রথো রাফি

রথো রাফি

রথো রাফির ১০ কবিতা

প্রকাশিত : আগস্ট ২২, ২০২০

ইশ

ইশ, তুমি যদি তার মতো হতে!
যে পুষ্পপবিত্রতা ছিন্ন করে লাফিয়ে ওঠে
দেখতে তারা তাচ্ছিল্যের রাতে
এ মুখ আশ্চর্য আলো দেয়
কী যে মৃত্যুমদিরতা ভরা
আর কী যে মৃত্যুমাধুর্যে উপচে ওঠে তার প্রাণ
নিষ্প্রদীপ রাতে মনে হয় এ বুকই সেরা কবর
এবং সেরা আশ্রয়
মনে হয় এমন বুক আর কোথায় পাওয়া যাবে!

তার মতো কে বলে আর, তুমি কি
মৃত্যুর মতো যাকে এড়াতে পারি না আমি
যেদিকেই যাই যেদিকে পালাই
দেখি অসম্ভব তোমার দিকে না যাওয়া!

আমি শুধু ভাবি, যা কিছু শাশ্বত মনে হয়
তা কত না ক্ষণস্থায়ী!
বিদ্যুৎ চমকের মতোই
ফের কেন মনে হলো—
ইশ, তুমি যদি তার মতো হতে!

সবই পরিবর্তনশীল, কিন্তু কেন আমার
এমন পরিবর্তনহীনতা, ভেবে পরমুহূর্তেই
কেমন চমকে উঠি আমি!

মনে হলো, এ কি!
তোমাকে তোমার মতো হতে না দিয়ে
নিজের কাতরতার কাছে যেনো
বলি দিতে চাই তোমাকেই!
কেন তুমি তার মতো হবে!

তবু কেমন চমকে উঠেছি আজ
এ পৃথিবীতে পুষ্পের আয়ু সত্যি সবচেয়ে কম!

তবু তোমার এ মুখ দেখে মনে হলো
ইশ, তুমি যদি তার মতো হতে!
তেমন করে কে বলে আর...
তোমার বুকই আমার প্রিয় রাজধানী!

মেঘের সাদা নৌকা

কেন একটা নদী তার দিকে এতো সহজে
এত সহজে গড়িয়ে যায় শুধু গড়িয়ে যায়
কেন আমি এমন পাহাড়
আর আকাশ এমন নীল ছাতা যার তলে
দিনরাত বয়ে চলে বয়ে চলে আদিম মেঘের
সাদা নৌকাগুলো
আহা দিনরাত শুধু ভেসে চলে ওরা
এক দিগন্ত থেকে আরেক দিগন্তে
দেখি কাউকেই নেয় না ওরা বুকে
তারা তো পাখি, ভাবি ভার কে হতে চায়!

আর কেন আমি এমন পাহাড়
যার বুক থেকে ছুটে যায় ছুটে যায় শুধু নদী
যে ডুবিয়ে মারে না কাউকেই
শুধু ডুবে মরে যাই আমি বারবার
চুড়ির মতো বাজে না এখানে সোনার শূন্যতা!

তবু ওই নদী কী ব্যাকুল স্বরে বলে যায়—
আমি যমনুা, রাধা, আমি যুমনা
তোমাকে ডুবিয়ে বারবার মৃত্যুর খুনী হতে চাই আমি
খুনী হতে চাই এ জীবনে যতোবার পারি
রাধা, দেবে না দ্বার খুলে আমাকে সে সুযোগ!

যে দিগন্তেই যাই নদীর সেই কল কল ধ্বনি
শুধু শোনা যায়, আর কী আদিম তার বয়ে চলা
শুধু পায় না সে আকাশের নাগাল
বুকে যার জেগে থাকে তার ছবিখানি শুধু!

প্রকৃত হাসি

প্রিয় জল তোমাকে ডাকছি, এ দিগন্তে এসো। তৃষ্ণার প্রান্তরে এসে নামো। নিজের কল্পনা দিয়ে সবুজ করো এ পৃথিবী। নিজের রচিত সতেজ সবুজ ডালাপালায় গড়ো নীড়। এক ডাল থেকে আরেক ডালে লাফিয়ে চলো। দেখো কী অদ্ভুত লাগে! শুধু তখনই অনুভব করতে পারবে তুমি, কী করে এ জগৎ পাল্টে যায় তোমার নির্লোভ ও প্রকৃত হাসিতে!

ক্রন্দনশীল দিগন্ত

ধ্বনিয়মান হংসলাঞ্চন শেষ হলে শুরু অঙ্কুরন। আশাময় অন্ধকারের স্বপ্নাঘাতে ছিন্নভিন্ন জীবনপবিত্রতার গানের গভীরে দেখা দেয় তোমার চেহারা।
লোভের নীল আঘাতে ধ্বস্ত হয়ে কী পবিত্র হয়ে আসে অদৃশ্য আত্মা। আর তা জুড়ে বসে দৃশ্যমান চেহারার নীল মলাটে। কিন্তু কোথায় পাবে আর নিষ্পাপতা। হারানো সরলতার দেশ থেকে আসে বসন্ত বাতাস নরকে নীরবে। আর অগ্নিশিখা আরও কী দারুণ হাসে। আর কী নিদারুণ নাচে। যেনো তোমাকে স্নান করাবে। যেনো আরও নগ্ন করে তোমাকে আয়নার সামনে দাঁড় করাবে। যদিও তুমি বারবার আয়নার সামনে থেকে পালাতে চাও শত শতাব্দি দূরে। যদিও তুমি অন্যকে বারবার বারবার আয়না দেখাও। আর হিংস্র বাঘের মতো তুমি দেখতে বাধ্য করো তাকে। ভীতু কন্ঠ থেকে বেরিয়ে আসে তার হাহাকার— সজারু তোমার আলিঙ্গনে পৃথিবীর সবচেয়ে আরাম! তুমি হাসবে। আর তোমার হাসিকে বিশ্বাস করতে পারবে না তুমি।
তুমি নিজেকে বিশ্বাস করতে পারো না বলে অন্যকে বাধ্য করো তোমাকে বিশ্বাসে। পবিত্রতা সে তো গ্রন্থবন্দি স্বপ্নের অশ্লীল গল্প। আর তার বাইরের জগতটাকে করে রেখেছে নরক। বই দিয়ে মানুষের জীবনকে মাপতে গিয়ে তুমি স্রেফ অপবিত্র করে ফেলেছো জগৎটাকেই! হংসধ্বনি শোনো, কিন্তু চোখ মেলে দেখতে পাও— সাদা হাঁস বলে কিছু নেই। জীবন নয়, অন্যের দেখা স্বপ্ন আর দুঃস্বপ্ন নিয়ন্ত্রণ করছে তোমাকে। যদি জানতে। ওগো ক্রন্দনশীল দিগন্ত আমার। তোমার গভীরে তুমি কি আজও নিজের নরকের পেলে না দেখা। কী করে অশ্রুঝরণাকে হত্যা করবে তুুমি। সপ্নসন্ত্রাসের সোনার শিখা থেকে কী করে নিজেকে বাঁচাবে তুমি! তুমি কি নরকের লাকড়ি হবে শুধু! বইয়ের পৃষ্ঠা থেকে বেরিয়ে এসো এ দিগন্তে। যেখানে শুদ্ধতা অলৌকিক। এই ব্যাকরণবৈরিদিগন্তে আমাকে দেখে তোমার হাসি জ্বলুক লালাসিক্ত রাক্ষুসীর উপবাসী জিভের মতো। জ্বলুক আত্মগ্লানীহীন, স্বপ্নহীন, দুঃস্বপ্নহীন আর গ্রন্থহীন। আর অস্তিত্বহীন আকাশই একমাত্র ছাদ। এই নীলদৃষ্টিভ্রমই একমাত্র ভ্রমশূন্যতা। আর সব ছাদই অশ্লীল!

অন্ধজগৎ

অন্ধ শামুক, তুমি জানো তোমার জগত কেমন!

প্রতিদিন ভোরে উঠে গলির মোড়ে এসে দেখতে পাই
দাঁড়িয়ে আছেন অন্ধলোকটি
দুহাত বাড়িয়ে রেখেছেন হাওয়ায়
আমি তাকে কিছুই দিই নি কোনোদিন।
দেখি সেই আগের মতোই বসে আছেন থুত্থুরে বুড়ি
বাড়িয়ে রেখেছেন দুহাত।
দেখছেন কিছু না দিয়েই আমি কেমন অপলক
সামনে চলে যাচ্ছি।

অন্ধ শামুক, তুমি জানো তোমার জগত কেমন!

স্বপ্ন


কবিতার মূল্য যদি
ততটা হতো তার কাছে
তাহলে বলতে পারতাম
শব্দের যুমনায় এসো ডুব দাও
দেখো সোনার মাছ
তোমাকে সঙ্গ দেবে
বিষণ্ণতার পৃথিবীতে
তোমার মন
একটু হলেও ভালো হবে
আর বাঁশির শব্দ তোমাকে
উপহার দেবে
সেই অপূর্ব বর্ষা
সূর্যহীন দিনে যার স্পর্শে
ছোট ছোট সূর্যে ভরা
আশ্চর্য কদম গাছ
হয়ে উঠবে তুমি
বিষণ্ণতার জগতে
তুমি নিজেই হয়ে উঠবে
অতুলনীয় হাসি
কবিতার মূল্য যদি
ততোটা হতো তার কাছে
আমি হতাম
সত্যি তার প্রিয় অন্ধকার!

শরত সন্ধ্যা


সন্ধ্যা নামে যখন মনে হয় মেঘে আগুন লেগে গেছে
যারা ওর দিকে তাকায় তারাই ভাবে এ তার হৃদয়

যারা বিষণ্ণ তারা দেখে অনল কিভাবে পোড়ায়
যারা সুখী তারা দেখে বিষাদের মেঘ
কিভাবে সোনা হয়ে উঠে প্রাণের আলোর ছোঁয়ায়
আমি জানি না মেঘের ধুসর রঙ কী বলে
মেঘের সোনার রঙ আসলে কী বলে

শুধু দেখি আহা জলের যেখানে
এই আগুন লাগা আকাশ জেগে আছে
সেখানে কখন থেকে দুটি ক্ষুদে মাছ
খেলা করছে আপন খেয়ালে
ভাবি তাদের দিকে যেনো বিষণ্ন কেউ না তাকায়

আমিও জানি তাদের দিকে তাকানোর অবসর নেই
প্রেমের সোনারঙ যাদের হৃদয়ের দখল নিয়েছে
তারা আত্মহারা নিজের ভেতরেই মশগুল
আর বাইরের সোনার মেঘ শুধু অপূর্ব ঈশারা
ঠাঠা হেসে ওঠার নেচে ওঠার আর লাফিয়ে ওঠার
জানি অর্থহীন হেসে ওঠার সময়েই মানুষ সবচেয়ে সুখী

সুপ্রাচীন গান

কোনো হরিণই বাঘের মুখে গলা পেতে দেয় না
কিন্তু তোমাকে দেখবো কি আজ কিংবা আগামীকাল...

তুমি জানো, বাঘ তার শিকারের জন্য
কখনও নিজেকে অপরাধী মনে করে না
অথচ তুমি জপছো ভুল স্বীকারের অসম্ভব গান
আর ক্ষমা ক্ষমা...!
বলো, ক্ষমা কাকে, নিজেকে, কেন? বলো তো কাকে বলে ক্ষমা!

যখন ক্ষুধা নয়, স্রেফ আনন্দের অন্ধকারে
বিনোদনের চূড়ায় বসে সে
শুধু রক্তপাত দেখে যেতে চায়
সেই বাঘ, হরিণের হাসি নয়, চিৎকারে যার
সেরা বিনোদন
আর অপরাধ অস্বীকারের এমন দিনেও কি
আবার দিতে চাও তুমি রক্তমাংস উপহার
বলো তো, নিজের কাছে নিজে সস্তা হলে
কে তোমাকে দাম দেবে এ জগতে
বাঘ কি ক্ষমায় ভুলে যাবে তার শিকারি স্বভাব
বাঘ কি স্বীকারোক্তির পরও পররক্তের শিখায়
নিজের পিপাসাকে গনগন করতে দেখবে না
থাবায় এতো শক্তি যার কী করে বিনয়ী হবে
সে ফের প্রতিশ্রুতির শেকল কাল কিংবা পরশু ছিড়বেই
তবে প্রজ্ঞার নীল অন্ধকার তোমাকে আজ কী বলে কে জানে...

আগের মতোই আমি শুধু দেখি একেকটি পাতার সঙ্গে
ঝরে যায় একেকটি নীলাভ ইতিহাস
কত ক্ষমার আর কত অপরাধের
আর মাটি ধীরে মুছে নেয় সব যেমন নিয়েছে আগে
আমি শুধু দেখি সেই প্রাচীন মাটিতেই নতুন গাছ জেগে ওঠে
ফের গান গায়, গান গায় সেই মূর্খ বসন্তের
ফের হরিণের বোকামিকে গৌরব দেয়
আমাদের পৃথিবীর কত কত চালাক মানুষ
আর নারীরা হরিণের সঙ্গে নিজেকে মিলায়
আর ভাবে সেই বাঘই আমার চায়
যে কামড়ে কেড়ে নেবে গলা থেকে তার শেষ নিঃশ্বাস!

হৃদয়

ব্ল্যাক বোর্ডের পাশে
শুধু চকের বাকসো থাকে না, ডাস্টারও থাকে
যতো লেখা, তত মুছে চলা...
আর এভাবে শিশুরাও তত শিক্ষিত হয়
আর তত বড়ো হয়

সকলেই পড়ে নিবিড় হয়ে, আর কত কিছু ভাবে

বানান শিখেছিলো একদিন
তাই বলে বারবার শব্দ বানান করে করে
কেউ আর পড়ে না

মনে রাখা কি ভালো নয়
হাঁটতে শেখার পর কেউ আর হাঁটা ভুলে না
যতো আছাড়ই খাক
সে শুধু সামনে হেঁটে যায়
পেছনে তাকিয়ে পা ছাড়িয়ে কেউ কাঁদে না

তাহলে কেন ভূলে যাবে
ব্ল্যাকবোর্ডের পাশেই থাকে ডাস্টার
যতো লেখা তত মুছে চলা আর তত বড় হওয়া

কে না জানে এইতো জীবনের ধর্ম
জন্মের পর কোনোদিন ছোট হয় না গাছ!

আর এবার বিদায়

মূল কবিতা: জেরোস্লাভ সেইফার্ত

বিশ্বের লাখ লাখ কবিতার মাঝে
আমি তো বড়োজোর দুয়েকটা যোগ করেছি।
প্রজ্ঞায় তারা হয়তো ঝিঁঝির চিৎকারের বেশি কিছু নয়।
আমি জানি। ক্ষমা করবেন আমাকে।
আমি শেষের প্রান্তে এসে যাচ্ছি।

তারা হয়তো এমনকি প্রথম পদচ্ছাপও ছিলো না
চাঁদের ধুলায়।
যদি কখনও তারা ঝিলিকও দেয়
তা তাদের নিজের আলো নয়।
আমি এই ভাষাকে ভালোবাসতাম।

আর যা ওই নীরব ঠোঁটজোড়াকে
ব্যাকুল করে তোলে
তরুণ প্রেমিকদের তা বাধ্য করবে চুম্বনে
যখন তারা ঘুরে বেড়ায় সোনায় মোড়ানো প্রান্তরে
আকাশ তলে সূর্যাস্তের সময়ে
যে সূর্যাস্ত অনেক ধীরলয়ের গ্রীষ্ম এলাকার চেয়ে।

কবিতা ছিলো আমাদের সাথে সেই আদি থেকেই।
যেমন প্রেম।
যেমন ক্ষুধা। যেমন মহামারী। যেমন যুদ্ধ।
কখনও আমার কবিতা ছিলো অসহ্যরকমের
বোকা।

কিন্তু এ জন্য কোনো অজুহাত দেখাই না।
আমি বিশ্বাস করি খুন-খারাবির চেয়ে
অন্তত ভালো
অপূর্ব কথার সন্ধান।