রাহমান চৌধুরীর কলাম ‘শিক্ষা বিতর্ক’

প্রকাশিত : ডিসেম্বর ০৪, ২০২৩

ক.
বাংলাদেশে শিক্ষা নিয়ে খুব বিতর্ক চলছে। বিতর্কের কারণগুলো নিয়ে কথা বলতে চাই না। বিতর্ক বেশি চলছে প্রাথমিক শিক্ষা নিয়ে। মানুষের শিক্ষা ঘরে বাইরে নানাভাবে চলে। প্রাথমিক শিক্ষা ঠিক তেমনি ঘরে বাইরে লাভ হতে পারে। যারা বিদ্যালয়ে যায় না, ঘরেই তারা জীবনের অনেক শিক্ষা পেয়ে যায়। চাষার ছেলে চাষের কাজ শেখে অভিভাবকদের কাছ থেকে। প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে এইভাবে অনেক গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষা লাভ করেছে পৃথিবীর মানুষ। শিক্ষক এখানে অভিভাবক কিংবা তাদের পিতা-মাতা, যাকে শিক্ষালাভের জন্য টাকা পয়সা কিছু দিতে হয় না। শিক্ষকের কাছে ছাত্রের বাৎসরিক পরীক্ষাও দিতে হয় না। কিন্তু পরীক্ষা নেয়া হয়, ছাত্র জানে না কখন পরীক্ষা নেয়া হয়েছে। এসব শিক্ষায় পরীক্ষা ভীতি থাকে না।

সেই যুগে প্রাতিষ্ঠানিক কোনো বিদ্যালয়ে না গিয়ে একটি মেয়ে সংসার চালাবার সব শিক্ষা লাভ করতো মা-খালা-চাচিদের কাছে। রান্নাবান্না তার মধ্যে প্রধান একটি। দ্বিতীয় একটি ঘর গৃহস্থালি। কিন্তু এই মা-খালা-চাচিদের কখনো সমাজ শিক্ষকের সম্মান দেয়নি। শিক্ষার্থী এখানে আবাসিক বিদ্যালয়ে বসেই অবৈতনিকভাবে কোনো হৈ চৈ ছাড়া গুরুত্বপূর্ণ অনেক শিক্ষা লাভ করে ফেলতো। কিন্তু সনদপত্র পেত না, কিন্তু সত্যিকারের শিক্ষা পেত। এসব শিক্ষায় ফাঁকি দেয়ার সুযোগ ছিল না। শিক্ষার্থী ফাঁকি দিতে চাইত না। কারণ শিক্ষার্থীদের পড়াশুনার চাপ ছিল না। স্বতস্ফূর্তভাবে সে প্রয়োজনীয় শিক্ষা লাভ করতো এবং নানা ধরনের প্রশিক্ষণ পেত। প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার আরম্ভ সেই সেদিন মাত্র, তার আগে প্রায় একলক্ষ বছর মানুষ এভাবেই শিক্ষা পেয়েছে। প্রথম শিক্ষক ছিল তাদের প্রকৃতি ও প্রতিকূলতা। পরে অভিভাবকরা তারপর শিক্ষা প্রতিষ্ঠান।

বর্তমান সময় যখন প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা আরম্ভ হয়েছে, সব শিক্ষা মানুষ এখনো কিন্তু প্রতিষ্ঠানের কাছে পাচ্ছে না। কিছু শিক্ষা আজও মানুষ পরিবার থেকে পায়, কিছু শিক্ষা লাভ করে অভিজ্ঞতা থেকে। কিছু শিক্ষা স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে আহরণ করে। জ্ঞানী মানুষদের বেশির ভাগ শিক্ষাই হয়ে থাকে স্বপ্রণোদিতভাবে। বড় বড় মনীষীদের মূল শিক্ষা আরম্ভ হয় প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা সমাপ্ত করার পর। সারাটা জীবন ধরেই মানুষ শিক্ষা লাভ করে, যার সবটা প্রতিষ্ঠান দিতে পারে না, দিতে পারবে না। মানুষের প্রথম গ্রন্থ রচিত হয়েছে ব্যক্তির দ্বারা নয়, প্রতিষ্ঠানের দ্বারা নয়, দলবদ্ধ সমাজে। সেইরকম বৃহৎ গ্রন্থ দেখা গেছে পরবর্তী যুগের বিশ্বিদ্যালয়গুলো পর্যন্ত রচনা করতে পারেনি। যখন বিশ্ববিদ্যালয় ছিল না, লিপি ছিল না তখন রচিত হয়েছে বেদ। খুব অবাক হলেও সত্যি এই যে, বেদ রচিত হতে হতে একটি ভাষা জন্ম নিয়েছে মানুষের মুখে মুখে। সেই ভাষার নাম সংস্কৃত।

পৃথিবীর সব ভাষাই মুখে মুখেই সৃষ্টি। ভাষার আগে কোনো ভাষার ব্যাকরণ রচিত হয়নি। মানুষের সৃষ্টিশীল কাজের আরম্ভ ভাষা সৃষ্টির আগে। মানুষের প্রথম লিপি আসলে তার অঙ্কন শিল্প। তার বহু বহু শতাব্দী পর লিপির উৎপত্তি। লিপির আগে এসেছে ভাষা ও সাহিত্য। ফলে সেই যে একদল মানুষ ভাষা আবিষ্কার করলো, সাহিত্য রচনা করলো এবং লিপি সৃষ্টি করলো সেই মানুষগুলোকে আমরা মনে রাখিনি।

যদি আমরা প্রশ্ন তুলি, গ্যালিলিও ও নিউটনের আবিষ্কারের চেয়ে তাদের আবিষ্কারগুলো কি আরও গুরুত্বপূর্ণ ছিল না? নিশ্চয় মানতে হবে, যা কিছু তারা যুগ যুগ ধরে আবিষ্কার করে রেখে গেছে সেগুলো আবিষ্কার অবস্থায় না পেলে গ্যালিলিও বা নিউটনকে পাওয়া যেত না। কিন্তু সেই সব আবিষ্কারকদের নাম আমরা জানি না, যদিও আমরা নিউটন গ্যালিলিওর নাম জানি। প্রশ্ন উঠতে পারে, মানুষের জীবনে কোনটা গুরুত্বপূর্ণ: ভাষা না বিলাসবহুল গাড়ি? যদি একজন মানুষকে বলা হয় তোমাকে একটি গাড়ি দেয়ার বিনিময় তোমার সবরকম ভাষা কেড়ে নেবো, সে তখন কোনটা রাখতে চাইবে? ফলে পৃথিবীর অনেক বড় বড় আবিষ্কারের গুরুত্ব আমরা বুঝতে পারি না, কারণ তা বিনামূল্যে আমরা লাভ করেছি। যদি মানুষকে তার বেঁচে থাকার জন্য প্রতিনিয়ত অক্সিজেন কিনতে হতো, ঠিক গাড়ির তেল কেনার মতো! কিনতে হয় না বলে, গুরুত্ব নেই। যার বিনিময় মূল্য নেই, মানব সভ্যতার কাছে তার গুরুত্ব কম। ফলে ভাষা ও লিপি আবিষ্কারের গুরুত্ব নিয়ে কখনো মানুষ মাথা ঘামায় না এবং সেইসব সৃষ্টির সঙ্গে জড়িতদের উদ্দেশ্যে তাদের স্মৃতির প্রতি কোনোদিন একমিনিট নীরবতা পালন করেনি সভ্য সমাজ।

ভাষা বা লিপি নিয়ে এত কথা বলার কারণ, বর্তমান কালের প্রাতিষ্ঠানিক প্রাথমিক শিক্ষার সঙ্গে ভাষা এবং লিপির গুরুত্বপূর্ণ সম্পর্ক রয়েছে। প্রাথমিক শিক্ষার সঙ্গে জড়িতদের ডিম ভাজা শেখানোর আগে সেটা গভীরভাবে বুঝতে হবে। প্রাতিষ্ঠানিক প্রাথমিক শিক্ষার মূল কথা, পরবর্তী মাধ্যমিক এবং উচ্চশিক্ষার ভিত গড়ে দেয়া। প্রাথমিক শিক্ষার প্রধান লক্ষ্যই হচ্ছে তাই শিশুকে ভাষা এবং লিপির উপর দখল এনে দেয়ার প্রশিক্ষণ দান। সেই সঙ্গে সহজ অঙ্ক মানে যোগ বিয়োগ গুণ ভাগ করতে শেখানে। মানে শিশুকে বর্ণমালা শিখতে সাহায্য করা, যাতে সে মাতৃভাষার উপর প্রাথমিক দখল তৈরি করতে পারে। কথাটা স্পষ্ট করে বললে এই দাঁড়ায় যে, প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী যেন মাতৃভাষায় লেখা বই নিজে নিজে পড়তে পারে এবং মাতৃভাষায় সহজ বোধগম্য কথা লিখতে পারে। সেই সঙ্গে যদি যোগ বিয়োগ গুণ ভাগ করতে পারে, বলা যাবে শিশুর প্রাথমিক শিক্ষা সম্পন্ন। পাঁচ বছর ধরে পঞ্চম শ্রেণী পর্যন্ত তাহলে সে এইটুকুই শিখবে।

কিছুতেই এর চেয়ে বেশি চাপ শিশুর উপর দেয়ার দরকার নেই। শিশুর কাছে শিক্ষা তাহলে ভীতি মনে হবে না এবং পাঁচ বছরে এটুকু শেখাতে শিক্ষককে কোনো চাপ নিতে হবে না। প্রাথমিক শিক্ষাকে সেক্ষেত্রে শিশুর জন্য হাতে কলমে প্রশিক্ষণ হিসেবে দেখা যেতে পারে। শিশুকে প্রাথমিক শিক্ষায় কোনো জ্ঞান দেয়া যাবে না। নীতিবাক্য শেখানো হবে ভুল। শিশুকে প্রকৃতির সঙ্গে যুক্ত রাখতে হবে যতোটা সম্ভব। প্রাথমিক শিক্ষায় আর শিশুকে যে প্রশিক্ষণ দেয়া যেতে পারে তাহলে শরীর চর্চা এবং সঙ্গীতে কিছুটা পারদর্শী করে তোলা। শিশুকে নিজের মতো ছুটাছুটি বা খেলাধুলার সুযোগ দিতে হবে। কিন্তু শিক্ষকের মূল দায়িত্ব হবে মাতৃভাষায় এবং সেই ভাষার বর্ণমালায় শিশুর মস্তিষ্কে প্রাথমিক দখল এনে দেয়া। প্রাথমিক শিক্ষার এইটুকু অংশের গুরুত্ব যে কতো ব্যাপক অনেকে তা ধারণাই করতে পারবেন না। পরে উপসংহারে তা নিয়ে পুনরায় কথা বলা যাবে।

খ.
সবসময় দুটো শব্দ আমরা শুনে থাকি: পড়াশুনা ও লেখাপড়া। দুটো শব্দের মধ্যে কি আদৌ কোনো পার্থক্য আছে? অবশ্যই আছে। কিন্তু আমরা কি কখনো তা নিয়ে ভেবেছি? বর্তমান প্রাথমিক শিক্ষায় বা সকল শিক্ষায় `লেখাপড়া`ই হয়। `পড়াশুনা`র মধ্যে তা সীমাবদ্ধ নয়। শিশুরা প্রাথমিক শিক্ষায় যখন থেকে লিপি কিংবা বর্ণমালা শিখতে শুরু করেছে এবং তা লিখতেও হচ্ছে তখন থেকে তা লেখাপড়ার যুগ। পড়াশুনা ছাড়িয়ে এবার শিক্ষার্থী লেখাপড়ার যুগে প্রবেশ করেছে। যখন বর্ণমালা তৈরি হয়নি তখন লেখাপড়ার যুগ ছিল না। ছিল পড়াশুনার যুগ। পড়াশুনার যুগেই আমরা গিলগামেশ, হাজার আরব্য রজনীর গল্প, বেদ, রামায়ণ, মহাভারত এসব পেয়েছি। এসবই মানুষ সৃষ্টি করেছে মুখে মুখে, প্রথম এর লিখিত কোনো রূপ ছিল না। মানুষ শুনে শুনে বছরের পর বছর ধরে তার চর্চা করেছে, কারণ তার কাছে লিপি বা বর্ণমালা ছিল না। লিপি বা বর্ণমালা থাকলেও যিনি লিখতে পড়তে জানেন না, তিনি কী করবেন? লালন গান রচনা করেছেন মুখে মুখে, তিনি লিখতে জানতেন না। মুখে মুখে রচিত তার গান পরে লিখিত রূপ পেয়েছে। বেদ, রামায়ণ, মহাভারতসহ তখনকার সংস্কৃত সাহিত্যের বেশির ভাগটাই মুখে রচিত হয়েছে, সেগুলো লেখা হয়েছে বহু পরে।

ধরা যাক বেদ, দু’হাজার বছর ধরে তা শ্রুতিই ছিল। বৈদিক যুগের শিক্ষার্থীরা গুরু গৃহে যেতেন বেদ শিখতে। সেখানে গিয়ে এখনকার কুরানে হাফেজের মতো শিক্ষার্থীরা অত বড় বেদটা মুখস্থ করতেন। লিখিত রূপ ছিল না বেদের। গুরুর মাথায় আছে পুরো বেদ, সেখান থেকে ছাত্রের মাথায় চালান দেয়া হচ্ছে। আবৃত্তি কথাটা সেখান থেকেই এসেছে। গুরু আবৃত্তি করতেন শুদ্ধ উচ্চারণে, সেই আবৃত্তি শুনে শুনে শিক্ষার্থী বহু বছরে বেদ মুখস্থ করতেন। ফলে সে যুগে লেখাপড়া ছিল না, ছিল পড়াশুনা। মানে শুনে শুনে পড়া মুখস্থ করা। যখন লিপি সৃষ্টি হলো তখন ব্রাহ্মণরা এই ঐতিহ্য ধরে রেখেছিলেন। কারণ বেদ পাঠ ছিল শূদ্র এবং নারীদের জন্য নিষিদ্ধ। যদি বেদ লিখে ফেলা হয়, তাহলে শূদ্র বা নারীরা তা পাঠ করে ফেলতে পারে।  ফলে তার লিখিত রূপ তৈরি করা হয়নি বহুকাল। ব্রাহ্মণদের কাছে এটা ছিল তাঁদের অহঙ্কার, লুকিয়ে রাখা গুপ্তধনের মতো। ব্রাহ্মণরা লিপির যুগেও লেখালেখিকে খুব নীচু চোখে দেখতেন। সেজন্য শূদ্র ছাড়া আর কেউ প্রথম দিকে লিপি শিক্ষা নিতেন না। শূদ্ররা কেন লিখতে শিখেছিল? কারণ রাজার আদেশ নির্দেশ বা ঘোষণা লিপিবদ্ধ করে প্রচার করার জন্য। শূদ্রদের তাই পরবর্তীতে কায়স্থ পদবি দিয়ে উচ্চস্তরে তুলে আনা হয়।

বর্তমান যুগ  হচ্ছে লেখাপড়ার যুগ, পড়াশুনার নয়। লেখাপড়ার যুগের আগেও সাহিত্য সৃষ্টি হয়েছে, দার্শনিক আলোচনা চলেছে, কিন্তু সেইভাবে বিজ্ঞান চর্চা সম্ভব হয়নি। বাস্তব জ্ঞান এবং বিজ্ঞানের যাত্রা খুব দ্রুত এগিয়ে যায় লেখাপড়ার যুগে। সেটাই লক্ষ্য করা গেছে প্রাচীন গ্রীসে। গ্রীস বা রোম প্রাচীন যুগে জ্ঞানবিজ্ঞানে এত অগ্রগতি লাভ করে তার কারণ তাঁদের চিন্তার লিখিত রূপ। জ্ঞান সেখানে লুকানো ধনসম্পদ নয়, যা সবার মধ্যে বিতরণ করা যাবে না। জ্ঞান যতো বেশি মানুষের মধ্যে ছড়িয়ে দেয়া যায়, তত তা বিকশিত হয়। মাতৃভাষায় যারা জ্ঞানবিজ্ঞান চর্চা করেছে, সেই সব দেশ চিন্তাচেতনা বৈজ্ঞানিক আবিষ্কারে অনেক এগিয়ে গেছে। ইউরোপে রেনেসাঁর পর সেটাই লক্ষ্য করা গেছে। যখন লাতিন বাদ দিয়ে ইউরোপের বিভিন্ন দেশ মাতৃভাষায় জ্ঞানবিজ্ঞান চর্চা আরম্ভ করে, তখনি আটশো বছরের অন্ধকার যুগ থেকে তারা আলোকপ্রাপ্ত যুগে প্রবেশ করে। লিখিত গ্রন্থের  সুবিধা হচ্ছে এই, সেখানে মানুষ তার জ্ঞানবিজ্ঞান বা অভিজ্ঞতার কথা লিখে রেখে যেতে পারে। পরবর্তী প্রজন্ম সেখান থেকে অনেকভাবে লাভবান হয়। বর্তমান যুগে শিক্ষার এটাই প্রধান ধারা, মানুষ লিখিত গ্রন্থ থেকে অনেকভাবে নতুন কিছু জানতে পারে, শিখতে পারে।

গ.
প্রাথমিক শিক্ষাটা সত্যিকার অর্থে আসলে কী? একটু আগে বলা হয়েছে শিশুকে মাতৃভাষা স্বাচ্ছন্দ্যভাবে লিখতে পড়তে শেখানো। যা হতে পারে পরবর্তী জ্ঞানচর্চার ক্ষেত্রে খুব গুরুত্বপূর্ণ। যখন সে মাধ্যমিক বা উচ্চশিক্ষার দিকে এগিয়ে যাবে, তাকে অনেক বই পড়তে হবে। সেই পড়ার জন্য প্রাথমিক শিক্ষাই তাকে সাহায্য করবে। এটা একটা সত্য। তার চেয়েও গভীর সত্য আছে। সেটাই গুরুত্বপূর্ণ, সেকারণেই উন্নত দেশে বা জ্ঞানী মানুষরা প্রাথমিক শিক্ষার এত বেশি মর্যাদা দিয়ে থাকেন। ধরা যাক, একজন প্রাথমিক শিক্ষা লাভের পর আর বিদ্যালয়ের যাওয়ার সুযোগ পেলেন না। কিন্তু তিনি মাতৃভাষায় লেখাপড়া করতে শিখেছেন। ফলে তিনি মাধ্যমিকবিদ্যালয়ে যেতে না পারলেও সংবাদপত্র পাঠ করতে পারবেন। কিংবা অবসরে বসে একটা বই পাঠ করলেন। ঘরে বসে এভাবে বই পাঠ করে করে তিনি খুব উচ্চস্তরের একজন জ্ঞানী মানুষের স্বীকৃতি লাভ করতে পারেন। হাতের কাছে তার উদাহরণ আরজ আলী মাতুব্বর। তিনি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের দ্বিতীয় শ্রেণী পর্যন্ত পড়াশুনা করেছিলেন। কিন্তু মাতৃভাষায় লেখাপড়ার দক্ষতা ছিল বলেই বাংলা ভাষায় লেখা বই পাঠ করে করে এক ইতিহাস সৃষ্টি করেছিলেন। তাঁর জন্য তাঁকে একটাও ইংরেজি বই পড়তে হয়নি। তিনি যা পেরেছেন, ইংরেজি জানা বহু লোক তা পারেননি। কিছু মানুষ যাঁরা মনে করেন ইংরেজি বই পাঠ না করে জ্ঞান লাভ করা যায় না, নিশ্চয় তারা এখনো সেই তর্কই করে যাবেন।

ফলে প্রাথমিক শিক্ষায় কী শেখাতে হবে? সেই বিতর্ক কি শেষ হবে? আরজ আলী মাতব্বর খুব ভালো রান্না করতে জানতেন। বহু মানুষের জন্য তিনি সুস্বাদু খাবার বড় বড় ডেকচিতে রান্না করেছেন। বিদ্যালয় থেকে এসব রান্না শেখেননি। প্রাথমিক বিদ্যালয় রান্না শেখার জন্য নয়। সেটা হবে সময়ের অপচয়। কারণ এই রান্না শিখতে গিয়ে তার আসলে প্রয়োজনীয় অনেক লিখবার বিষয় বাদ পড়বে। কিন্তু তার দরকার হচ্ছে মাতৃভাষার উপর লেখাপড়ার দখল। ঠিক আরজ আলী মাতব্বরের মতো। শহরের কথা যদি বাদ রাখি, গ্রামের শিশুরা বাড়িতে বসে নানান রান্না শিখে নেয়। রান্না শেখাবার শিক্ষক তাদের প্রত্যেকর ঘরে আছে। সেটা শেখার জন্য তাদের বিদ্যালয়ে আসার প্রয়োজন নেই। ভ্লাদিমির লেনিনের কথা স্মরণ করে বলতে হয়, শিক্ষক মহাশয় সংগ্রাম কী সেটা শ্রমিকরা জানে। বরং তাদের শেখাতে হবে যা তারা কারখানায় শেখার সুযোগ পায় না। সমাজবিজ্ঞানের চেতনা তাদের কাছে পৌঁছে দিতে হবে। রান্না শেখাটা প্রাথমিক শিক্ষায় জরুরি নয়। বরং দেখতে হবে, এতকাল প্রাথমিক শিক্ষার সঙ্কট কী ছিল। প্রথম সেগুলো দূর করা দরকার। প্রাথমিক শিক্ষার মূল সঙ্কট ছিল প্রধানত দুটো। প্রথমত বিরাট পাঠক্রম, দ্বিতীয় শিক্ষকের সংখ্যা কম। কিছুতেই প্রাথমিক শিক্ষার একটি ক্লাসে ত্রিশ জনের বেশি শিক্ষার্থী থাকতে পারবে না। বিশ জন হলে আরো ভালো।

ঘ.
বাংলার নিজস্ব একটি প্রাথমিক শিক্ষাব্যবস্থা ছিল পাঠশালা, যা আজকের দিনেও খুব কার্যকর হতে পারে। সেখানে বাৎসরিক পরীক্ষা ছিল না, কিন্তু ছিল শিক্ষার্থী সম্পর্কে শিক্ষকের মূল্যায়ন। শিক্ষক মনে করতেন, এই শিশুর এটা শেখা হয়ে গেছে তাকে অন্য পড়া দিলেই হয়। শিক্ষকরা তখন শেখানোর ব্যাপারে আন্তরিক ছিলেন। এখনকার মতো ফাঁকিবাজ ছিলেন না। পাঠশালা শিক্ষা ছিল খুবই বাস্তবসম্মত। কিন্তু ব্রিটিশ শাসনে তা ধ্বংস করা হয়। ব্রিটিশরা প্রথম বাংলার মানুষের শিক্ষা নিয়ে মাথা ঘামায়নি। পরে শিক্ষার নামে হযবরল তৈরি করা হয়, রবীন্দ্রনাথের সেই তোতাকাহিনীর মতো। রবীন্দ্রনাথ সেই সময় ইংরেজদের শিক্ষানীতির সবচেয়ে বড় সমালোচক ছিলেন। অনেক লিখেছেন সেই শিক্ষার বিরুদ্ধে। রবীন্দ্রনাথ এত বিরক্ত ছিলেন সেই শিক্ষানীতির বিরুদ্ধে যে নিজেই বিদ্যালয়ে যাওয়া ছেড়ে দেন। সেই জন্যই পরবর্তী জীবনে রবীন্দ্রনাথ রবীন্দ্রনাথ হতে পেরেছেন, না হলে অতো বিদগ্ধ মন নিয়ে বঙ্কিমচন্দ্রের মতো আমলা হতেন। রবীন্দ্রনাথ ইংরেজদের শিক্ষানীতির বিরোধিতা করেছিলেন, কিন্তু আর একজন নমস্য ব্যক্তি ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর ইংরেজদের এ ব্যাপারে সহযোগিতা করেছিলেন। বিদ্যাসাগর এ দেশের প্রাথমিক শিক্ষাকে ধ্বংস করার জন্য ইংরেজদের সমপরিমাণ দায়ী। তিনি অনেক মহত কাজ করেছেন, কিন্তু প্রাথমিক শিক্ষাকে ধ্বংস করার জন্য মৃত্যুর পর এখনো তাকে আদালতে দাঁড় করানো যেতে পারে।

তিনি ইংরেজ নীতি নির্ধারকদের সঙ্গে হাত মিলিয়ে প্রাথমিক শিক্ষার পাঠক্রম এত বাড়িয়ে দিয়েছিলেন যে, সেটা উচ্চ মাধ্যমিকের সমান হয়ে দাঁড়িয়েছিল। প্রাথমিক শিক্ষায় এত বই বেড়ে গেল এবং পাঠ্যক্রম এতো বিশাল হলো যে, দরিদ্র মানুষের সন্তানরা পাঠশালা থেকে ঝরে পড়লো। ইংরেজরা এটাই চেয়েছিল। তারা বলেছিল শিক্ষা সবার জন্য নয়। যাদের হাতে পড়াশুনা করার মতো অনেক সময় আছে, যারা সমাজের উপর স্তরে বাস করে শিক্ষা শুধু তাদের জন্য। কারণ ইংরেজ শাসকরা চেয়েছিল অল্প কিছু লোককে শিক্ষিত করে তাদের ইংরেজদের চাকরি বাকরির কাজে লাগাতে। প্রাথমিক শিক্ষার সঙ্গে ইতিহাস ভূগোল সহ এত বিষয় যুক্ত করা হয়েছিল যে, শিক্ষার্থীরা হাঁপিয়ে উঠতো। বিদ্যালয়ে তার সবটা পড়নো সম্ভব ছিল না। ফলে ভদ্রলোকরা গৃহশিক্ষক রাখতে আরম্ভ করলেন। এইভাবে গৃহশিক্ষক শব্দটি বাংলার শিক্ষা ব্যবস্থায় চালু হয়ে গেল। বিদ্যাসাগর `প্রাথমিক শিক্ষা` দিয়েই শিশুদের বিরাট পণ্ডিত বানিয়ে তুলতে চাইলেন। কিন্তু রুশো বলছিলেন, শিশুকে শিশু থাকতে দাও। নীতিশিক্ষার যাঁতাকলে তাকে বয়স্ক মানুষ বানিয়ে তার শিশুবেলা ধ্বংস করার দরকার নেই। কিন্তু বিদ্যাসাগর এবং শাসকরা মিলে করলেন ঠিক তার উল্টোটা। বইয়ের সংখ্যা বিদ্যালয়ে বাড়িয়ে দিয়ে বিদ্যাসাগর নিজেই বইয়ের ব্যবসায় নেমে পড়েন। বইয়ের ব্যবসায়  তাঁর এত লাভ ছিল যে, তিনি তখনকার দিনে পাঁচশো টাকা মাইনের চাকরি ছেড়ে দেন। তিনি তাঁর মুনাফার টাকা অনেক ভালো কাজে দান করেছেন। কিন্তু সন্দেহ নেই যে, তিনিই প্রথম শিক্ষিত বাঙালী যিনি পাঠশালার মতো গুরুত্বপূর্ণ প্রাথমিক শিক্ষার ধ্বংস সাধন করেছিলেন। দরিদ্রদের পাঠশালায় লেখাপড়া বন্ধ করে দিয়েছিলেন।

ঙ.
বাংলাদেশে প্রাথমিক শিক্ষার সংস্কার সাধনে যা দরকার ছিল তা হলো, বই ও পাঠক্রম কমিয়ে দিয়ে মাতৃভাষায় শিশুদের প্রাথমিক দখল বাড়ানো। ব্রিটিশ শাসনের আগে মনুর বিধানে হিন্দু নারীদের শিক্ষালাভের সুযোগ ছিল না। ফলে তখন কলকাতায় বা বাংলায় নারীদের শিক্ষার হার ছিল শূন্য। ইংরেজদের আগমনে মিশনারিদের উৎসাহে বাংলাদেশ প্রথম নারীশিক্ষা শুরু হয়। মিশনারিরি সেজন্য ধন্যবাদ পেতেই পারে। বহু পরে বিদ্যাসাগর নারীদের প্রাথমিক শিক্ষাদানের উদ্যোগ নেন। রবীন্দ্রনাথের বোনেরা সেসব দিনে বিদ্যালয়ে পড়েননি। কিন্তু তারা ঘরে বসে বর্ণমালা শিখেছিলেন। বাংলাভাষায় সেভাবেই দখল তৈরি করে ছিলেন ঘরে বসে নিজ প্রচেষ্টায়। কিন্তু তাঁরা ইংরেজি জানতেন না। কিন্তু বাংলা ভাষায় অক্ষর জ্ঞান লাভ করার পর পরবর্তীতে বিভিন্ন বাংলা বইপত্র এবং পত্রিকা পাঠ করে ঘরে বসেই উচ্চ শিক্ষিত হয়েছিলেন। শুধু অক্ষর জ্ঞান নিয়ে নিজেদের এইভাবে আলোকপ্রাপ্ত করে তুলেছিলেন সে যুগের বহু নারী। রবীন্দ্রনাথের দিদি এবং বৌদিরা সেই যুগে পত্র পত্রিকায় লিখতেন। রবীন্দ্রনাথের দিদি `ভারতী` পত্রিকার সম্পাদক ছিলেন, যার বিদ্যালয়ের কোনো সনদপত্র ছিল না। দীর্ঘ তালিকা দেয়া যাবে সেই সময়ের নারীদের, যারা ঘরে বসে অক্ষর জ্ঞান শিখে এবং পরে নানা রকম চর্চার ভিতর সে যুগের নামকরা লেখক হয়েছিলেন। তাই প্রাথমিক শিক্ষায় শুধু সঠিকভাবে অক্ষরজ্ঞান দিতে পারলে সেটাই অনেক বড় কর্মসূচী হবে। রান্না না শেখালেও চলবে।

লেখক: শিক্ষাবিদ ও প্রাবন্ধিক