রাহমান চৌধুরীর কলাম ‘ব‌্যক্তিপূজার ভয়াবহতা বনাম মহাভারত’

প্রকাশিত : এপ্রিল ১৭, ২০২৪

ব‌্যক্তিপূজা এবং মানুষ‌কে দেবতা বানা‌নো এটা বর্তমান সম‌য়েও এশিয়ার বেশিরভাগ মানুষ‌দের স্বভাব। ফ‌লে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার সু‌যোগ কম। ব‌্যক্তিপূজা আর গণত‌ন্ত্রের ধারণা একস‌ঙ্গে চল‌তে পা‌রে না। ব‌্যক্তিপূজার ব‌্যাপারটা কেবল রাজৃ‌নৈ‌তিক দ‌লের ক্ষে‌ত্রে নয়, রাজ‌নৈ‌তিক দ‌লের বাইরে বি‌ভিন্ন প্রতিষ্ঠা‌নের ব‌্যক্তি বা প্রতিষ্ঠা‌নের প্রধান‌দের ক্ষে‌ত্রেও সমান। মানু‌ষের চিন্তা ও কাজ‌কে বি‌শ্লেষণ করার সু‌যোগ খুব কম সেখা‌নে। ব‌্যক্তির পূজাই চ‌লে শুধু। ফ‌লে যখন কা‌রো মৃত‌্যুবা‌র্ষিকী আসে, সবাই সেখা‌নে তা‌কে প্রশংসা কর‌তে কর‌তে দেবতা বা‌নি‌য়ে ফে‌লে।

বি‌ভিন্ন প্রতিষ্ঠা‌নে কিছু কিছু মানুষকে জী‌বিত অবস্থায় দেবতা বা‌নি‌য়ে ফেলা হয়। রাজ‌নৈ‌তিক দ‌লের ক্ষে‌ত্রে তো ডান-বাম সবাই এখা‌নে সমান। হয় কা‌রো চরম নিন্দা কর‌বে, না হ‌লে দেবতায় রূপান্ত‌রিত কর‌বে। ভার‌তব‌র্ষেই এটা সব‌চে‌য়ে বে‌শি দেখা যায়। ভার‌তব‌র্ষে রাজনী‌তির বাইরে বি‌ভিন্ন প্রতিষ্ঠা‌নের ক্ষেত্রেও তাই দেখা যা‌বে। বহু মানুষ যার সম্প‌র্কে জা‌নে না, অন্যের মু‌খে শু‌নে তা‌কে দেবতা বা খলনায়ক বা‌নি‌য়ে দি‌তে পা‌রে। বাংলা‌দেশ এসব ব‌্যাপা‌রে সবার থে‌কে এগি‌য়ে।

বাংলা‌দে‌শে নামকরা একজন লোক মারা গে‌লে সক‌লেই তা‌কে সম্মান জানাবার জন‌্য প্রতি‌যো‌গিতায় না‌মে। মৃত ব‌্যক্তি‌কে ম‌হিমা‌ন্বিত কর‌তে এমন সব কথা লে‌খা হয়, পড়‌তে গি‌য়ে রাগ কর‌বো না হাস‌বো, বুঝ‌তে পা‌রি না। চাষাভূষারা নন বা অতি সাধারণ মানুষরা তা লে‌খেন না, লে‌খেন বড় বড় সনদধারীরা। লুটপাটকারী, স্বৈরাচারী, ধর্ষক যেই হোক, য‌দি সে নামিদামি ব‌্যক্তি হয়; মারা গে‌লে লেখা হয়, জা‌তি একজন বিরাট ব‌্যক্তি‌কে হারা‌লো। কিংবা তি‌নি ছি‌লেন জা‌তির বা‌তিঘর।

শব্দ কিন্তু হা‌তেগোনা। কারণ স‌ত্যিকা‌রের লেখাপড়া নেই, ভাষার ওপর দখল নেই ফ‌লে নতুন কিছু লিখ‌বে কী ক‌রে? ফ‌লে কৃ‌ত্রিম, গথবাধা নকলনবীশ শোকবার্তায় ভ‌রে যায় ফেসবু‌কের পাতা। যখন পঁচাত্তর, আশি, নব্বই কিংবা তার চে‌য়ে বে‌শি বয়‌সের একজন অথর্ব মানুষ মারা যান, যি‌নি বহু‌দিন বয়সের কার‌ণে আর কিছুই কর‌ছি‌লেন না, তার মৃত‌্যু‌তেও লিখ‌তে দে‌খে‌ছি জা‌তি অকা‌লে তাঁ‌কে হারা‌লেন। নব্বই বছর বয়‌সে মর‌লে য‌দি অকাল মৃত‌্যু হয়, ক‌ত বছর বয়‌সে মর‌লে ত‌বে সেটা স‌ঠিক কাল হ‌তো? পাঁচ‌শো বছর বয়‌সে মর‌লে?

কৃ‌ত্রিম সব কিছু এখা‌নে। কৃ‌ত্রিম শোকপ্রকাশ, কৃত্রিম দেশ‌প্রেম, কৃ‌ত্রিম বাংলা ভাষার জন‌্য দরদ। কৃ‌ত্রিম সব কিছু ঠিকই অ‌ন্যের চো‌খে ধরা প‌ড়ে, মানুষ তা ঠিকই বুঝ‌তে পা‌রে। সমা‌জের উচ্চব‌র্গের তাই আর আগের মতন সম্মান নাই সাধার‌ণের কা‌ছে। কৃ‌ত্রিম একটা সমা‌জে বেঁ‌চে আছি আমরা, সেখা‌নে অকৃ‌ত্রিম আছে খুব সামান‌্য কিছু। মানু‌ষের প্রা‌ণের গান‌কে পর্যন্ত কৃ‌ত্রিম ব‌া‌নি‌য়ে ফে‌লে‌ছে মুনাফা‌খোর ভদ্রলোকরা। যখন খুব বাড়াবাড়ি হয় দু-একটা প্রতিবাদ আসে। ঠিক যেমন কাজী নজরুল ইসলা‌মের কারার ঐ লৌহ কপাট গান‌টির বেলায় ঘটে‌ছিল।

এরকম প্রতিবা‌দের ন‌জির খুব কম, ভদ্রলোকরা টাকা পে‌লে মুখ বন্ধ ক‌রে থা‌কে। ঠিক একই পা‌বে ভদ্রলোকরা নি‌জেরা কা‌রো কাছ থে‌কে নানান সু‌বিধা পে‌লে ব‌্যক্তিপূজা ক‌রে। সেই ব‌্যক্তিপূজা প‌রে সমা‌জের নানাস্ত‌রে সংক্রা‌মিত হয়। না জে‌নে, না বু‌ঝে সব মানুষ তখন ব‌্যক্তিপূজা আরম্ভ ক‌রে। যারা সু‌বিধা পায় তারা ব‌্যক্তির পূজা ক‌রে। সেটা চার‌দি‌কে ছ‌ড়ি‌য়ে প‌ড়ে। যার পূজা একবার আরম্ভ হয়, তার আর কো‌নো দোষ নেই; সে ধর্ষণ কর‌লেও ধামাচাপা দেওয়া হয়। বহু উদাহরণ আছে এরকম। বু‌দ্ধিজীবী, গণমাধ‌্যম, প‌ত্রিকাগু‌লো তখন মুখ বন্ধ করে থা‌কে।

বাংলা‌দে‌শের এক‌টি বিখ‌্যাত প‌ত্রিকার সম্পাদকের পক্ষ থে‌কে কিছু নাম উচ্চারণ ক‌রে একবার আমা‌কে বলা হ‌য়ে‌ছিল, এঁ‌দের বিরু‌দ্ধে আমরা কিছু ছাপা‌বো না। বলা হ‌য়েছিল, এটা আমা‌দের প‌ত্রিকার নী‌তিমালা। বিষয়টা আস‌লে নী‌তি নয়, বা‌ণিজ‌্য। স্বার্থ। গণমাধ‌্যম তার মুনাফার স্বা‌র্থে যা‌কে তা‌কে তারকা বানায়, তারকা বা‌নি‌য়ে কো‌টি টাকা বা‌ণিজ‌্য ক‌রে। গণমাধ‌্যম তার স্বা‌র্থে কিছু ‘ব‌্যক্তিত্ব’ বানায় যা‌দের নিয়ে ব‌্যবসা করা যায়। মানুষ‌ক গণমা‌ধ‌্যম নি‌জের প্রয়োজ‌নে দেবতা বানা‌তে চেষ্টা ক‌রে।

কিছুই কখ‌নো তা‌দের সেই বানা‌নো‌ ব‌্যক্তিত্ব‌দের বিরু‌দ্ধে লিখ‌বে না, য‌দি তারা গণমাধ‌্যমের মুনাফার স্বার্থে আঘাত না হা‌নে। ধর্ষণ, লুটপাট কর‌লেও না। গণমাধ‌্যম এর চে‌য়ে বড় বড় ঘটনায়ও মুখ বন্ধ ক‌রে থা‌কে তার প্রমাণ আছে। গণমাধ‌্যম না‌মে সেগু‌লো আস‌লে বা‌ণি‌জ্যিক প্রতিষ্ঠান। কিন্তু যারা বা‌ণি‌জ্যিক প্রতিষ্ঠা‌নের অংশ নন, যারা রাজনীতির স‌ঙ্গে যুক্ত, বিশ্ব‌বিদ‌্যাল‌য়ের স‌ঙ্গে যুক্ত, শিল্প-সা‌হি‌ত্যের স‌ঙ্গে যুক্ত তারা কী ক‌রে এই ব‌্যক্তিপূজার সংস্কৃ‌তি‌কে মে‌নে নেন এবং নি‌জেরাও ব‌্যক্তিপূজা ক‌রেন? বহু বছর আগের লেখা মহাভারতটা কি তারা কখ‌নো পাঠ ক‌রে দেখেন‌নি?

মহাভারত লেখা হ‌য়ে‌ছে প্রধানত ব্রাহ্মণ‌্যবা‌দের প‌ক্ষে। ব্রাহ্মণ‌দের‌কে ম‌হিমা‌ন্বিত করার জন‌্য, ব্রাহ্মণ‌দের মাহাত্ম‌্য প্রতিষ্ঠার ল‌ক্ষ্যে। য‌দি সেই মহাভারত কেউ ম‌নো‌যোগ দি‌য়ে পাঠ ক‌রেন তাহ‌লে দেখ‌বেন, সেখা‌নে ব্রাহ্মণরা কেউ সমা‌লোচনার ঊর্ধে নয়। না ব্রাহ্মণরা, না ক্ষ‌ত্রিয়রা। কৃষ্ণ বিরাট চ‌রিত্র, কিন্তু সমা‌লোচনা ঊর্ধে নয়। মহাভার‌তে দেবতূল‌্য বহু চ‌রিত্র আছে, বহু এবং বহু, যা‌দের ম‌ধ্যে একজনও নেই যে সমা‌লোচনার ঊর্ধে। না কর্ণ, না যু‌ধিষ্ঠির। মহাভার‌তের শে‌ষে এসে এক‌টি গুরুত্বপূর্ণ কথা বলা হয়, পৃ‌থিবী‌তে কো‌নো মানুষ নেই যে সম্পূর্ণ ভা‌লো কিংবা সম্পূর্ণ খারাপ।

মহাভারত যে যুগ যুগ ধ‌রে টি‌কে আছে, তার কারণ এটাই। প্রতিটা চ‌রিত্রকে বি‌ভিন্নভা‌বে বি‌শ্লেষণ করা হ‌য়ে‌ছে। বি‌ভিন্ন ব‌্যক্তির উপর দেবত্ব আরোপ ক‌রেও শেষ বিচা‌রে দে‌খিয়ে দেওয়া হ‌য়ে‌ছে তার নীচতা, ব‌্যক্তিস্বার্থ, কূট‌কৌশল এবং গোপন লোভ। মহাভার‌তে এই বিচার থে‌কে কে ছাড়া পে‌য়ে‌ছে? একজনও নয়। দ্রোণাচার্য শঠতা ক‌রে একলব‌্যর স‌ঙ্গে। সেখা‌নে যু‌ধি‌ষ্ঠির সহ পঞ্চপাণ্ডব নীরব। মহাভার‌তের আকর্ষণ এখা‌নেই, প্রতি‌নিয়ত চ‌রিত্ররা এখা‌নে ভা‌লোমন্দ দুভা‌বেই বি‌শ্লে‌ষিত হয়। ঠিক তাই পাওয়া যা‌বে হোমারের ইলিয়ড অ‌ডি‌সি‌তে। সে কার‌ণেই হাজার বছর ধ‌রে তা টি‌কে আছে এবং মানু‌ষের এসব সা‌হি‌ত্যের প্রতি উৎসাহ বাড়‌ছে।

মহাভার‌তের সবচে‌য়ে উজ্জ্বল চ‌রিত্র কর্ণ পর্যন্ত সমা‌লো‌চিত। পঞ্চপাণ্ডব‌দের বীর‌ত্বের ফাঁকি কোথায় সেটা স্পষ্ট করে তো‌লে রচ‌য়িতারা, যখন একল‌ব্যের মু‌খোমু‌খি এনে দাঁড় করায় তা‌দেরকে। মহাভারত পু‌রো রচনাটাই উদ্দে‌শ্যেমূলক। মানু‌ষের চিন্তার জগত‌কে নাড়া দেয়, সত‌্য কোথাও গি‌য়ে স্থির থা‌কে না। সময় এবং ঘটনার স্রো‌তের স‌ঙ্গে স‌ঙ্গে সত‌্য রঙ বদলায়। সকল‌কে বু‌ঝি‌য়ে দেওয়া হয় চিরসত‌্য ব‌লে কিছু নেই, সব আপাত সত‌্য। সু‌বিধাবাদী ও মুনাফা‌খোর‌দের কথা বাদ দেই, আমা‌দের সমা‌জের সব‌চেয়ে বিদগ্ধ মানুষরাও যেন প্রায় সবাই ম‌নে ক‌রেন, সত‌্য কেবল চিরসত‌্যরূ‌পেই আবির্ভূত। এর কো‌নো প‌রিবর্তন নেই।

ব‌্যক্তির চ‌রিত্র যেন চিরন্তন। ল‌ক্ষিণদ‌রের বাসরঘ‌রের ছিদ্র দি‌য়ে যে সেখা‌নে লো‌ভের, নীতিহীনতার সর্প প্রবেশ কর‌তে পা‌রে তা দেখ‌তে তারা নারাজ নিজ‌দের পূজনীয়‌দের সম্প‌র্কে। রাজ‌নৈ‌তিক দলের ক্ষেত্রে যেমন এটা সত‌্য, রাজ‌নৈ‌তিক দ‌লের বাইরের বি‌ভিন্ন ব‌্যক্তি এবং প্রতিষ্ঠা‌নের ক্ষে‌ত্রেও তা সত‌্য। ব‌্যক্তিপূজার এই সংস্কৃ‌তি থে‌কে বের হ‌তে না পার‌লে, ব‌্যক্তি‌কে আপাদমস্তক বি‌শ্লেষণ কর‌তে না পার‌লে মূল সত‌্যটাই উদ্ভা‌সিত হ‌বে না। সময় ঠিক কর‌বে প‌রের গ‌তিপ্রকৃ‌তি, কিন্তু প্রাথ‌মিক স‌ত্যের সড়‌কে পৌঁছা‌তে হ‌লে ব‌্যক্তিপূজা বাদ দি‌তে হ‌বে।

লেখক: সাহিত্যিক ও শিক্ষাবিদ