি খাপ খেয়ে যায়। কিন্তু তার গল্প-উপন্যাসগুলো একেবারেই প্রাণহীন। বোঝাই যায় যে জীবনের রক্ত-মাংস তাদের স্পর্শ করেনি। সেগুলো সবই পাঠ-প্রতিক্রিয়া হিসাবেই সৃষ্ট। আবার কলাকৈবল্যবাদী হিসাবে রাজনীতিমুক্ত সাহিত্য করতে গিয়ে তিনি প্রকারান্তরে সব সরকারেরই ঘনিষ্ট সাহিত্যিকে পরিণত হয়েছিলেন। এমনকি জামাতে ইসলামির সাথেও সখ্য ছিল তার। জামাতের আধুনিক প্রকাশনী থেকে কবিতার বইও বেরিয়েছে মান্নান সৈয়দের। প্রায় রাজকবিতে পরিণত হয়েছিলেন তিনি। এরশাদবিরোধী আন্দোলনে যখন সমগ্র দেশবাসী রাজপথে, তখনো আবদুল মান্নান সৈয়দ এরশাদের সাথে গণভবনে এশীয় কবিতা উৎসবে কবিতা পড়ছেন। সরকারি সব অনুষ্ঠান, রেডিয়ো-টেলিভিশনে তার নিয়মিত উপস্থিতি ছিল অনিবার্য।

আশির দশকে আমার লেখার শুরুর সময়ে আবদুল্লাহ আবু সায়ীদের মতো প্রতিভাবান ও ক্যারিশম্যাটিক সংগঠক ছিলেন না। তবে সেই সময়কার ‘গাণ্ডীব’, ‘সংবেদ’. ‘একবিংশ’ এবং আরো কয়েকটি নেতৃত্বদানকারী পত্রিকা সাহিত্যকে রাজনীতি থেকে দূরে সরিয়ে নেবার প্রয়াস যে চালাচ্ছিল, তা পরিষ্কারভাবেই বোঝা যায়। একই সাথে তারা ছিলেন ভয়ঙ্করভাবে গোষ্ঠীবদ্ধ। তাদের পত্রিকাতে গোষ্ঠীর বাইরে কারো জায়গা ছিল না। সম্ভবত অন্য পত্রিকাগোষ্ঠীর সাথেও তাদের সম্পর্ক ছিল পুরোপুরি পরস্পরকে অস্বীকারের। কেউ কেউ তো ভবিষ্যতের কবিতা কেমন হওয়া উচিত, সে বিষয়ে ইস্তেহার পর্যন্ত প্রকাশ করেছিলেন। এইসব কাগজ, তাদের সম্পাদক-লেখক-কবিরা যথেষ্টই বিভ্রান্ত করতে পেরেছিলেন নতুন লিখতে আসা তরুণদের। এখন বুঝি, তারা অনুপ্রাণিত ছিলেন এলিয়ট-সুধীন দত্তের দ্বারা। এসব থেকে অনেক দূরে বসে নিজেদের মতো লিখে যেতেন মামুন হুসাইন, মাসুদ খানরা। তবে তারাও ছিলেন পুরোপুরি রাজনীতিবিযুক্ত মানুষ।

আমি তখন সবকিছুই মনোযোগ দিয়ে বোঝার চেষ্টা করতাম বটে, তবে এটা জানতাম, এইভাবে লেখা আমার লেখার পথ নয়। অবশ্য লেখার চাইতেও অনেক বেশি সময় দিতাম আন্দোলনে। আর আমাদের জীবনে আশীর্বাদ ছিল স্টাডি সার্কেল। অনেক পাঠচক্র চলত তখন। দর্শনের, রাজনীতির, ধর্মতত্ত্বের, সাহিত্যের, গোপন রাজনীতির। কোনোটা প্রকাশ্য, কোনোটা গোপন। নিজেকে ঋদ্ধ করার এই সুযোগ আমি গ্রহণ করেছিলাম পুরোপুরি। কিন্তু লেখা কোনপথে এগুবে তা নিয়ে পরিষ্কার ধারণা তখনো তৈরি হয়নি। সেই কারণে লেখায় পুরোপুরি নিমগ্ন হতে সময় লেগেছিল আমার।

তবে দশকের হৈ চৈ থেকে দূরে অবস্থান করে নিজের পথ খুঁজে নিতে সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ্, অমিয়ভূষণ মজুমদার, হাসান আজিজুল হক, আখতারুজ্জামান ইলিয়াস, কায়েস আহমেদ, হরিপদ দত্তর গল্প সাহায্য করেছিল আমাকে। সেইভাবে সাহায্য করেছিলেন যতীন সরকার। আমার চোখের ওপর থেকে অস্বচ্ছ পর্দাটি সরিয়ে দিতে ব্যাপক ভূমিকা পালন করেছিল যতীন সরকারের প্রবন্ধের বই, ‘সাহিত্যের কাছে প্রত্যাশা’।

লেখক: কথাসাহিত্যিক