
যতীন সরকার
রক্তমাখা চাঁদের আলো অথবা নিজের কথা
পর্ব ১৫
জাকির তালুকদারপ্রকাশিত : মে ১১, ২০১৯
যতীন সরকারকে আমরা পেয়েছি দেরিতে। একটা কারণ হচ্ছে, তিনি প্রকাশের জন্য লিখতে শুরু করেছেন ৫৫ বছর বয়সে এসে। অপর কারণটি চিরকাল মফস্বলবাস। ঢাকামুখি ছিলেন না কখনো। অবিরাম ও গভীর জ্ঞানচর্চায় নিবিষ্ট ছিলেন। নিজের এলাকায় প্রগতিশীল রাজনীতি করতেন, আর চালাতেন স্টাডি সার্কেল।
জিয়াউর রহমান ক্ষমতায় এসে প্রতিভাবান বামপন্থিদের তালিকা করেছিলেন। তাদের সামনে তিনি দুইটি অপশন দিতেন। তার দলে যোগ দিয়ে মন্ত্রিত্ব বা সমমানের পদ বা দলীয় নেতৃত্ব গ্রহণ করা, অথবা জেলে যাওয়া। যতীন সরকার সানন্দে দ্বিতীয়টি বেছে নিয়েছিলেন। জেলে বসেই তিনি পঠন-পাঠনের পাশাপাশি কিছু কিছু লিখতে শুরু করেন। জিয়াউর রহমান একই সাথে পরখ করে নিতেন লোকটি তার পরিপূর্ণ অনুগত হবে কি না। ব্যক্তিত্বসম্পন্ন হলে তাকে তিনি বাদ দিতেন তালিকা থেকে। ভাষা মতিনকে বঙ্গভবনে ডেকে নিয়ে পরীক্ষা করেছিলেন। তারা কথা বলছিলেন। টিভি চলছিল। জিয়াউর রহমান কমরেড মতিনকে ইঙ্গিত করলেন টিভিটা বন্ধ করে দিতে। এটা পরীক্ষা। কমরেড মতিন হুকুম তামিল করেন কিনা দেখতে চাইছিলেন প্রেসিডেন্ট। ভাষা মতিন জানালেন তার বাড়িতে টিভি নাই, তিনি কোনোদিন টিভি নাড়াচাড়া করেননি, টিভি কীভাবে চালু বা বন্ধ করতে হয় তা তিনি জানেন না। অতএব তিনি এই টিভি বন্ধ করার কাজটি করতে পারবেন না। জিয়াউর রহমান পরে আর ডাকেননি ভাষা মতিনকে। যতীন সরকারের সাথে তেমন কোনো বাতচিৎ হয়নি। তার কাছে প্রস্তাব গিয়েছিল। তিনি প্রস্তাবে সম্মত না হয়ে জেলে চলে গিয়েছিলেন।
জ্ঞানচর্চায় যতীন সরকার কতখানি নিমগ্ন? আর সেইসব জ্ঞান কতখানি আত্মস্থ তার? ইসলামি দর্শন নিয়ে তিনি একটানা তিনঘণ্টা বক্তৃতা দিতে পারেন। কোরান-হাদিস থেকে আরবিতে উদ্ধৃতি দিতে পারেন অনর্গল। বেদান্ত নিয়ে বলতে পারেন ঘণ্টার পর ঘণ্টা। যীশু এবং তার সুসমাচার নিয়ে আলোচনা করতে পারেন অনর্গল। আবার ক্লাস নেবার মাধ্যমে দ্বান্দ্বিক বস্তুবাদ বোঝানোর ক্ষেত্রে বাংলাদেশে তিনিই সেরা।
যতীন সরকারই প্রথম লিবারেশন থিয়োলজি বা মুক্তির ধর্মতত্ত্বকে উপস্থাপন করেন বাংলাদেশের চিন্তাজগতে। তিনি এই তত্ত্বের মাধ্যমে একটি প্রশ্ন উত্থাপন করেছেন, বাংলাদেশে বাম ও ধর্মীয় শক্তির মধ্যে সমঝোতা কি সম্ভব? নিকারাগুয়া, বলিভিয়া, ভেনিজুয়েলা, ব্রাজিলসহ অনেক দেশে যে কয়েক দশক ধরে বামপন্থিরা নির্বাচনে জিতে আসছেন, তার পেছনে বিরাট সহায়ক ভূমিকা পালন করছেন ধর্মযাজকরা। (ব্রাজিলে সদ্য অনুষ্ঠিত নির্বাচনে বাম প্রেসিডেন্ট প্রার্থী পরাজিত হয়েছেন। তবে সেখানেও ধর্মযাজকরা বামকে সমর্থন থেকে সরে আসেননি)।
লাতিন আমেরিকায় এটি কীভাবে সম্ভব হলো? সম্ভব হয়েছে লিবারেশন থিয়োলজি বা মুক্তির ধর্মতত্ত্বের কারণে। ১৯৭০-এর দশকে মেক্সিকোতে এই চিন্তাধারার উদ্ভব ঘটে। পরে তা ছড়িয়ে পড়ে সমগ্র লাতিন আমেরিকায়। সেখানে বাইবেলের নতুন তাফসির করেছেন ধর্মযাজকরা। এককথায় বলা চলে, এই তাফসির হচ্ছে বাইবেলের ‘দরিদ্রমুখি তাফসির’। বাইবেলে দরিদ্রদের প্রতি ভালোবাসা এবং তাদের দারিদ্র্যমুক্তির কথা বার বার বলা হয়েছে। কিন্তু চার্চ সেগুলোকে সামনে আনেনি। নতুন তাফসিরের মাধ্যমে সেই বিষয়টি সামনে এনে দেখা গেছে যে বিশ্বব্যাপী যে পুঁজিবাদী ব্যবস্থা কায়েম রয়েছে তা দরিদ্রকে তার অভিশপ্ত জীবন থেকে মুক্তি তো দেবেই না, বরং বৈষম্য আরো বাড়িয়ে চলবে। দেশে দেশে দারিদ্র্যমুক্তির যে গালভরা কথাগুলো উচ্চারণ করে শাসকরা, তা আসলে কেবলমাত্র মুখের কথাই। তারা বাজেটে সামাজিক সুরক্ষার একটি বরাদ্দ রাখে বটে, তবে তা কেবলমাত্র লোকদেখোনোর জন্যই, বা দরিদ্রদের ধোঁকা দেবার জন্যই। ধর্মযাজকরা খেয়াল করে দেখেছেন যে দারিদ্র্য মানুষের ঈমান-বিনাশী একটি উপাদান। দারিদ্র্যের কারণে মানুষ নিজের সততা এবং আত্মমর্যাদা বিসর্জন দিতে বাধ্য হয়। (ইসলামেও বলা হয়েছে দারিদ্র্য কুফর বয়ে আনতে পারে)। লাতিন আমেরিকার বিভিন্ন দেশের ধর্মযাজকরা সবগুলো দলের কর্মসূচি এবং কর্মকাণ্ড বিশ্লেষণ করে দেখেছেন যে, বামপন্থিরাই কেবলমাত্র সততার সাথে দারিদ্র্যের অভিশাপ থেকে জাতিকে মুক্ত করার ঘোষণা দেয়, এবং সেই ঘোষণা অনুযায়ী কাজ করে। চার্চ তখন সিদ্ধান্ত নেয় বামপন্থিদের সমর্থন করার।
লাতিন আমেরিকার বামপন্থিরাও এগিয়ে এসেছিলেন এই সহযোগিতা গ্রহণ করার মতো মনোভাব নিয়ে। বামপন্থি মানে কেবলমাত্র কমিউনিস্ট নয়, নাস্তিক নয়, এই কথাটা তারা বিশ্বাসযোগ্যভাবে উপস্থাপন এবং প্রমাণ করতে সক্ষম হয়েছেন। সাম্প্রতিককালের বিশ্ববন্দিত নেতা ভেনিজুয়েলার প্রয়াত প্রেসিডেন্ট হুগো শ্যাভেজ নিজের ক্যাথলিক পরিচয়কে আড়ালে রাখার কোনো চেষ্টা করেননি। সেইসাথে তিনি এই কথাটাও পরিষ্কার করতে সক্ষম হয়েছিলেন যে, বামেরা ক্ষমতায় আসা মানেই অতীতের সোভিয়েত ইউনিয়ন বা বর্তমানের কিউবার আদলে সমাজতন্ত্র নির্মাণ করা নয়। বরং তাদের লক্ষ্য হচ্ছে দেশের সম্পদকে বহুজাতিক কোম্পানিগুলোর হাতে তুলে দেবার বদলে দরিদ্র জনগোষ্ঠীর কল্যাণে ব্যয় করার মাধ্যমে জাতিকে সামনে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া। শিক্ষা, স্বাস্থ্য, নারী ও শিশুকল্যাণ খাতে বেশি বেশি ব্যয় বরাদ্দের মাধ্যমে তাদের জীবনের মানকে সত্যিকারের উচ্চতর অবস্থানে পৌঁছে দেওয়া।
আমাদের দেশে ধর্মনেতারা মানুষের ইহলৌকিক মুক্তির কথা না বলে সবসময় দান-ধ্যান-সদকার মাধ্যমে বেহেস্ত ক্রয়ের জন্য কালোটাকার মালিকদের নসিহত করাতেই ব্যস্ত। সেইসাথে তাঁরা দুর্নীতি, দুঃশাসনের বিরুদ্ধে না দাঁড়িয়ে নিজেদের সর্বশক্তি ব্যয় করেন বামপন্থিদের নাস্তিক ঘোষণা ও মুরতাদ ঘোষণার মাধ্যমে সাধারণ মানুষের মনকে বিষিয়ে তোলার কাজে।
আবার এদেশের বামপন্থিদের কাছে ধর্মযাজক মানেই মধ্যযুগীয় ধ্যানধারণার প্রবক্তা, অশিক্ষিত, কুয়োর ব্যাঙ, বৃহত্তর দেশ-জাতি নিয়ে চিন্তা করতে অক্ষম একটি জনগোষ্ঠী। তাই এইদেশে লাতিন আমেরিকার মতো কোনোকিছু ঘটার সম্ভাবনা এই মুহূর্তে অন্তত নাই। তবে পরস্পরের মধ্যে সংলাপের পরিবেশ অন্তত তৈরি করা যে দরকার, তা উভয়পক্ষের কেউ কেউ এখন ভাবতে শুরু করেছেন।
এই চিন্তা আদৌ বাংলাদেশে প্রস্ফুটিত হবে কি না তা বলার সময় আসেনি। তবে যতীন সরকার তার প্রস্তাবনার মাধ্যমে এই সম্ভাবনা খতিয়ে দেখার চেষ্টা কামনা করেছেন। যতীন সরকারের সাথে প্রথম সাক্ষাতে আমাকে মুগ্ধ করেছে তার হাসি। শুনেছি নজরুলের হাসি ছিল ছাদভাঙ্গা। তার হাসি দেখা বা শোনার সৌভাগ্য হয়নি। কিন্তু কথায় কথায় প্রাণখোলা হাসি হেসে ওঠার ক্ষমতা যতীন সরকার ছাড়া আর কারো মধ্যে দেখিনি আমি। বাংলাদেশের অনেক বুদ্ধিজীবীর মুখ দেখে মনে হয় রামগরুরের ছানা, অথবা আবাল্য কোষ্ঠকাঠিণ্যে ভোগা মানুষ। যতীন সরকারই হাসতে জানেন কথায় কথায়। তাতেই বোঝা যায়, মানুষটা নিজের ভেতরে গোপন কিছু রাখেন না, বা গোপন করার চেষ্টা করেন না। সেইসাথে বুদ্ধিজীবীসুলভ ভান-ভনিতাও করেন না।
কারো সাথে অ্যাপয়েন্টমেন্ট থাকলে আমি সচরাচর সময় মেনে চলি। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে যতীন সরকারের সাথে প্রথম অ্যাপয়েন্টমেন্ট আমার ছিল জঘণ্য টাইমিং-এর উদাহরণ। সকালে জলযোগে যোগ দেবার কথা, সেই আমি গিয়ে পৌঁছালাম প্রায় মধ্যাহ্নে। আমি যেতে চাইছিলাম না। সঙ্গী গনী আদম সাহস যুগিয়ে বলল-- যতীন স্যার এসব ব্যাপারে কোনো মাইন্ড করেন না। আপনি চলেন।
আমি গেলাম। সময়ের ব্যাপারে লজ্জার কথা বলতে গেলে তিনি ফুৎকারে উড়িয়ে দিলেন, আরে তুমি হলে অতিথি। মানে অ-তিথি। তিথি মেনে যে আসে না। তোমার সময় গোলমাল হতেই পারে। বড় ভালোবাসেন তিনি আমাকে। প্রায় অন্ধ স্নেহ তার আমার প্রতি। লিখতে লিখতে কোনো শব্দ বা তার প্রয়োগ নিয়ে ঠেকে গেলে যখন-তখন তাকে ফোন করেছি। তিনি তাৎক্ষণিক সমাধান দিয়েছেন। তিনি যেভাবে আমাকে উৎসাহিত করে চলেছেন, তার কোনো তুলনা হয় না।
একটা ঘটনার কথা আমার মনে চিরস্থায়ী দাগ কেটে রেখেছে। যতীন সরকারের বাংলা একাডেমি পুরস্কার প্রাপ্তি এবং তার সত্তর বছর পূর্তির অনুষ্ঠান হয়েছিল জাতীয় জাদুঘরের সুফিয়া কামাল মিলনায়তনে। অনুষ্ঠানটি খুবই আন্তরিক এবং জনাকীর্ণ ছিল। ঘটনাটা অনুষ্ঠান নিয়ে নয়। অনুষ্ঠান উপলক্ষে প্রকাশিত স্মরণিকা নিয়ে। বিভিন্ন গুণীজন লিখেছেন তার সৃজনকর্ম নিয়ে। সবশেষে আছে যতীন সরকারের একটি সাক্ষাৎকার। অনেক বিষয়ে কথা বলেছেন তিনি। শেষ প্রশ্ন ছিল, নতুন প্রজন্মের লেখকদের মধ্যে কারা আপনার কাছে গুরুত্বপূর্ণ?
তিনি উত্তর দিলেন, এভাবে কারো নাম বললে কাইজা বেধে যেতে পারে। তাই আমি কারো নাম বলতে চাই না। তবে কিনা জাকির তালুকদারের নাম আমাকে বলতেই হবে। নইলে অবিচার হয়। কে জানে আমার নাম উচ্চারণ করার কারণে কেউ যতীন সরকারের সাথে কাইজা করতে গেছেন কিনা! তবে আমি অন্তত তার এই বাক্যকে বা অন্য কারো প্রশংসাবাক্যকে আমার বইয়ের বিজ্ঞাপন হিসাবে কখনো ব্যবহার করিনি।
এখন তিনি বাতে আক্রান্ত হয়ে খুব কষ্ট পাচ্ছেন। চলতে-ফিরতে পারেন না, লিখতেও পারেন না ঠিকমতো। ফোন করলে কণ্ঠে সেই একই ভালোবাসার সুর। তবে বলতে ভোলেন না, শুনো তোমরারা কিন্তু এই সময় আমারে দেখতে আইসো না। আমার এই শরীর নিয়া ঠিকমতো তোমাগোরে দেখাশোনা-আপ্যায়ন করতে পারুম না। আমি সুস্থ হইলে তখন আইসো।
ডাক্তার হিসাবে মেডিক্যাল সায়েন্সের এই সীমাবদ্ধতার কথা আমি জানি। জানি তিনি এই বয়সে আর আগের মতো সুস্থ হতে পারবেন না। তাই মাঝে মাঝে অমান্য করি তার আদেশ। চলে যাই তার নেত্রকোণার বানপ্রস্থ নামের বাড়িতে। নইলে নিজের চিন্তাগুলোকে নবায়ন করা এবং যাচাই-বাছাই করে নেওয়া যে সম্ভব হয় না।
লেখক: কথাসাহিত্যিক