রক্তমাখা চাঁদের আলো অথবা নিজের কথা

পর্ব ৬৬

জাকির তালুকদার

প্রকাশিত : অক্টোবর ০৪, ২০১৯

নারীময় জীবন আমার। নারীরাই আমার জীবনীশক্তির রসদদাত্রী। নারীপ্রভাবিত জীবন আমার। বলার প্রয়োজন পরে না যে আমার জীবনে নারীর অবদান অপরিসীম।

আমার মা, দাদি, বড়বোন, ছোটবোন, নানি, কাজিনগণ, আমার প্রেমিকা (পরে স্ত্রী), স্বল্পকালীন ও দীর্ঘকালীন বান্ধবীগণকে বাদ দিলে আমার জীবন বলতে তো কিছুই থাকে না। নিশ্চয়ই উল্লিখিত সকলের ভালোবাসা এবং অবদানের রকমফের আছে। কিন্তু অনুল্লেখযোগ্য কেউ নন। আরো কিছু নারীর সাথে আমার সম্পর্ক হয়েছে এবং রয়েছে। সেই সম্পর্কগুলোর কোনো নাম নেই। সংজ্ঞায়িত হয়নি এমন অনেক সম্পর্কই। কিন্তু তাই বলে সেগুলোর অবদানও আমার জীবনে কম নয়।

নারীদের কাছে এই অপরিশোদ্ধ ঋণের কথা স্বীকার না করলে নিজেকে ছোট করা হয়। আমার সাহিত্যিক সত্তা নারীমুক্তিকে কোনভাবে উপস্থাপিত করে তা একবার ভেবে দেখা যেতে পারে। এযাবত নিজের লিখিত গল্প-উপন্যাসের দিকে তাকিয়ে দেখতে পাই, নারীকে আলাদাভাবে উপস্থাপন করার কোনো প্রয়োজন ঘটেনি আমার। নারী-পুরুষ মিলিয়ে সংসার, পরিবার, সমাজ, রাষ্ট্র, পৃথিবী। তাই গল্প-উপন্যাসে নারী এসেছে পুরুষের মতোই স্বাভাবিকভাবে। আমার সর্বাধিক পরিচিত মধ্যবিত্ত, নিম্ন-মধ্যবিত্ত, প্রান্তিক মানুষের জীবনই এসেছে আমার সাহিত্যে। সেখানে দেখতে পাচ্ছি, পুরুষ দায়িত্ব ছেড়ে পালালেও নারী কখনো পলায়নপর হয় না। সবচেয়ে দুঃসহ পরিস্থিতিতে নারী যতটা শক্ত হয়ে দাঁড়াতে পারে, পুরুষ ততটা পারে না। অনেক পরিবার দেখেছি আমি যেখানে পুরুষ স্ত্রী-সন্তানের দায়িত্ব পালন না করে নির্বিকার দিন কাটায় বা সরে থাকে। কিন্তু নারী নিজের সন্তানদের ফেলে পালায় না। সংসারের সমস্ত বিষ হজম করে নীলকণ্ঠ নারী যুদ্ধ চালিয়ে যায়। যেখানে নারী পরাজিত হয়, সেখানে সমস্ত পরিবারটিই ধ্বংস হয়ে যায়। সত্যি বলতে এগুলো কোনো পূর্ব নির্ধারিত ছক ধরে আসেনি আমার গল্প-উপন্যাসে। এসেছে স্বাভাবিক মানবিক সূত্র মেনেই।

আমাদের দেশের পত্র-পত্রিকায়, ভিজুয়াল মিডিয়ায়, এবং ফেসবুকে যেসব নারী বিষয়ক রচনা এবং প্রতিবেদন দেখা যায়, সেগুলো মূলত পুঁজিবাদী চিন্তার এনজিও-নারীবাদের প্রতিফলন। পড়ালেখা, চাকুরি, হাঁস-মুরগি পালন এইসব দিয়ে অর্থনৈতিকভাবে কিছুটা স্বাবলম্বী হও, নিম্নবিত্ত থেকে নিম্ন-মধ্যবিত্ত শ্রেণীতে উত্তীর্ণ হও, তোমার যদি দৈহিক সৌন্দর্য থাকে তাকে বিজ্ঞাপন-শোবিজে পণ্য বানাও। সমষ্টিগত উন্নয়নের কথা না ভেবে কেবল নিজের জন্য উপরে সিঁড়ি খুঁজে নাও। পুঁজিবাদী সমাজে যেমন টাকা উপার্জনের পথে কোনো নৈতিকতা-মূল্যবোধ বাধা হয়ে দাঁড়াতে পারে না, তেমনই তোমার স্বাবলম্বিতা অর্জনের ক্ষেত্রে কোনো নীতি-নৈতিকতাকে বাধা হিসাবে দাঁড়াতে দিয়ো না। দরকার হলে নিজের জন্য আলাদা নৈতিকতা তৈরি করে নাও।

বলাবাহুল্য, এই প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে আমরা বেশকিছু নারীকে সমাজের মধ্য এবং উচ্চপদে অধিষ্ঠিত করতে পেরেছি। কেবল কোটা দিয়ে নয়, প্রতিযোগিতাতেও নারীরা জিতেছে এবং নিজের জন্য জায়গা করে নিয়েছে। কিন্তু সার্বিক নারীমুক্তিতে তা কতখানি অবদান রেখেছে? এই যে সফল নারীগণ, তাদের প্রত্যেকের সফলতার পেছনে ব্যাপকভাবে দাঁড়িয়ে আছে আরো বেশ কয়েকজন নারী। বাড়ির বুয়া, সন্তানের আয়া, বাবুর্চি, দেশের বাড়ি থেকে নিয়ে আসা কিশোরী গৃহকর্মী। পুঁজিবাদ বা এনজিও-নারীবাদ এরচেয়ে বেশি কিছু পারে না। কারণ তাদের টার্গেট গ্রুপই হচ্ছে উচ্চবিত্ত এবং মধ্যবিত্ত নারী। এবং আমাদের দেশে যাদের নারীবাদ নিয়ে উচ্চকিত হতে দেখি, তাদের প্রায় শতভাগ এই দুই অর্থনৈতিক এবং সামাজিক অবস্থানের নারী।

সবধরনের নারীবাদীরাই ধর্মকে নারীর মুক্তির পথের বাধা হিসাবে উল্লেখ করে থাকে। বর্তমান পৃথিবীর বড় ধর্মগুলোর মধ্যে সবচেয়ে নবীন ধর্মটির বয়স দেড় হাজার বছর। অন্যগুলো হাজার হাজার বছর আগেকার। সেই সময়ের প্রেক্ষিত বিবেচনায় নিলে নারীদের প্রতি ধর্মের নির্দেশ হয়তো তখনকার হিসাবে যথেষ্ট প্রগতিশীল মনে হতে পারে। আবার কোনো কোনো ধর্ম নারীকে নিয়ে আলাদাভাবে চিন্তা করার প্রয়োজন মনেই করেনি। তখনকার সমাজে নারীর যে অবস্থান ছিল সেটাকেই ধর্মীয় অনুশাসনের মধ্যে জায়গা করে দেওয়া হয়েছিল। সক্রেটিস-প্লেটো-এরিস্টটল যতই অগ্রসর চিন্তার মানুষ হোন না কেন, দাসপ্রথাকে অপরিহার্য হিসাবেই মেনে নিয়েছিলেন। কারণ সমাজের অর্থনৈতিক ভিত্তিটাই তখন ছিল দাসপ্রথার ওপর নির্ভরশীল। কিন্তু আজকের সমাজের সবচেয়ে পশ্চাৎপদ অংশের মানুষও দাসপ্রথার অস্তিত্ব এখন কল্পনাই করতে পারে না। কাজেই ধর্মীয় অনুশাসনে নারীর অবস্থান নিয়ে বেশিরভাগ মানুষ, বিশেষ করে নারীরা, এখন অসন্তুষ্ট।

মার্কসবাদের জনক কার্ল মার্কস এবং ফ্রেডরিক এঙ্গেলসকে দায়ী করা হয় এই বলে যে তারা নিজেরাই যাপন করে গেছেন পুরুষতান্ত্রিক জীবন। অভিযোগ অমূলক নয় পুরোপুরি। তবে নারীমুক্তির কথা তারা ভেবেছেন ঠিকই। যদিও তারা নারীমুক্তিকে শোষিত শ্রেণীর মুক্তির সাথে এক করে দেখেছেন কিছুটা যান্ত্রিকভাবেই। পরবর্তী মার্কসবাদী চিন্তাবিদরা, যাদের মধ্যে লেনিন, মাও সেতুং-ও আছেন, তারা কিন্তু কেবল শ্রেণীদৃষ্টির মধ্যে নারীমুক্তির ব্যাপারটিকে আটকে রাখেননি। ক্লারা জেটকিন, এলিয়া এরেনবুর্গ, রোজা লুক্সেমবুর্গ নারীমুক্তির চিন্তাকে এগিয়ে নিয়ে গেছেন মার্কসবাদের মূলনীতির সাথে সঙ্গতি রেখে। মাও সে তুং বলতেন, নারীরা দুইবার শোষিত হয়। একবার শোষক শ্রেণীর দ্বারা, দ্বিতীয়বার পুরুষতান্ত্রিকতার দ্বারা। একটা বাইরের জীবনে, অপরটি প্রধানত ঘরে-সংসারে।

তাই আধুনিক জগতের মার্কসবাদীরা মনে করেন, নারীর সার্বিক মুক্তির জন্য দুইবার বিপ্লব করতে হবে। একবার সার্বজনীন বিপ্লব। সেই বিপ্লবে শোষিত মানুষ মুক্তিলাভ করবে পুঁজি এবং শোষণের শৃঙ্খল থেকে। দ্বিতীয়টি সাংস্কৃতিক এবং মূল্যবোধের বিপ্লব। যা নারীকে মুক্তি দেবে সমাজে জমে থাকা অবশিষ্ট পুরুষতান্ত্রিকতা থেকে।

পুঁজিবাদ শিল্প, সাহিত্য, নারী, যৌনতা-- সবকিছুকে পণ্য বানায়। বিশাল সংখ্যক লেখক-শিল্পীর মতো অসচেতন নারীসমাজও নিজেদেরকে পণ্য সাজিয়ে বিপণনের সারিতে দাঁড়িয়ে থাকে আমাদের বিকৃত বিকলাঙ্গ সমাজে ও রাষ্ট্রে। আমি আমার সাহিত্য এবং প্রিয় নারীজাতিকে সেই পণ্যের বাজারে দেখতে চাই না।

লেখক: কথাসাহিত্যিক