রহমান মুফিজ

রহমান মুফিজ

রহমান মুফিজের কবিতা ‘মুখোমুখি’

প্রকাশিত : আগস্ট ২৬, ২০২০

কবি রহমান মুফিজের জন্ম ১৯৭৯ সালের ১৭ মে, কক্সবাজারের চৌফলদণ্ডিতে। সম্পাদনা করেছেন শিশুকিশোর ম্যাগাজিন `শিশির` ও ছোটকাগজ `আদিঅন্ত`। প্রকাশিত কবিতার বইগুলো হচ্ছে, বিপরীত বিনাশ (২০০৫), বিষনগর (২০১২), রহমান বাড়ি যাও (২০১৮) এবং মাউথঅর্গান যেভাবে বাজে (২০২০)। পেশা সাংবাদিকতা।

মুখোমুখি ১

সারারাত সিলিংয়ে জাবর কাটা ফাঁসের রজ্জুটা সকালে হয়ে যায় নিজস্ব গ্রাফিতি। কতটা দুর্মর বিষাদের ঝঞ্ঝা পেরিয়ে এমন বিবর্তন এসেছিল সে ভোরে— কেউ জানবে না। সহস্র রজনীর নির্ঘুম চোখে কোনো পৌরাণিক ব্যথাও পাবে না খুঁজে কোনো প্রেমিক। ফোলা ফোলা চোখ শুধু নক্ষত্রের নির্লিপ্ত আগুন হয়ে যাবে।
একটা পার্ক দৌড়ে যাবে তোমার কাছে। একটা সকাল শালবনের রোদ মেখে তোমার মুখোমুখি দাঁড়ালেই বলবে, কী খবর বিষ্ণু? ঘুম হয়েছে গত রাতে?
কে ঘুমায় এই মহামারিতে? সঙ্গ নিরোধের অগস্ত্য যাপনে কেউ কি পায় নিরঙ্কুশ রতি? তুমিও কি পাও নিশির নিদান!
কী হয়েছিল বলো কাল রাতে? ইতিহাসের দেরাজ থেকে কোন্ গ্লানি তুলেছিলে খুঁড়ে? কোন বীভৎসতা, কোন্ ট্রাজেডি তোমার বুক ভারি করেছিল? নাকি সব আলিঙ্গনের নাম রেখেছো কেবলই খুন...
তোমার শিবসত্তা চণ্ডী রূপ নিয়ে নিলে জাগতিক উৎপাত থেকে হয়তো ছুটি পেয়ে যাবে রাতগুলো, হয়তো সেমেটিক দুঃখগুলো প্রতিটি নক্ষত্রে রেখে যাবে প্রমিত অর্গাজম। তা বলে তোমার মুক্তি মিলবে— এমন ভেবো না সোনা।
যে নদ সুদূর হিমবাহ থেকে গড়িয়ে এসে উষ্ণ ভাটিতে নদী নাম নেয়, তার কি কোনো দুঃখ আছে? তবে আমাদের কেন?
কেন শুধু শুধু বিরক্ত করে চল প্রবহমানতাকে?

মুখোমুখি ২

মানুষ একা হতে হতে শূন্য হয়ে যায়। শূন্য থেকে কেউ আর স্পন্দন হয়ে ওঠে না অবরুদ্ধ আত্মায়। চেনা মুখ যদি ভালবাসে সঘন আরশি, কে তখন ডাক দেবে আমার নাম?
প্রতিবেশী প্রেম এখনো ছাদে যায়, শিশুগুলো সারাদিন সরোবর ছন্দ হয়ে থাকে বেলকনিতে। ঝড়ের রাত বলে থেমে নেই পুষ্পের প্রজনন। জানলার গ্রিলের কাছে প্রতিদিন কত কত হাত রোদ হয়ে ওঠে, তা ভার্চ্যুয়াল পোস্টে চালান করেও কান্না থামাতে পারছে না কেউ।
কান্নায় কী লাভ, কান্না কী দেবে দুর্দিনে? যারা রোজ মরছে তারা রোজ বেঁচে যায়। আর এ গ্লানি বেচে খাওয়া মানুষেরা তোমারই তো পঞ্চায়েত, আমারই তো গৌরব। জ্বর-জারি পেরিয়ে একদিন সকলেই প্রবল নৈরাজ্য হয়ে যাবে। আমাকে বলবে, তুমি কে ভোলা? দ্যাশ কই তোমার?
আমি কি বলব তখন, এ জন্ম আমি চাইনি, এ দেশও আমার নয়। নাকি বলব, আমি তোমাদের বখে যাওয়া ধর্ম, যার কোনো প্রতিনিধি নেই; বলব, আমি একটা অথর্ব সংবিধান?

মুখোমুখি ৩

কী অরণ্যবৎ মেঘ ছিল সেদিনের আকাশে! বিচ্ছিরি নীরবতার বাহুল্য ছিল গোটা শহরে। একটা অরাজনৈতিক চাঁদও উঠেছিল বুদ্ধের নাম নিয়ে। এই ছবি দেখতে দেখতেই ভেবেছিলে বুঝি গত জীবনের সুতো ছিঁড়ে আজ বিহঙ্গে রূপ নেবে! হলো না। উপরন্তু নিপুণ পূর্ণিমার নিচে বিছিয়ে দিয়েছিলে উজাড় ক্রন্দন।
যখন দেখতে পেয়েছিলে গ্রেভ ইয়ার্ডের সারি সারি প্রস্তরখণ্ড থেকে ঝরে পড়ছে পরিচিত নাম— তবুও কেউ চুম্বন লুকোচ্ছে না; তখন তোমার কার মুখ মনে পড়েছিল? মৃত পিতার? নাকি মায়ের রান্নাঘরের সুগন্ধ পার হয়ে হাঁটছিলে নিজের ক্ষুধার দিকে?
ক্ষুধা কখনো কখনো আত্ম-জিজ্ঞাসা হয়ে ওঠে। যখন শিশুরা মারা যায়, আত্মজারা উঠে যায় সাদা পোশাকের গাড়িতে, প্রতারক আঁকে নিষ্পাপ গোলাপ, মর্গে বেড়ে যায় অনামি শব, তখনও জেগে থাকে ক্ষুধা, বেঁচে থাকে  ইন্দ্রিয়।
আমি সেই রাতের কথাই বলছি— যখন কোনো শব্দ থেকেই ঝরে পড়ছিল না উলঙ্গ আকাশ, তোমার প্রতিবিম্ব নেচে উঠছিল জলে, নেচে উঠছিল স্থলে— কী ভেবেছিলে তখন? কার নামে জমা দীর্ঘশ্বাসগুলো বুকের ওপর দিয়ে চালিয়ে নিচ্ছিল ট্রেন?
সেই রাতের কথাই বলছি— যখন যাচ্ছিলে ঈশানে দুঃখের দিকে, ডুকরে ভাজা ভাজা কান্না হয়ে উঠছিল ভুলগুলো, নিজের শরীর থেকে গুলিয়ে বেরিয়ে পড়ছিল প্রতারক রক্ত— তুমি তখনও বিশ্বাস রেখেছিলে একটি হাতে, একটি ক্ষুধায়। কেউ তার মূল্য হয়ে উঠবে না জেনেও বলেছিলে— মানুষ তবু্ও ভালবাসে, দুঃখ পেয়ে কাঁদে, তাই তাকে বিশ্বাস করা যায়...

মুখোমুখি ৪

তুমি কে— এ প্রশ্ন আদি। একই বয়সের তপোবনে শিশুর মতো কথা কয়— আমি কে?
অধীর হৃদয় সব ছেড়েছুড়ে জীবজগৎ পেরিয়ে আসে এই ক্লীবদের শহরে। এখানে করাতের আদর নিতে নিতে বিক্ষত বুকের দিকে তাকিয়েই দেখি বাজছে কফিল আহমেদের কনসার্ট। বাজছে— পাখির ডানায় দারুণ শক্তি, গরুর চোখে মায়া...
কী বিস্ময় তুমি গুঁজে দিয়েছো চোখের পাতায়, কী অমর অট্টহাসি বুনে দিয়েছো ভিখিরির প্রাসাদে; যেন বা সিংহের পেটের মতো গৌরব চারিয়ে দিয়েছো চারিদিকে। সম্মোহনে আমি ঘুমিয়ে পড়ি। ঘুমের মধ্যে হারিয়ে ফেলি নিজের বাড়ি। অচেনা অন্দর থেকে হেঁটে হেঁটে গোয়ালহাট নামের অচেনা জংশনে থামি। ওই জংশন আসলে একটা টেরাকোটা।  মেঘডুবির চেয়ে অন্ধকার, প্রলয়ের চেয়ে ভাঙচুর।
আচারের বয়ামে মসলার ঝোল, তেল চকচকে লোল যখন চেতনা ফেরায়, দেখি মুখের ওপর ঝুলে আছে আকাশের পাকস্থলি।
আমার প্রশ্নরা বেঁচে যায় তোমাকে দেখে। কারণ মায়াকোভস্কি তোমার জন্যই লিখেছিলেন শিরদাঁড়ায় উৎপন্ন একটা বাঁশির কথা। আহা! কী অমোঘ পরিণতি দেখো— আমার জানলার গরাদের কাছে প্রতিদিন একটা করে সকাল এঁকে দিয়ে যাচ্ছে একঝাঁক নয়নতারা। আর এস্কিমোদের জীবন থেকে বারবার ওঠে আসছে শীতল প্রেরণা।
তোমার চোখের দিকে তাকাতেই আমি পেয়ে যাই উত্তর। কারো কারো মুখ যে পৃথিবীর উত্তর হয়ে আসে, বিশ্বাস করো, এই প্রথম জানলাম। এই প্রথম নিঃসঙ্কোচে আমি কাঁদলাম...

মুখোমুখি ৫

আমার নামে একটা চিঠি এসেছে কাল সকালে। প্রেরকের নাম নেই খামে। সিল ছাপ্পরও নেই কোনো পোস্টাপিসের। দরজার নিচ থেকে গলিয়ে দেয়া একটা শাদা স্মৃতির ওপর অপরিচিত অক্ষরে লেখা— `প্রিয় মিথ্যুক`।
এই সমরের রাত, গুলি খাওয়া হ্রদ, পরিখার নিচে লিখে চলা নবজাতকের বায়োগ্রাফি, সন্তর্পণে গুটিয়ে নেয়া চুম্বন, অতল নিদ্রার ভেতরে হেঁটে চলা বিষণ্ণ যোদ্ধা— কিছুই কখনো প্রকাশ্য প্রতিমা পায়নি। আমার ঢালু শরীরে সঞ্চারিত ভয় প্রতিদিন উৎসব করছে নরকে। রোজকার যে সংখ্যা আমি লুকিয়েছি তার প্রতিশব্দ তো `নিরেট হত্যা`। কিন্তু আমি তাকে বলেছি— ভালো, শান্তি ও উন্নয়নের জন্য সব বুলেটই পবিত্র।
যে প্রার্থনা ও দরুদ প্রিয়তম রাজগৃহের দিকে নিবেদিত হচ্ছে তাকে কেউ প্রেম ভাবছে, ভাবছে ভক্তি। অথচ সেটা কপট স্তুতিতে ভরপুর নিপুণ ষড়যন্ত্র ছাড়া কিছুই নয়। কেউ লজ্জা ঢাকতে গোটা সংবিধানকে করে তুলছে বিশুদ্ধ বর্ম। প্রত্যেক অবিচারের নাম দিচ্ছে আইন ও ধর্ম।
অথচ, বাউল রণেশ ঠাকুর ভস্ম উঠানে দাঁড়িয়ে বলছেন— কোনো অভিযোগ নেই কারো প্রতি। তার একতারা, করতাল, পুড়ে যাওয়া গানঘর আমাদের সভ্যতার চিৎকার হয়ে উঠলো শেষে। যেমনটা শরিয়ত বয়াতি, রীতা দেওয়ানের কোমরের রজ্জু হয়ে উঠলো শ্বাসটান ওঠা রাষ্ট্রের নেবুলাইজার। কার্টুনিস্ট কিশোরের হাতকড়াই এখন রাষ্ট্রের সবথেকে বড় ব্যাঙ্গচিত্র— এ সত্য ঢেকে আমি কি স্বর্গোদ্যান অব্দি পৌঁছুতে পারব?
আচ্ছা, শেখ হাসিনা তার দরজার নিচে কি গতকাল একই চিঠি পেয়েছেন, যেখানে প্রাপকের ঘরে লেখা— প্রিয় মিথ্যুক?

মুখোমুখি ৬

কার মাংস খেয়ে বাঁচো তুমি? জিহবায় কিসের স্বাদ মেখে আছো আজও? এই যে হাঁটো, নড়োচড়ো, বিছানায় গড়াও— গড়িয়ে গড়িয়ে ছলনার মতো ঢুকে প`ড় নিজের গুহায়, সেটা কি সত্যিকার স্বপ্ন? কোন্ শস্যঘ্রাণ থেকে তুমি হঠাৎ সম্বিৎ ফিরে পেয়েছিলে? বলো, কার দুধভাত খেয়ে তুমি বাঁচো? কার পাতে হানা দিতে দিতে বুড়ো হচ্ছ রোজ?
আমি শিশু, শ্লেটে আঁকছি পতাকা নয়, প্রবঞ্চনা। আমি শিশু, প্যাস্টেলে ঘসে ঘসে বার করছি মানচিত্র। আমি শিশু, ফুল নয় কাঠপেন্সিলে খনন করছি আমার ঠিকানা। তুমি বলো, আমার শৈশব কোথায় রেখেছো লুকিয়ে? কার টিফিনের পয়সা খেয়ে তুমি লিখতে বসেছো জেল্লাদার আত্মজীবনী। কোন্ সহৃদয় শ্রমের ঘনায়িত ঐশ্বর্যে লিখে চলছো নিজের কীর্তি?
তুমি ফিরিয়ে দেবে আমার প্রতিধ্বনি— বিশ্বাস করি না। তোমার তরবারি কেটে চলেছে তোমারই পা, তোমারই নিম্নাঙ্গ। তোমার আগুনে অবিরত পুড়িয়ে পুড়িয়ে কাকে বাসছো ভালো? কাকে বিশ্বাস করাতে চাও তোমার এখন দারুণ রতিবিদ্যা হয়েছে রপ্ত। শীৎকার মানে এক টুকরো উৎসব— এই প্রবন্ধ লিখে তোমার পাকা জ্ঞান কাকে বিলাচ্ছ আজ?
তুমি কি একা একা ঘুমের মধ্যে কাঁদো? কখনো কোনোদিন আমার মুখ মনে করে এঁকেছো একটা অনভ্যস্ত হাতের ল্যাম্পপোস্ট?
এখানে তো কেউ একা একা কাঁদে না, একা একা হাসে না। বঞ্চনার সমবায় গড়ে তোলা ছাড়া কেউ বুক দিয়ে একবারও বার করে আনে না ব্যক্তিগত সুখস্মৃতির কোনো চিরকূট। তুমি বলো, এই অকথ্য বাস্তবতায় কোনো রতিউৎপন্ন শহর কি নিজেকে চিনতে পারে? নাকি সমেহনে উজাড় করে চলে সমস্ত সন্তাপ!
বলো, কার কণ্ঠ খেয়ে, শৌর্য খেয়ে বাঁচো তুমি? কার রক্তে নিজেকে আবিষ্কার করো একটা প্রসন্ন চোখ হিশেবে!

মুখোমুখি ৭

পৃথিবী গড়াচ্ছে তোমার বুকের উপর। উদয়াস্তের অনন্ত চক্রে ঘুরে ঘুরে সিঁটি বাজাচ্ছে একশোটা সূর্য। নতুন নাম নিয়ে, ঢিব ঢিব বুক নিয়ে কেউ কেউ খসে পড়ছে নিজের চরিত্রের ভেতর। বৌ-চি খেলা ভেঙে যাচ্ছে ধীরে। এইগুলো বয়স হলেই ভেঙে যায়। ছুঁয়ে দিলে মরে যায় প্রত্যেক আগুন।
তোমার জন্য মায়া হয়— তোমার মুখের প্রতিভা ম্লান হতে হতে কালি হয়ে যাচ্ছে। সেই কালি চালান হয়ে যাচ্ছে কলমে। কলম থেকে ফের জন্ম নিচ্ছে তোমার মুখ।
তোমার জন্য মায়া হয়— তুমি নবনির্মিত মুখও আর তুলতে পারছো না সরল জ্যোৎস্নার দিকে। তুরীয় নিনাদ থেকে প্রপতিত হচ্ছ দুর্লঙ্ঘনীয় ক্রন্দন।
হায়! আমি তো কাচের চেয়ে সচ্ছ হৃদয়ের দিকে তাকিয়ে পড়েছি হাওয়ায় নাম। তবে আদমের এই দশা কেন আজ! যে মুখচ্ছবি বিহ্বল ঘ্রাণ নিয়ে এসেছিল বসন্তের বিকেলে সে কেন হীম সন্ধ্যা এখন!
আমার পাহাড়েরা বিরান। বিরানে পুড়ে যাচ্ছে কেঁচোর শরীর। ঊর্বরতারহিত এই পূর্ণাঙ্গ দিনে শুকিয়ে কাঠ সমস্ত প্রার্থনা। কামিনী মোরগ এখন ডাকছে না কেন— সে প্রশ্ন হাওয়ার কাছে করবেটা কে?
আমি দুরন্ত চোখ শুধু তাকিয়ে থাকি নিঃশব্দ জরার দিকে, জরায়ূর দিকে। সাপের মতোন প্যাঁচিয়ে থাকি দুজনের দূরত্বের অবসরে।
আমাকে ক`টা দিন ফেলে রেখে যাও উলঙ্গ সৈকতে। মৃত ডলফিনের হাড় থেকে জন্ম নিক অরব গর্জন। আমাকে ক`টা দিন ফেলে রেখে যাও তোমার জন্য।

মুখোমখি ৮

অনেক ভয় পেয়েছি আমি। চিরসত্য আনন্দ যখন অক্লান্ত বিষাদ হয়ে আসে— সকলেই ভয় পায়, আমিও পেয়েছি। মানুষ যখন চর্বিত মৃত্যু হয়ে আসে, কপট প্রেম হয়ে ওঠে বাগানবিলাসের ছায়া, প্রতিদিন একই হাস্যকর বিবৃতি হত্যাকারীর দায়মুক্তি হয়ে ওঠে তখন ভয় পাওয়াটা অনভিপ্রেত। তবুও ভয় পেয়েছি আমি। অনেক ভয়।
কে কে পাওনি ভয়, হাত ওঠাও। যদি নৈরাজ্য কবুল করে থাকো, পরাঙ্মুখ দৃশ্যমণ্ডলীকে ভেবে থাকো তোমাদের নিবিড় বারান্দা, তবে হাত ওঠাও। ভয় না পাওয়া লজ্জার কিছু নয়। বিবেকের প্রশ্নের কাছে প্রতিনিয়ত অসংলগ্ন উত্তর হওয়ার চেয়ে জপমালা হাতে সেলফি তোলা ভালো। রানীর কোনো শরীক নেই— এই মন্ত্র অন্তরঅব্দি পৌঁছালেই মুক্তি পাবে আত্মদংশন থেকে। জপো— রানী এক ও অদ্বিতীয়। জপো— রানীই মুক্তি রানীই যুক্তি। বলো— অবিশ্বাসীদের গাঁড় মারো রাণী, আমাদের পার করে দাও পুলসেরাত। দেখবে রাষ্ট্রীয় সংগ্রহশালায় জমা হচ্ছে তোমাদের বীরত্ব। তোমাদের স্তুতিই হয়ে উঠবে মহাকালের বিস্ময়!
দেখবে এইখানে আমলনামায় হত্যার কোনো চিহ্ন খুঁজে পাবে না কেউ। অবিচারের ইতিহাস লুপ্ত হয়ে যাবে। চাবুকের দাগ, কান্নার ফসিল কিছুই পাবে না খুঁজে কোনো প্রত্নবিশারদ। ঢাশা ঢাশা বই লিখে ঢেকে দেয়া যাবে পীড়নের এই সভ্যতা। দেখো সেইসব লেখক শানাচ্ছে কলম, শানাচ্ছে লিঙ্গ। পদকের দাবি নিয়ে ছুটে যাচ্ছে রাজমহলে। যারা যাচ্ছে না, তারা নাস্তিক। রানীতে অবিশ্বাসী বলেই তাদের ঘাড়ের কাছে নিঃশ্বাস নিচ্ছে বেয়াড়া তরবারি। সেপাই-শান্ত্রী-মাস্তানদের ব্যাপক ভালো দিন আজ। দুদিকেই কাটছে তারা— কচুর মতো কাটছে বাতাস।
আর যারা ভয় পাওয়া না-পাওয়ার মাঝখানে ঝুলছে, তারা বিপজ্জনক। তারা ত্রিশঙ্কু চাষা, শ্রমিকের পোলাপান, গরিবের বাচ্চা। তারা পার্কে প্রেমিকার ঠোঁটে চুমু খেতে গিয়ে দারোগার রোষের মুখে পড়েছে। তারা প্রেমিককে বাঁচাতে গিয়ে শুয়েছে পুলিশের সঙ্গে। তারা য়্যুনিভার্সিটিতে হেব্বি রক্স। বুকের মধ্যে চে’র ছবি এঁটে গাইছে ছোট পাখির গান— তারা বিপজ্জনক!
কিছুক্ষণ আগেও যে খুনির মুখ আমি টিভিতে দেখেছি, তাকে একটা প্রেমপত্র লিখবো ভাবছি। না হলে যে কোনো সময় আমার হাতে এঁকে দিয়ে যাবে সুসভ্য হাতকড়া। মধ্যরাতে অভিসারি বুলেট এসে বুকের কাছে ঘাই মেরে বলবে— তুই একটা শুয়োরের বাচ্চা!

মুখোমুখি ৯

নিজেকে জমা রেখে যাচ্ছি ছোট ছোট জানলায়। কপাটে কপাটে এঁকে দিয়ে যাচ্ছি বাতাসের সঙ্কেত। তোমার কানে পৌঁছুবে কিনা নদীর শিস— জানি না। তবুও কোনো মৃত্যুদৃশ্য থেকে যদি ফণা তোলে সুগন্ধের স্মৃতি, তার কাছে জানতে চেয়ো, সে কখনো আলিঙ্গন করছিল কিনা নিজের নাম। কখনো পাহাড় থেকে গড়িয়ে হাতির পালের মতো নেমেছিল কিনা লোকালয়ে, আর শুধু পিষে মেরেছিল কিনা দুধের শিশুদের— জিজ্ঞাসা করো। কারণ এইসব প্রশ্নের উত্তর জানা থাকলে তুমি ভালো কত্থক নাচতে পারবে। খোঁপায় নির্দ্বিধায় গুঁজতে পারবে হাতির দাঁতের কাঁটা।
তোমাকে বহুবার বলেছি আমার মেরুদণ্ড কুমিরে খেয়েছে, তাই ভালোবাসবার মুরদ হারিয়েছি। তবুও এই মিথ্যাকবলিত জনপদে আর একটি প্রলাপও আছে কিনা তোমাকে নেশা ধরাবার জন্য, জেনে নিও।
যে মুখ আমি রেখে যাচ্ছি সুললিত আয়নায়; নির্বন্ধিত এক তলপেটের কাছে— সে মুখ জঘন্য। সে মুখ আনাড়ি গ্রহের কাছে পেয়েছে সন্তের সমাদর। পর্ণহাবে অজস্র সঙ্গমের দৃশ্য দেখেও যে মুখ কোনো শীৎকার শেখেনি তার রাষ্ট্রভাবনা প্রধানমন্ত্রীর মতোই নেহাত শিশুতোষ হবে, সে তোমার আগেই জানা উচিত ছিল। এখন আর দুষলে চলবে না। প্রতারিত হতে হতে আমি তো তুমি হয়ে গেছি।
তোমাকে হত্যা করবার জন্য রাতের ঘুম জেরবার করে বারবার জপছি তোমারই চোখের তসবিহ। তোমার দূরাগত হৃদস্পন্দন শুনতে শুনতে আমার চোয়ালে নেমে আসে ভোর, গলায় নেমে আসে রজ্জু, বুক বরাবর অকস্মাৎ বুলেট! আমি গৎবাঁধা বিবৃতি হয়ে পড়ে থাকি শালবনে...
শালবনে আজ আসার কথা নয়। যদি টিভিতে দেখতে পাও অযাচিত কোনো খুনের খবর, চলে এসো। আমি তোমার নেশা টুটিয়ে দেব! মাইরি বলছি!

মুখোমুখি ১০

শেষ কথাটা লেখবার আগে আমার ভীষণ তৃষ্ণা পেয়ে যায়। মাতৃদুগ্ধের কথা মনে পড়ে। মাতৃস্তনে শেষ ঠোঁট রাখবার ঘটনা এমন শূন্যাহত স্মৃতির কাছে ঠেসে ধরে যে, কোনো উপায় থাকে না বিরহের মুখামুখি হওয়া ছাড়া। সন্তানদের দুধ ছাড়াতে মা স্তনের বোঁটায় তিতকরলার রস মেখে রাখতেন। দুধ ছেড়ে একা মেঠোপথ পাড়ি দেওয়া একটা অপুষ্ট হৃদয় কতটা সক্রিয় প্রেম তুলে রাখতে পারে শোণিতে? বলো...। আমাকে অস্পৃশ্য রেখে দিলো আমারই আশ্রয়। বড় হতে হতে যে ইতিহাস আমি জানলাম সেখানে আর মা নেই। আছে ব্যথাভারাতুর অসংখ্য নারী। তাদের গল্প শুনতে শুনতে আমি মা হয়ে যাই। আমার বুকেও গজায় দুধেল স্তন। এই দেখো, কেবলই চকোলেট মেখে রেখেছি আমার বুকে। চকোলেটের গন্ধ যখন নাকের কাছে তোমার লালার তীব্র আগুন হয়ে আসে তখন ভাবি— আমি বোধহয় শেষপর্যন্ত নারীই হতে চেয়েছিলাম। আর একটা পোড়া-পতিত জমিতে ছোট্ট সরোবর হতে চেয়েছিলাম সমস্ত বিচ্ছেদাপন্ন রাতে।
কারো কারো মুখের দিকে তাকিয়ে ঊনঘুম রাতের একেকটা আহত সারসের ডাক শুনি। তবুও কেউ সরল সুরের মতো খুলে ধরে না করপুট। শেষ চুম্বনের আগে তুমি যেমন লুকিয়েছিলে তোমার জখম, শেষ স্পর্শের আগে গুটিয়ে নিয়েছিলে রক্তের প্রদাহ, তেমনই একটা পৃথিবীর কাছে নতমুখে বলেছি— আমাকে তোমার ঋতুশ্রাবের দিন বানিয়ে দিক। অথবা একটা দেবদারু— যার নিচে নখ খুঁটে খুঁটে নিজের কাছে বলতে নিজের কথা। ঘাসের দিকে আনমনে চেয়ে থেকে বলতে— সব শরীরই গর্ভধারণে সক্ষম। সব শরীরেই জন্ম নেয় বৈভব। ব্রহ্মের অণ্ড সবখানে, ডিম্বাশয় রয়েছে পুরুষেও। তুমি তো এখন আর কথাও বলো না। মুড সুইং হলে মা মনে হয় তরকারিতে নুন বেশি দিতেন। বাইপোলার ডিজঅর্ডার তখন প্রেসক্রিপশন হয়ে ওঠেনি। আজ যখন ডাক্তার বলে দিচ্ছেন অসুখের শিরোনাম, তখন খালি ঘুমের ওষুধেই কেন সূর্যোদয় খুঁজছো তুমি?
শেষ কথা লেখবার আগে মায়ের কাছে ফিরি। শেষ কথা লেখবার আগে তোমার দেয়া অক্ষরের কাছে হাত রাখি। দেখি, আমাকে করা তোমার সম্বোধন সব শুধু কথার কথা; চিৎ হয়ে শুয়ে থাকে দেরাজে।
তুমিও বুকের কাছে তিতকরলার রস মেখে আছো আজ? দুধছাড়ানোর কায়দা বুঝি সব স্তনধারীদের জানা? তবে আমি কেন জানি না। আমিও তো তোমার জলছাপ হয়ে থাকি সকাল-সন্ধ্যা-রাত!
শেষ কথা লেখবার আগে চলো দুজন দুজনের পোশাক বদল করি। দুজনের দেহ বদল করে ঘুমিয়ে পড়ি চাঁদের নিচে। শেষ কথা বলবার জন্য বেছে নিই জোৎস্নার অবিরত হট্টগোল...

মুখোমুখি ১১

আজ তোমার কাছে যাব। যেতে যেতে একটা পথ নিয়ে যাব শহর থেকে দূরে। তোমার বাড়ির কাছে খুঁজে পাব উদ্বিগ্ন মগকাঁটা। তোমার দরজার কাছে পেয়ে যাব ঐশ্বর্যময় ঝগড়া। তুমি মারকুটে, তুমি সুদৃশ্য রাগী চোখ। আমার হাতে খেলনা পিস্তল। তোমাকে লুট করবো বলে কিনে রেখেছি বহু আগে।
মৃত্যুকবলিত নৈঋর্ত পার হয়ে তোমার কাছে পাবো জানি হৃদয়ের সম্ভাষণ। তুমি মিছেমিছি ঝড়ের শব্দ থেকে ধার নেবে কেন রাগ। আমার হিমপ্লাবনের ভেতর যে রক্ত কথা বলে, তার দুঃসাহস যদি জানতে, নিশ্চয় তুমি আমাকে কিনে দিতে একটা সেক্স টয়। দেখো, আমাকে ফিরে আসতে হয় এমন আনজাম করো না।
তোমার কাছে যাব, অনেকদিন পর অন্ধকারের লালার ভেতর খুঁজে নেব আণবিক রতি। এলে আমাকে জড়িয়ে ধরো; বিভিন্ন হৃদয়ের প্রপতিত আনন্দ শুনতে কান রেখো বুকের কাছে। পাকস্থলিতে রেখো হাত, তাতে সব ধরনের ক্ষুধাই দেখবে তড়পাচ্ছে।
গতরাতে হঠাৎ উঠে আসলাম তোমার কালসিটে চোখের কোটর থেকে। ইন্দ্রিয় থেকে নিপতিত এক শুক্র জেনে গিয়েছে প্রজ্ঞা, শীল ও সমাধি। সিদ্ধার্থ জানে কেন যাচ্ছি তোমার দিকে। বাৎস্যায়ন জানে ঋষিরও প্রয়োজন ধ্যান, কামসাধনার মহাজাগতিক উত্তাপ থেকে জন্ম নেয় প্রজ্ঞানন্দ। তুমি কি জান না শ্রীকৃষ্ণ অক্ষম আর অবদমিতের আশ্রয়? অথবা রাধাও নির্বাণের শক্তি? রাধাও তো প্রকারান্তে কৃষ্ণ!
আমি এই হতোদ্যম মূর্খদের জঙ্গল পেরিয়ে যাচ্ছি তোমার কাছে। যেতে যেতে শিখছি দ্বাদশ নিদানের পরিচ্ছেদ। আমাকে গ্রহণ করলে তুমি পাবে অজ্ঞমেধার হাওয়া, পাবে কুলকুণ্ডলিনীর অর্ঘ্য।
কী চাইছি আমি, জেনে নিয়ো তোমার ঘুমের কাছে, তোমার অনিদ্রার কাছেও জিজ্ঞেস করতে পারো এই সমস্ত যন্ত্রণা কোথা থেকে আসে; মিলিত হয় কোন ত্রিবেণীতে। দেখো তোমার কাছে যাবার প্রস্তুতি আমাকে কেমন অপরাহত যোগী করে তুলেছে। করে তুলেছে একটা সাদা খাতা, একটা যোগাসন, একটা শিশুর আকুতি।
আজ তোমার কাছে যাব। তাই একটা ক্যাটবেরিও কিনেছি। অবশ্য রাধা কখনো ক্যাটবেরি খেয়েছে কিনা— খোঁজ নিতে হবে একবার...

মুখোমুখি ১২

সুফলা দুঃখ তোমার বীজ বুনে দিয়ে যাও ঊর্বরা রাতে। পতিত চাষার চোখে বিম্বিত হোক ধানের শরীর। জমি বেহাত হলে বুকের পাঁজরে রুয়ে দিয়ে যাও নিজের পরিচয়; এভাবেই তো বেঁচে থাকে প্রাচীন দৌলত। দুঃখের শস্য হেসে ওঠে রুক্ষ মাটিতে। দিনের জলসা ভুলে গেছে যে প্রবীণ পুত্র তার কাছে রাতের আঁধারই বিকশিত পলি। সুজলা প্রেম একদিন আসবেই, অন্নপূর্ণা দেশ তোমাকেও দিয়ে যাবে ভরপুর পেট। কোনো পুরুষই আর মিথ্যে বলবে না, দেখে নিয়ো।
এই ক্ষণকালে তোমার বিমুখ মুখের সর্বস্ব আঁকা রইলো স্মৃতিতে। সব অভিযোগ পূর্ণাঙ্গ প্রত্যুত্তর হয়ে আছে রজঃপ্রাপ্ত আগামীর জন্য। এমন কোনো দিন আর আসবে না যেখানে একেকটা দরজা থাকে, আর থাকে দরজার সামনে কাঁচা কাঁচা কফিন। মৃতদের দেশে মৃত্যু এক বাহুল্য স্ফূর্তি ছাড়া কিছু নয়। কাজেই আইসিইউগুলোতে শিগগিরই বরফ জমবে। সেখানে আমরা উইকঅ্যান্ড উপভোগ করতে যাব। তুমি গোছগাছ করে নাও, একটা নেহাত দেশি ভোদকা যোগাড় করে রেখো। মাথা ধরবে যদিও, কিন্তু মনে রেখো, মৃতদের মাথা থাকে না। মাথার মিথ্যে অবয়বকে জাতিসংঘ ভুলভাল নাম দেয়। বলে, মাথা মানেই মানুষ! মাথা মানেই অধিকার! হাসি পায় না? বলো?
এই যে আমার হৃদস্পন্দন লুকিয়ে তোমার প্রেমের কাছে দাঁড়িয়ে থাকি, তার খবর ওরা রাখে? এই যে ন্যাকা ন্যাকা কবিতা লিখে তোমাকে ভোলাই, এ ষড়যন্ত্র নিয়ে কোনো প্রধানমন্ত্রী কখনো আলাপ তুলেছিল ওখানে? রাবিশ একেকটা! নিজের বিছানা হারিয়ে এরা এতটাই হতোদ্যম হয়ে পড়েছে যে, সাধারণ সভায় শুধু স্বপ্নদোষ আর মিথ্যে শীৎকারের গল্পই বলে যায় বছর বছর। তুমি চিন্তা করো না, এই বোকা কবির চৌষট্টিকলাই একদিন তাদের পাঠ্য হবে। আমার বিছানা নিয়ে নানান প্রশ্ন রাখবে বিসিএসের রিটেন, ভাইভায়। আমার চোখ ব্যবচ্ছেদ করে ওরা আবিষ্কার করবে পৃথিবীর সবচেয়ে নবীনতম জনপদ— যেখানে কখনো কোনো প্রধানমন্ত্রী জন্ম নেবে না। জন্ম নেবে না কোনো বোকাচোদা রাষ্ট্রপতি।
এই ঊর্বরা রাতে এইসব ভাবনার কল যারা নাড়ে তারা ইশ্বরের পাপ। সুফলা প্রেম যদি না আসে, দেখে নিও আমাদের কোনো ঘর জুটবে না। ঘর মানে বুক। বুক মানেই শস্যভরপুর গান। যা তুমি ভুলে গেলেও চাষা কখনো ভুলবে না।