রহমান মুফিজের গদ্য ‘রোজিনা ইসলামের উপর এই নিপীড়ন কেন’

প্রকাশিত : মে ১৮, ২০২১

তথ্য সংগ্রহে সাংবাদিকদের জন্য পৃথিবীতে কোনো স্বীকৃত নিয়ম নাই। যে কোনো সোর্স থেকে, যে কোনো মাধ্যমে, যে কোনো উপায়ে তথ্য সংগ্রহ করে সেটা জনগণের সামনে মুক্ত করে দেয়া সাংবাদিকদের দায়িত্ব ও কর্তব্য। ফলে স্বাভাবিকভাবেই দুর্বৃত্তায়িত রাষ্ট্র ও সরকার সবসময় চায় নানা আইন করে, নীতিমালার গ্যাড়াকলে ফেলে মুক্ত সাংবাদিকতা ও অবাধ তথ্যপ্রবাহের ধারাকে রুদ্ধ করে দিতে।

নিরাপত্তা ও সার্বভৌমত্বসম্পর্কিত কিছু গুরুত্বপূর্ণ বিষয় ছাড়া প্রজাতন্ত্রের গোপনীয়তা বলতে কিছু থাকতে পারে না। কারণ এই কথিত `গোপনীয়তা` রক্ষার আইনই আমলাতন্ত্রের সব ধরনের দুর্নীতির দায়মুক্তি দেয়, অন্যায্য ক্ষমতাকে পাকাপোক্ত করে। সেইসাথে আমলাতন্ত্রের সাথে গাটছড়া বাঁধা দুর্বৃত্তপনায় নিমজ্জিত জনপ্রতিনিধিদেরও নানা সুবিধা দেয়। ব্রিটিশরা এই ধরনের নীতি ও আইনের আশ্রয় নিয়েছিল। কারণ তারা ছিল দখলবাজ ও কর্তৃত্ববাদী ভিনদেশি শাসক। জনগণকে জবাবদিহিতার কোনো দায় তাদের ছিল না। ফলে জনগণের ওপর শোষণ-শাসন, সম্পদ লুণ্ঠন ও পাচার নির্বিঘ্ন করতে ওইসব আইনই ছিল তাদের হাতিয়ার। তাহলে জনগণের সর্বময় কর্তৃত্বস্বীকৃত এই স্বাধীন ও গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে কীভাবে এই আইন জায়গা পেল? কারা, কার স্বার্থে এই আইন বলবৎ রাখলো? জনগণকে বোকা বানালো কারা? এইসব আইন তৈরির জন্য আমরা যাদেরকে সংসদে পাঠাই তারাই কি তবে জনগণের স্বার্থ জলাঞ্জলি দিয়ে একটা গোষ্ঠীকে নিরংকুশভাবে দুর্বৃত্তপনার সুযোগ করে দিচ্ছে? এই প্রশ্ন তুলতে হবে জনগণকেই। কারণ জনগণই রাষ্ট্রের পাহারাদার। জনগণই রাষ্ট্রের জমিদার।

দাপ্তরিক গোপনীয়তা আইন ১৯২৩ বলবৎ ছিল বলেই ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের ৩২ ধারায়ও এ আইনের সাজাকে অন্তর্ভুক্ত করতে পেরেছে সরকার। প্রথম থেকেই এর বিরোধিতা করে এসেছি আমরা। সাংবাদিকদের বিশাল অংশ স্পষ্টই বলেছিল, এই আইন মুক্ত সাংবাদিকতার জন্য বাধা হয়ে দাঁড়াবে। সরকারের তরফ থেকে বুঝ দেয়া হয়েছিল, এই আইন সেইসব অপরাধীদের জন্য যারা রাষ্ট্রের গোপনীয়তা ও স্বার্থ খর্ব করে। প্রধানমন্ত্রী বলেছিলেন, যারা অপরাধী তারাই এ আইনকে ভয় পাবে। প্রশ্ন হচ্ছে, সাংবাদিকতা কি তবে অপরাধ? যে সাংবাদিকতা দুর্বৃত্তপরায়ন রাষ্ট্র ও সরকার এবং তার প্রশাসনের স্বরূপ উন্মোচন করে সে সাংবাদিকতাই কি এখন রাষ্ট্র বা সরকারের প্রতিপক্ষ হয়ে দাঁড়িয়েছে? সরকার কি তাই মনে করছে? তা নাহলে সাংবাদিক রোজিনা ইসলামের উপর এই নিপীড়ন কেন? তিনি কী এমন গোপন নথি হাতিয়ে নিয়েছেন, সেইটা কার স্বার্থেই বা আঘাত করেছে সেইটা জনগণ জানতে চাইতেই পারে।

কয়েক বছরে সরকারের লুটপাটনীতি যেভাবে উলঙ্গভাবে প্রকাশিত হয়েছে, আমলাতন্ত্রের লাগামহীন দুর্বৃত্তপনা যেভাবে উন্মোচিত হয়েছে, তাতে এই দেশে কোনো ব্যবস্থা সুষ্ঠু আছে, তা বিশ্বাস করে না কেউ। জনগণের প্রতি জবাবদিহিতার বালাই নেই ক্ষমতাসীনদের। কারণ জনগণের ভোটের তোয়াক্কাও এরা করে না। বিরোধি কোনো রাজনৈতিক দলই তারা অবশিষ্ট রাখেনি। বিরোধী মত ও চিন্তার উপর উপর্যুপরি পীড়ন চালিয়ে, ভয়ের সংস্কৃতি চারিয়ে দিয়ে তাদের লাগামহীন দুঃশাসনকে সর্বময় করে তুলেছে। রাষ্ট্রের চতুর্থ স্তম্ভ গণমাধ্যমের শক্তির অধিকাংশকেও তারা হস্তগত করতে সক্ষম হয়েছে। গণমাধ্যমের যে অবশিষ্ট শক্তিটা তারা করায়ত্ব করতে পারেনি, তারাই মূলত জনগণের কণ্ঠকে ক্ষীণতরভাবে ধারণ করে চলেছে। এইটাই সরকারের জন্য বড় হুমকি ও ভয়ের বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে, স্পষ্ট। রোজিনা ইসলামকে ভুয়া ভিত্তিহীন মামলায় কারারুদ্ধ করে সরকার গণমাধ্যমের অবশিষ্ট শক্তিকেও এই বার্তা দিতে চেয়েছে যে, এইটা শুরু। এইটা অ্যাকশন। এইসব করলে কেউ পার পাবা না।

লেখক: কবি ও গণমাধ্যমকর্মী