রাহমান চৌধুরীর কলাম ‘রাষ্ট্রভাষা কিংবা মাতৃভাষা সম্প‌র্কে’

ছাড়পত্র ডেস্ক

প্রকাশিত : ফেব্রুয়ারি ২৪, ২০২৪

য‌দি আমরা কো‌নো ভাষার আগ্রাসন ঠেকা‌তে চাই, প্রথম দা‌য়িত্ব হ‌বে নি‌জের ভাষাটা সর্বস্ত‌রে চালু করা। না হ‌লে অন‌্য ভাষা‌কে আক্রমণ ক‌রে লাভ নেই। নি‌জের ভাষাটা ঠিকম‌তো সর্বস্ত‌রে চালু করা গে‌লে, তখন অন‌্য ভাষা আমা‌দের প্রয়োজন ম‌তো আমরা ব‌্যবহার করার সু‌যোগ পা‌বে। য‌দি তা না ক‌রে অন‌্য ভাষার প্রবেশ রোধ কর‌তে চাই, তাহ‌লে জ্ঞান‌বিজ্ঞান চর্চায় তা ক্ষ‌তির কারণ হ‌বে।

বাংলা ভাষা রাষ্ট্রভাষা হি‌সে‌বে বাংলা‌দে‌শের সরকারি-বেসরকারি সকল প্রতিষ্ঠা‌নের প্রধান ভাষা হ‌তে হ‌বে এবং নিঃস‌ন্দে‌হে সর্বস্ত‌রে শিক্ষার বাহন হ‌তে এই রাষ্ট্রভাষা বাংলা। ইউরোপ য‌তদিন ল‌্যা‌টিন ভাষার দাসত্ব ক‌রে‌ছে তার সকলরকম উন্ন‌তি আট‌কে ছিল। যে‌দিন মাতৃভাষায় ইউরো‌পের দেশগু‌লো জ্ঞান‌বিজ্ঞান চর্চা আরম্ভ কর‌লো এবং সেই স‌ঙ্গে অন‌্য ভাষার সকল মূল‌্যবান গ্রন্থগু‌লো অনুবাদ ক‌রে নি‌য়ে‌ছিল, তখন থে‌কেই ইউরোপ সর্ব‌ক্ষে‌ত্রে উন্ন‌তি ঘটা‌তে থা‌কে।

এশিয়ায় একমাত্র জাপান জ্ঞান‌বিজ্ঞা‌নে পাশ্চা‌ত্যের সমকক্ষ হ‌য়ে দাঁ‌ড়ি‌য়ে‌ছিল মাতৃভাষা জ্ঞান‌বিজ্ঞান চর্চার কার‌ণে। জাপা‌নে তাই পাশ্চা‌ত্যের দেশগু‌লো প্রভুত্ব কর‌তে পা‌রে‌নি। এশিয়ায় ভারত বিরাট দেশ হ‌য়ে নিজ‌দে‌শে জ্ঞান‌বিজ্ঞান চর্চায় পি‌ছি‌য়ে আছে মাতৃভাষা‌কে অব‌হেলা করার কার‌ণে। ভিন্ন দি‌কে চীন, কো‌রিয়া পরবর্তীকালে প্রযু‌ক্তির ক্ষে‌ত্রে উন্ন‌তি ক‌রে‌ছে মাতৃভাষায় চর্চার ফ‌লে।

ভার‌তের বিশ শত‌কের প্রধান চার বিজ্ঞানী জগদীশ চন্দ্র বসু, প্রফুল্ল রায়, স‌ত্যেন বসু ও মেঘনাদ সাহা বারবার মাতৃভাষায় জ্ঞানচর্চার কথা ব‌লে‌ছেন। ঠিক একইভা‌বে তাঁ‌দের আগে মধুসূদন দত্ত, ব‌ঙ্কিমচন্দ্র চ‌ট্টোপাধ‌্যায় এই কথা ব‌লে গে‌ছেন। য‌দি দুজ‌নেই প্রথম ইং‌রে‌জি ভক্ত ছি‌লেন, প‌রে নি‌জে‌দের ভুল বুঝ‌তে পা‌রেন। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর সারা জীবন মাতৃভাষায় উচ্চ‌শিক্ষা দেয়ার ব‌্যাপা‌রে চিৎকার ক‌রে গে‌ছেন। লেখা‌লে‌খি ক‌রে‌ছেন।

বিশ্বভারতী প্রতিষ্ঠার অন‌্যতম লক্ষ‌্য ছিল মাতৃভাষায় উচ্চতর শিক্ষাদান। কিন্তু ব্রিটিশ সরকা‌রের কাছ থে‌কে কিছু‌তেই তার অনুম‌তি পান‌নি। ইং‌রেজ‌দের ম‌ধ্যে অনেক প্রাজ্ঞ ব‌্যক্তিরা ভার‌তে মাতৃভাষায় শিক্ষাদা‌নের প‌ক্ষে মত দি‌য়েছি‌লেন,তা‌দের ম‌ধ্যে দার্শ‌নিক জেমস মিল থে‌কে শুরু ক‌রে পাদ্রী এড‌্যাম, পাদ্রী জেমস লঙ প্রমুখ সহ বহু ইং‌রেজ শিক্ষা‌বি‌দের নাম উচ্চারণ করা যা‌বে। ‌এম‌নি গান্ধী মাতৃভাষায় শিক্ষাদা‌নের ব‌্যাপা‌রে সরব ছি‌লেন। কিন্তু সরকার পক্ষ কখনোই তা কর্ণপাত ক‌রে‌নি। গান্ধী বর্তমান শিক্ষা ব‌্যবস্থা‌কে ব‌লে‌ছি‌লেন, ‘বু‌দ্ধির লাম্পট‌্য’। ‌তি‌নি কি যথার্থ ব‌লেন‌নি?

প্রতি‌টি রা‌ষ্ট্রে ইং‌রে‌জিসহ বি‌ভিন্ন ভাষার চর্চা চল‌তেই পা‌রে, কিন্তু মাতৃভাষা‌কেই সকল ক্ষে‌ত্রে প্রাধান‌্য দি‌তে হ‌বে। কারণ সেই ভাষাটাই দে‌শের সকল মানুষ বুঝ‌তে পা‌রে। দে‌শের সক‌ল মানু‌ষের স‌ঙ্গে আত্মীয়তা গড়ার সেটাই একমাত্র ভাষা। ফ‌লে বাংলা‌দে‌শে সকল স্ত‌রে রাষ্ট্রভাষা বাংলা চালু কর‌তেই হ‌বে। শিক্ষার বাহন হ‌তে হ‌বে বাংলা, তার স‌ঙ্গে মাধ‌্যমিক শিক্ষার স্তর থে‌কে দ্বিতীয় ভাষা হি‌সে‌বে সবাই নিজ‌নিজ পছন্দ অনুযায়ী আর এক‌টি ভাষা শিখ‌তে বাধ‌্য থাক‌বে। তাহ‌লেই আমা‌দের সাংস্কৃ‌তিক প‌রিমণ্ড‌লের নানা বি‌রোধ, নানারকম শিক্ষা নি‌য়ে বি‌ভেদগু‌লো অ‌নেক ক‌মে আস‌বে।

ম‌নে রাখ‌তে হ‌বে, রাষ্ট্র প‌রিচালনায় এবং জনগ‌ণের মান‌সিকতা প‌রিবর্ত‌নে ভাষার এক‌টি গুরুত্বপূর্ণ ভূ‌মিকা আছে। ত‌বে এটা ম‌নে রাখ‌তে হ‌বে, পৃ‌থিবী‌তে চার হাজা ভাষার ম‌ধ্যে বহু ভাষা আছে হয়‌তো দেখা যা‌বে সেই ভাষায় মাত্র দুই হাজার বা দশ হাজার লোক কথা ব‌লে। খুবই ক্ষুদ্র জন‌গোষ্ঠীর ভাষা সেটা। সে‌ক্ষে‌ত্রে অর্থ‌নৈ‌তিক কার‌ণেই এবং বাস্তব প্রেক্ষি‌তে সে ভাষায় উচ্চ‌শিক্ষা দেয়ার সু‌যোগ থাক‌বে না।

লেখক: প্রাবন্ধিক ও শিক্ষাবিদ