রাহমান চৌধুরীর গদ্য ‘কবির রঙবদল এবং তার ভাবশিষ্য’

প্রকাশিত : মার্চ ০৪, ২০২৪

তিনি কবি। বহু বহু বছর আগের কথা। কবি হিসেবেই সকলে চিনতেন। তিনি কবিতা লিখেছেন। পাশাপাশি লিখেছেন কিছু গল্প উপন্যাস নাটক এবং সমাজবিজ্ঞান নিয়ে প্রবন্ধ। সমাজের শিক্ষিত ও সুবিধাবঞ্চিত কিছু মানুষ তাঁকে যথেষ্ট সম্মান করতো। সুবিধাবঞ্চিতরা তাঁর ভক্ত হয়েছিল আসলে তাঁর কিছু গান শুনে। তিনি যাই লিখতেন তা ছিল বোধগম্য আর খুব সহজেই মানুষের চিন্তায় প্রতিধ্বনি তুলতে পারতো। তিনি জীবনের দীর্ঘ ত্রিশ বছর সাহিত্য রচনায় কখনো বাণিজ্যিক চিন্তা করেননি। যা কিছু লিখেছেন, বিশ্বের জ্ঞানভাণ্ডারের সংস্পর্শে এসে তার ভিতরের নির্যাস থেকে সম্পদ নিয়ে আর সেইসঙ্গে ব্যক্তিজীবনের অভিজ্ঞতাকে মিলিয়ে। তিনি লিখতেন যখন ভেতর থেকে লেখার তাড়না আসতো, কারো ফরমায়েশে নয়। তিনি লিখেছেন কম, যা লিখেছেন তার মধ্যে পাওয়া যায় গভীর অনুভূতি আর দর্শন। তিনি সমাজে এসব কারণেই কিছু মানুষের কাছে ছিলেন প্রবল এক ব্যক্তিত্ব আর খুব জনপ্রিয় না হলেও বিদগ্ধ জনের কাছে সমীহ আদায় করতেন।

হঠাৎ সেই মানুষটাকে দেখা গেল ক্ষমতার কাছাকাছি বসে আছেন। সমাজের নানা অন্যায়ের বিরুদ্ধে আর তিনি কলম ধরছেন না। কখনো প্রতিবাদ করছেন না। বরং ধনীদের আড্ডা আর মদের আসরে প্রায় তাকে দেখা গেল। তিনি যা লিখছেন তা যেন দুর্বোধ্য হয়ে উঠছে। তিনি হঠাৎ করে প্রকৃতি আর বন্য প্রাণীর বন্ধু হয়ে দেখা দিলেন। চরিত্র পাল্টাবার পর সব লেখাতেই প্রাকৃতিক সৌন্দর্য আর বন্য পশুপাখির প্রতি দরদ ফুটে উঠছে। যারা একদা তার একনিষ্ঠ পাঠক ছিল, দেখতে পেল তার লেখা পাঠ করে মানুষ নামক কোনো প্রাণী মহাদেশে আছে বলে জানা যায় না। শুধু আছে সুন্দর প্রকৃতি আর বন্য প্রাণীরা। বন্য প্রাণীর প্রতি তার ভালোবাসা যেন গৌতম বুদ্ধকে ছাড়িয়ে গেল। যখন কখনো সখনো মানুষের কথা আসে তার লেখায়, সেখানে আসে নর ও নারীর পরস্পরের প্রতি মুগ্ধতার কথা। শক্ত কলমে সেখানে ফুটে ওঠে নারীর সৌন্দর্য, বড় জোর কদাচিৎ সমাজবিচ্ছিন্নভাবে নারীর শোষিত হবার চিত্র।

সমাজের সচেতন মানুষরা খুব সহজে বুঝে নেন তিনি ক্ষমতার পদলেহন করছেন, সকল রকম প্রতিবাদ থেকে নিজের কলমকে দূরে সরিয়ে নিয়ে গেছেন। বহুদিনের কাছের মানুষরা প্রায় সকলেই তাকে ছেড়ে চলে গেলেন। সেখানে নতুন অনেককে পেলেন সরকারি দলের। তিনি এখন সরকারী দলের বিভিন্ন সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান উদ্বোধন করেন, দেশ যে এগিয়ে যাচ্ছে সেকথাটাও বলতে দ্বিধা করেন না। কিন্তু পূর্বের সেই উজ্জ্বল ব্যক্তিত্ব আর নেই, নিষ্প্রভ লাগে তাকে। বহু মানুষ তার চারদিকে থাকে, সকলে তার সঙ্গে ছবি তোলার জন্য মুখিয়ে থাকে। তিনি নীরবে ছবি তোলেন তাদের সঙ্গে। খুব খারাপ আর সুবিধাবাদী লোক এই  দলে আছে, কবি যাদের সমীহ কুড়াতেন আগে। কিন্তু সেই সব মানুষদের অনেকে বর্তমা‌নে তার সঙ্গে ছবি তুললেও তাকে আর আগের মতো মনের ভিতর থেকে সম্মান করতে পারে না। মনে মনে ভাবে, সম্মানিত মানুষটা শেষ পর্যন্ত আমাদের মতো ভণ্ড হয়ে গেলেন তবে! কবি এসব নিয়ে মাথা ঘামান না, সব অনুষ্ঠানের বিভিন্ন রকম আনুষ্ঠানিকতা পালন করেন।

কবি টের পান, তার প্রিয় মানুষরা তাকে ছেড়ে চলে গেছে। তিনি সেসব নিয়ে খুব ভাবতে চান না। কারণ ভাবতে গেলে কষ্ট বাড়বে। তিনি জানেন, তার নিরুত্তাপ কবিতা বা লেখনিগুলো এখন আর কারো মনে উত্তাপ ছড়ায় না। তিনি ক্ষমতা পেয়েছেন, অর্থশালী হয়েছেন সেটা তো আর মিথ্যা নয়। চিকিৎসা লাভের জন্য এখন আর বন্ধুদের কাছে হাত পাততে হয় না। তিনি সম্ভব হলে দূরে সরে থাকা বন্ধুদের আর্থিকভাবে সাহায্য করার চেষ্টা করেন। তিনি টের পান, তার কলম চলছে না, কবিতা ছাড়া আর কিছু লেখেন না আজকাল। লিখতে উৎসাহ বোধ করেন কম। কিন্তু যা লেখেন বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানগুলোর তা নিয়ে হৈ চৈ করার কমতি নেই। সবগুলো কবিতা ছাপার জন্য অনেক টাকা পান। তবুও তিনি এখনো ফরমায়েশি কিছু লিখতে চান না। কয়েক বছর আগেও যখন সৃষ্টিশীলতার চরম জায়গায় পৌঁছে গিয়েছিলেন, তার কপালে রাষ্ট্রীয় পদক জোটেনি। তিনি যে সেসব পেতে খুব লালায়িত ছিলেন, তাও নয়। কিন্তু সম্পূর্ণ অযোগ্যদের যখন তা পেতে দেখেছেন, মনে মনে ক্ষুব্ধ হয়েছেন। কিন্তু এখন তিনি নিজেই মাঝে মধ্যে সরকারের পদক পাচ্ছেন। তিনি মনে মনে হাসেন, তিনি নিজেই যেগুলিকে আহা মরি কবিতা মনে করেন না, সেগুলির জন্যেই পদক পাচ্ছেন একটার পর একটা। যা ছিল তার বুকের ফোঁটা ফোঁটা রক্ত দিয়ে লেখা কবিতা, তার জন্য কখনো পুরস্কার মেলেনি। পুরস্কার পাবার হিসেবটা তিনি আজও ঠিকমতো মেলাতে পারেন না।

তিনি সেদিন সকালে তার পুরানো এক শিষ্যের জন্য অপেক্ষা করছিলেন। পুরানোরা কেউ আর এখন তার কাছে আসে না বললেই চলে। কিন্তু প্রবাসী এক শিষ্য গতকাল দেশে ফিরেই তাকে ফোন করেছিলেন, কবির সঙ্গে দেখা করতে চান। তিনি আজ সকালেই তাকে আসতে বলেছেন। শিষ্য হলেও সে প্রতিষ্ঠিত মানুষ। দেশের বাইরে বিজ্ঞানচর্চা জন্য বিশেষ খ্যাতি আছে তার।  সেই শিষ্যর প্রতি কবির একটা বিশেষ দুর্বলতা আছে। যখন কবি হিসেবে তিনি একেবারেই পরিচিত ছিলেন না, তখন এই শিষ্য মনোযোগ দিয়ে তার কবিতা শুনতেন, লেখাগুলো পড়তেন। কবির চেয়ে তার বয়স অনেক কম হলেও, কবিকে উৎসাহ জোগাতেন। শিষ্যটির কাছে বহু বিখ্যাতদের কবিতা বাতিল হয়ে যেত, কিন্তু তার কবিতা সম্পর্কে সে তখনই বলেছে `মানুষের বোধগম্য ভাষায় মানুষের জন্য গভীর অনুভূতি সমৃদ্ধ`। শিষ্যের সেই বাক্যটা হুবহু আজও স্মরণে আছে। শিষ্য নিজেও কবিতা লিখতে চেয়েছিল, লিখবার হাত ভালো ছিল। কিন্তু শিষ্য নিজেই নিজের লেখা কবিতাগুলিকে কখনো মানসম্পন্ন মনে করতো না। কবিতা লেখা ছেড়েই দিল তার শিষ‌্য। কবি শিষ্যকে বাধা দিয়েছিলেন কিন্তু শিষ্য শোনেনি। শিষ্য বলেছিল, কবিতা আমার চায়ের পেয়ালা নয়, বিজ্ঞানের সাধনা করতে চাই আমি। সবাইকে কবি হতে হবে কেন, বিজ্ঞানের গবেষণা তাহলে কারা করবে? কবিতার চেয়ে বিজ্ঞানের প্রয়োজন কম নয়।

শিষ্য তারপর আর কখনো কবিতা লেখেনি। যা লিখেছিল কয়টা এখনো কবির কাছে সংরক্ষিত আছে। কবি জানে, সেসব ছাপিয়ে দিলে বহু কবির কবিতা ম্লান হয়ে যাবে। শুধু তাই নয়, নতুন এক কবির দেখা পাবে তার দেশের জনগণ। শিষ্যের কবিতাগুলি কবি তার সুদিনে তার জনপ্রিয়তার দিনে ছাপিয়ে দিতে চেয়েছিলেন, শিষ্য যখন প্রবাসে। শিষ্যকে রাজি করাতে পারেননি। সেই শিষ্যর দেখা পাবেন আজ বহু বছর পর।

শিষ্য এলো সময় মতো। বলা ছিল সবাইকে কেউ যেন আজ তাকে কোনোরকম বিরক্ত না করে। দুজনে বসলো মুখোমুখি। দুজনের জন্য কফি, নানারকম নাস্তা আর ফল ছিল। কবি এর আগে কখনো শিষ্যকে এমনভাবে আপ্যায়ন করার সুযোগ পাযননি তার আর্থিক দুর্দিনে। ফলে আজ যতটা সম্ভব করার চেষ্টা করেছেন। মনে মনে একটা ভয় ছিল তার।  শিষ্য ঘরে ঢুকেই একটা কাগজের প্যাকেট থেকে কয়েকটা পরোটা আর মিষ্টির দোকানের ভাজি বের করে কবির সামনে রাখলো। কবিকে বললো, এটাই আমা‌দের আজকের নাস্তা হোক। বহুদিন পর দেশে ফিরে আপনার সঙ্গে এটা খাবো ঠিক করেছি। মনে আছে নিশ্চয়ই, এক সময়ে আমরা দুজনেই এ নাস্তাটা পছন্দ করতাম। তখন খুব ভালো কিছু খাবার সঙ্গতি আমাদের ছিল না।

কবি কিছু বলতে পারলেন না। এই শিষ্যকে তিনি খুব গুরুত্ব দেন, আর এখন তাকে কিছুটা সমীহ করেন। শিষ্য বললো, দেখতে পাচ্ছি আপনার টেবিলে আমাদের জন্য দামি অনেক নাস্তা রাখা আছে, প্রতিদিন এসব খাবার সামর্থ আজ আমাদের দুজনেরই হয়েছে। বরং সেই আগের স্মৃতিচারণ করে আমার নিয়ে আসা এই সামান্য নাস্তা খেতে কি আপনার আপত্তি আছে? কবির মুখে কথা নেই। হঠাৎ কবি ঝরঝর করে কেঁদে ফেললেন। কবির কান্নার কারণ শিষ্য ধরতে পারলো। কবিকে খুব ভালো চেনে সে। কবির কান্না দেখে শিষ্য প্রথম কিছুই বললো না। চুপ করে রইলো। পরে বললো, মানুষ যখন কাঁদতে পারে মনে করতে হ‌বে এখনো তার ভিতরের সব অনভূতি নিঃশেষ হয়ে যায়নি।

কবি নিজের কান্না সংবরণ করলেন। শিষ্যের কাছে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে জানতে চাইলেন, সত্যি করো বলো এতদিন পর তুমি দেশে কেন এসেছো? শিষ্য বললো, নিশ্চয়ই বলবো। আসেন আগে নাস্তা খাই, দুজনেই অতীতকে স্মরণ করি। কবি কিছু বলতে গেলে শিষ্য থামিয়ে দিয়ে বললো, যখন আমরা আমাদের অতীত স্মরণ করবো বা অতীতে ফিরে যাব, তখন আমাদের দুজনের মধ্যে নীরবে অনেক কথা হবে। মুখের ভাষায় কথা বলে আমরা সেই কথাগুলো বলতে পারবো না। কবি হিসেবে সেটা আপনি ভালো জানেন, নীরবতার ভাষা আছে। প্রিয় কবি এবং আমার কম বয়সের শিক্ষক, আসেন চুপচাপ দুজনে নাস্তা খাই। কথা বলার জন্য হাতে অনেক সময় আছে আমাদের, শুধু আপাতত এটুকু বলে রাখি, দেশে আসার প্রধান কারণ আপনার সঙ্গে কিছুটা সময় কাটানো। হঠাৎ কাজের ব্যস্ততার মধ্যে আপনার কথা খুব মনে পড়ছিল, আমার সেই দিনগুলির কথা মনে পড়ছিল  যখন আমার এত প্রচার ছিল না এবং এত আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি ছিল না। সত্যি বলতে, সেইগুলি ছিল জীবনের সবচেয়ে সুন্দর দিন। জীবনে অনেক কিছু পেতে চেয়েছি জীবনকে গভীরভাবে না জেনেই। কারণ চারদিকের শত মানুষের চাওয়াই আমার চাওয়াকে প্রভাবিত করেছিল। বুঝতে পারি, এভাবে প্রভাবিত হওয়াটা ভুল। কিন্তু মানুষের জীবনে কিছু না কিছু ভুল থাকবেই।

কবি এবার নিজেই খুব শান্ত সমাহিত হয়ে বসলেন, যেন বহু বছরের আগের মানুষটি। শিষ্যকে বললেন, ঠিক আছে, আসো আগে তোমার আনা নাস্তাটা খাই, বহুদিন এসব আমারও খাওয়া হয় না। দুজনে নীরবে বা কিছু ঘরোয়া কথা বলার মধ্যদিয়ে নাস্তা খাওয়া সম্পন্ন করলেন। নাস্তা খাওয়ার পর কবি খানিকটা আয়েস করে বসে বললেন, বুঝতে পেরেছিলাম আমার দেয়া নাস্তা তুমি খাবে না। কারণ তুমি জানো, নাস্তাটা সরকারি ব্যবস্থাপনায় করা হয়েছে। কিন্তু তুমি সরকারি কাজে আমার কাছে আসোনি। এটাই তো তোমার যুক্তি। সবসময় তোমার এরকম যুক্তি আমি পছন্দ করেছি এবং আজও পছন্দ করি আর সম্মান করি। কিন্তু আজকের নাস্তার ব্যবস্থা করেছিলাম আমার ব্যক্তিগত আয়ের সামান্য টাকায়। শিষ্য বললো, আপনার ধারণা ভুল। আমি জানতাম আপনি আমার জন্য নিজের টাকায় নাস্তার ব্যবস্থা করবেন। কিন্তু আমি নাস্তার টেবিলে আমাদের অতীতটা স্মরণ করতে চেয়েছিলাম বলেই, নিজে থেকে এ নাস্তাটা নিয়ে এসেছি। নিশ্চয় আপনার আমার একটা অতীত ছিল। সেই অতীত দিনে আমাদের কতগুলি প্রতিশ্রুতি ছিল। মনে আছে কি, হঠাৎ এক আড্ডায় এক ধনী লোক আপনাকে বলেছিল, `আমার নামে কিছু কবিতা লিখে আমার নামেই একটা বই বের করে দাও, তাহলে তোমাকে অনেক টাকা দেব`।

কবি বললেন, মনে থাকবে না কেন? শিষ্য বললো, সেটা ছিল আমাদের দুর্দিন যখন ঠিকমতো খাওয়া জুটতো না। কিন্তু সেই দুর্দিনে অনেক টাকা পাওয়ার সম্ভাবনা আপনি তুড়ি মেরে উড়িয়ে দিয়ে রেগে সেখান থেকে বের হয়ে এসেছিলেন। কবি প্রবল দৃষ্টি হেনে বললেন, জানি, পুরানো দিনের উদাহরণ টেনে কী বলতে চাও। সেদিন টাকার লোভ সামলাতে পারলে আজ কেন টাকার জন্য সরকারের কাছে মাথা অবনত করলাম? তাই না?

শিষ্য কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বললো, শিল্প সাহিত্য সব সময় ধনীদের টাকার কাছে বিক্রি হয়েছে। কখনো আবার ধনীদের পৃষ্ঠপোষকতায় অনেক মহৎ শিল্প সাহিত্য সৃষ্টি হয়েছে। কবি বললেন, সামন্তযুগের কথা বলছো বা পুজিঁবাদের প্রথম পর্বে এসব ঘটেছিল কিছুদিন। কিন্তু এখন কী ঘটছে? শিষ্য বললো, সেই বিতর্ক করতে আমি আসিনি। শুধু জানতে এসেছি আপনি কেন করলেন, নিজেকে কেন সরকারের দালাল বানালেন? কবি আর যাই হোক, `সরকারের দালাল` শব্দটা শিষ্যের কাছে থেকে শুনবেন বলে আশা করেননি। খুব লাগল তার।  বললেন, সাহিত্যকে আমি সরকারের কাছে বিক্রি করেছি তা কিছুতেই বলতে পারো না। বিক্রি করেছি নিজেকে। বলো, বহুকাল ধরে যা আমি লিখেছি তার কোনটা সরকারের পদলেহন করে লেখা? কবির কথায় সন্দেহ নেই, শিষ্য বড় রকমের একটা ধাক্কা খেল। কারণ কবির সব লেখা সে এখনো মনোযোগ দিয়ে পাঠ করে থাকে। সরকারের পক্ষে কবি কিছু লিখেছে প্রমাণ করা যাবে না। শিষ্য বললো, সরকারের পক্ষে যারা লিখছে তাদের সঙ্গে বসে কি দিনের পর দিন আড্ডা দিচ্ছেন না। সরকারি পদক গ্রহণ করছেন না? কবি বললেন, সরকারি পদক গ্রহণ করেছি, সবরকম সুযোগ সুবিধা গ্রহণ করেছি, কিন্তু সরকারের পক্ষে সাহিত্য লিখিনি।

শিষ্য বললেন, তাহলে কি জনগণের পক্ষে লিখছেন? কবি বললেন, একদা জনগণের পক্ষে লিখতাম। কিন্তু এখন আর তাও লিখি না। শিষ্য বললেন, হঠাৎ এমন মতি হলো কেন?

কবি হঠাৎ প্রচণ্ড রেগে গেলেন? চীৎকার করে বললেন, শাসকদের রক্তচক্ষু তুমি বোঝো? নামিদাদি শিল্পী সাহিত্যিকদের জন্য নানারকম লোভ লালসার ইঙ্গিত, কত রকম সুবিধা পাবার সুযোগ আছে রাষ্ট্রের ভিতরে, তা তুমি জানো? নাকি জানো না? যখন সবাই গিয়ে সেখানে কিছু পাবার জন্য ভিড় করছে তখন আমার একার পক্ষে কতক্ষণ তার বাইরে দাঁড়িয়ে থাকা সম্ভব? শিষ্য বললো, সেজন্য জনগণের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করবেন? জনগণের পক্ষে সারা জীবন লিখলেন, সারা জীবন জনগণকে বিপ্লবের বাণী শোনালেন, আর এখন সেখান থেকেই দূরে সরে গেলেন? কবি বললেন, জনগণকে বলো ব্যক্তিপূজা না করতে। কবি লেখক শিল্পীদের পূজা না করতে। বরং ব্যক্তিকে, কবিকে পূজা না করে যদি তারা কখনো কিছু ভালো লিখে থাকে সেটাকেই শুধু অনুসরণ করতে বলো। ব্যক্তিগত সম্পত্তির সমাজে ব্যক্তি যখন তখন পাল্টাতে পারে। কারণ এ সমাজ ব্যবস্থাটিই তেমন। সাহসী মানুষেরাও কখনো কখনো লড়তে লড়তে ক্লান্ত হয়ে আর লড়তে পারে না। যখন দেখে সে একাই লড়ে যাচ্ছে, বাকিরা নিজেদের বিক্রি করে দিয়েছে তখন সেই একা মানুষটা আর কতক্ষণ লড়বে। কখনো কখনো সে হেরে যাবার চেয়ে আপস করা পছন্দ করে। ইতিহাসের দিকে তাকাও, দেখো ঠিক বলেছি কি না।

শিষ্য দীর্ঘ নিঃশ্বাস ছেড়ে চলে যাবার জন্য দাঁড়িয়ে আবার বসে পড়লো। কবি চুপ করে রইলেন। শিষ্য কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বললেন, যখন আমি নিজে বিজ্ঞানের সেবা করতে যাই তখন বুঝতে পারিনি, বিজ্ঞানের সেবা করতে গিয়ে আমি কতগুলো ব্যবসায়ীর সেবা করছি। বিজ্ঞানের নামে কতগুলো যুদ্ধবাজের হয়ে কাজ করছি। মনে মনে তখন সান্ত্বনা ছিল আপনি লিখছেন জনগণের পক্ষে। জনগণ জেগে উঠলে আমরা মুক্তি পাব। বিজ্ঞানের সাধনাকে জনগণের পক্ষে কাজে লাগাতে পারবো। জানি সেটা দীর্ঘ সময় সাপেক্ষ ব্যাপার। কিন্তু আপনি আমার সব স্বপ্ন ভেঙে দিলেন, আমার বিশ্বাসের জায়গাটা নষ্ট করলেন! বাকিদের মতো শিল্প সাহিত্যকে বিক্রি করলেন ক্ষমতার কাছে। কবি বললেন, দয়া করে বাকিদের সঙ্গে আমাকে মিলিও না। সেটা করলে ভুল করবে। শিষ্য জানতে চাইলো, বাকিদের চেয়ে কোথায় আপনি আলাদা?

কবি অনেকক্ষণ চুপ করে থাকলেন। তারপর আসন ছেড়ে উঠে দাঁড়ালেন। শিষ্যের দিকে তাকিয়ে বললেন, ঠিক যেমন তুমি কোনো কিছু মানসম্পন্ন না হলে কবিতা বলতে চাওনি, শিল্প-সাহিত্য বলতে চাওনি, তেমনি আমিও নিম্নমানের কিছু লিখিনি। বাকি অনেকে যেমন যা কবিতা নয় তাকে কবিতা বলে চালিয়েছে, যা সাহিত্য নয় তাকে সাহিত্য বলে স্বীকৃতি দিয়েছে, আমি কি কখনো তা করেছি? কখনো কি প্রকাশকের দয়া নিতে গিয়েছি? সাহিত্যিক জীবনের শুরু থেকেই গভীর পড়াশুনার ভিতর দিয়ে কি গভীর কথাগুলি বলতে চেষ্টা করিনি? যা মনে হয়েছে সাহিত্য নয়, তা কি ছিঁড়ে ফেলিনি? শিষ্য বললেন, হ্যাঁ, বহু কাল সেটা আপনি করেছেন। কবি বললেন, বাকিদের সঙ্গে তবে আমাকে মেলাচ্ছ কেন? বাকিরা সাহিত্য জীবনের শুরু থেকে ফাঁকিবাজি করেছে। সাহিত্য কী না বুঝে নিজের প্রতিষ্ঠার জন্য কেবল সাহিত্য নামক আবর্জনা লিখেছে। বহুলোক প্রকাশনা জগতের সঙ্গে হাত মিলিয়ে সেইরকম সব আবর্জনা লিখে বিরাট কবি সাহিত্যিক বনে গেছে। বড় বড় পুরস্কার পেয়েছে। কখনো কি আমি সেই রাস্তায় হেঁটেছিলাম? শিষ্য দৃঢ়তার সঙ্গে বললো, ঠিক যে আগে হাঁটেননি কিন্তু এখন?

কবি বললেন, এখন কী করেছি সেটা জানতে চাও? শিষ্য বললো, বলেন আপ‌নি। য‌দি আপনার আমা‌কে কিছু  জানা‌নোর থা‌কে কেন সেটা জানতে চাইবো না? কবি বললেন, শুধুমাত্র ব্যক্তি হিসেবে তুমিই, যাকে কৈফিয়ত দেয়া দরকার বলেই দিচ্ছি। হ্যাঁ, শেষপর্যন্ত আমি শাসকদের রক্তচক্ষুর কাছে মাথা নত করেছি। সুযোগ সুবিধাও নিয়েছি। শাসকদের পক্ষে কথা বলেছি বাধ্য হয়ে। কিন্তু চাটুকারদের মতো নিজের সাহিত্যকে কখনো আমি শাসকদের পক্ষে ব্যবহার করিনি। কখনো একটি পঙক্তি লিখিনি শাসকদের পক্ষে। জনগণের পক্ষেও লেখা ছেড়ে দিয়েছি বটে। বলতে পারো সাহিত্যচর্চাই ছেড়ে দিয়েছি। শিষ্য বললো, জনগণকে ছেড়েছেন, কিন্তু সাহিত্যচর্চা ছাড়েননি। লিখছেন জনগণ বিপ্লব এসব বাদ দিয়ে প্রকৃতি, পাখি প্রেম আর নারীর সৌন্দর্য নিয়ে। কবি বললেন, সত্যি বলতে এটাই আমার শঠতা যে, জনগণের পক্ষে এখন আর কলম ধরছি না। কিন্তু প্রকৃতি, পাখি আর নারীর সৌন্দর্য নিয়ে এত লিখছি কেন জানো? জনগণকে বাদ দিয়ে শাসকদের পক্ষে কলম ধরবো না বলে। বাকিরা যখন শাসকদের পক্ষে লিখছে তখন আমি শাসকদের পক্ষে লিখবো বলেই ইচ্ছাকৃতভাবে প্রকৃতি, পশু পাখি আর নারীর সৌন্দর্যের মধ্যে সব লেখা সীমাবদ্ধ রেখেছি। কবি পুশকিনের কাছ থেকেই এ কৌশল আমি শিখেছি। শাসক তাতেই খুশি, আমাকে নিয়ে আর ভয় নেই তাদের।

শিষ্য বললো, সব শাসকদের আমলে প্রায় সব দেশে এমন হয়েছে, শাসকদের চোখ রাঙানিতে প্রগতিশীল লেখকদের লেখা থেমে গেছে। কিন্তু তার বাইরে সত্য আছে হে কবিবর। বহু লেখকরা নিজেরাই শাসকদের চাটুকারি করেছে। হয়তো কেউই তাদের বাধ্য করেনি। সবাইকে বাধ্য করা হয় না, পদলেহন করা তাদের স্বভাবের অংশ। বলতে পারি যে, এরা খুব বড় মাপের শিল্পী সাহিতিকও নয়। শুধু শাসকদের কাছ থেকে সুযোগ সুবিধা নেবার জন্যেই এসব করছে। বহুজন গবেষণার নাম করে বিশেষ কোনো দলের বা বিশেষ কোনো সরকারের পক্ষ নিচ্ছে। বিশেষ কোনো দল বা সরকারের পক্ষ নিয়ে কি নিরপেক্ষ গবেষণা বা সত্যিকারের গবেষণা করা সম্ভব? বহুকাল ধরে শিক্ষা, গবেষণা, শিল্প সাহিত্যের নামে এসব চলছে। সব দেশেই এসব হয়। সবদেশেই আবার শাসকদের বিপরীতে বৃহত্তর মানুষের স্বার্থে মহান সব শিল্প-সাহিত্য আর গবেষণা পাওয়া যাচ্ছে। কবি আপনি তো শেষ দলেই ছিলেন। কিন্তু নিজেকে পাল্টে ফেললেন শুধু কি শাসকদের রক্তচক্ষুর ভয়ে। নাকি ভিন্ন কারণ ছিল?

কবি অনেকক্ষণ চুপ করে থেকে বললেন, ঠিক, এখন মনে হচ্ছে শাসকদের দোষারোপ করে লাভ নেই, নিজেই আমি ভিতর থেকে হতাশ হয়ে পড়েছিলাম, দিশেহারা হয়ে পড়েছিলাম। নিজের ভিতরে যে দুর্বলতা দেখা দিয়েছিল সেটাই আমার এই পতনের কারণ। অন্যকে কেবল দোষ দিয়ে লাভ নেই। কারণ সব রকম পারিপার্শ্বিকতার মধ্যেই কিছু মানুষকে মাথা তুলে দাঁড়িয়ে থাকতে হয়। না হলে দমবন্ধ করা পরিবেশের মধ্যেও বিপ্লব হচ্ছে কী করে? কাউকে দোষারোপ না করে এখন বলতে চাই, হয়তো পারিপার্শ্বিকতার কারণেই নিজের মনোবল ক্ষয় হয়ে যাচ্ছিলো। মনোবল ভেঙে পড়ার কারণেই সহজেই শাসকদের রক্তচক্ষুর সামনে দুর্বল হয়ে পড়েছিলাম।

শিষ্য বললো, এই তো আবার সেই পুরানো চিন্তাগুলো আপনার মধ্যে ফিরে আসছে। কবি বললেন, হয়তো সঙ্গ দোষ, তুমি আমার উপর প্রভাব বিস্তার করে রেখেছো। শিষ্য বললো, বুঝতে পেরেছি আপনার পাশে দাঁড়ানোর মতো লোকের সংখ্যা কম দেখে মনোবল হারিয়ে ফেলেছিলেন। শুধু নিজের জন্য নয়, চারদিকের মানুষদের জন্য আপনার মনোবল অটুট রাখতে হবে। যারা জীবনের প্রায় শুরু থেকে চাটুকার, সুবিধাবাদী, নীতিহীন তাদের নিয়ে কথা বলছি না। সবাই তারা আমার এ আলোচনার বাইরে। কিন্তু আপনি মনোবল হারাতে পারেন না। গ্যালিলিওর মতো রক্তচক্ষুর সামনে দাঁড়িয়ে সত্য বলা থেকে খানিকের জন্য বিরত থাকতে পারেন। মানুষের ভিতরের প্রকৃত জ্ঞান কিছুতেই তাকে সত্য উচ্চারণের আনন্দ থেকে দূরে সরাতে পারে না। সক্রেটিস, গ্যালিলিও তারই প্রমাণ। গ্যালিলিও সেদিন রক্তচক্ষুর সামনে দাঁড়িয়ে মিথ্যা বলেছিলেন কেবল সত্য বলার লক্ষ্যেই বেঁচে থাকার জন্য। কারণ মরে গেলে তাঁর আবিষ্কারের কথাগুলো আর বলা হতো না।

কবি মনোযোগ দিয়ে শিষ্যের কথাগুলো শুনলেন। কিছুক্ষণ পর বললেন, এবার আমি বুঝতে পেরেছি কী বলার জন্য তুমি আমার এখানে এসেছো। কৃতজ্ঞতা জানাই তোমাকে। বসো, এবার আমরা এক পেয়ালা করে কফি খাই। সর্বদাই তোমার সঙ্গে বসে কফি খাওয়াটা আমার জন্য আনন্দদায়ক।
১৮ অ‌ক্টোবর ২০২২

লেখক: শিক্ষাবিদ ও প্রাবন্ধিক