রেজা ঘটকের প্রবন্ধ ‘সক্রেটিসের বিচার’

ছাড়পত্র ডেস্ক

প্রকাশিত : ফেব্রুয়ারি ১৫, ২০২৪

যিশুখ্রিস্টের জন্মের প্রায় ৪০০ বছর আগে সক্রেটিসের বিচার হয়েছিল। ৭০ বছর বয়সে দার্শনিক সক্রেটিস বিচারকদের সম্মুখীন হয়েছিলেন। সক্রেটিসের বিরুদ্ধে প্রধান তিনটি অভিযোগ ছিল এরকম:

১. তিনি দেশের প্রচলিত দেবতাদের উপেক্ষা করেছেন।
২. তিনি নতুন নতুন দেবতাদের সৃষ্টি করেছেন এবং
৩. তিনি যুবকদের নৈতিক চরিত্র কলুসিত করে তাদেরকে বিপথে চালিত করেছেন।

সক্রেটিসের বিরুদ্ধে এই তিন অভিযোগ করেছেন তখনকার দিনে এথেন্স শহরের খ্যাতিমান তিন পুরুষ। তারা হলেন:
১. কবি মিলেটাস
২. শিল্পী অ্যানিটাস ও
৩. রাজনৈতিক নেতা লাইকন।

তখনকার দিনে বিচারসভায় কোনো আইনজীবী বা উকিল থাকত নো। অভিযোগকারী ও অভিযুক্ত উভয়কেই তখন নিজের পক্ষ সমর্থন করে বিচারসভায় বক্তব্য দিতে হতো।

বিচারসভায় অভিযোগকারীদের অভিযোগ শোনার পর সক্রেটিস বলেছিলেন, হে এথেন্সের অধিবাসীবৃন্দ, আমার অভিযোগকারীদের বক্তব্য আপনাদের কেমন লেগেছে জানি না। কিন্তু তাদের বাককুশলতায় আমি সত্যি মুগ্ধ হয়েছি। যদিও তারা একটিও সত্য কথা বলেননি। তবে তাদের মিথ্যে কথার মধ্যে একটি কথা আমাকে চমকে দিয়েছে। তারা আপনাদের বলেছেন যে আপনারা যেন আমার বাগ্মিতার দ্বারা প্রতারিত না হন। তাদের এই কথাটি শুনে আমি চরমভাবে লজ্জিত হয়েছি। কারণ, আমি কথা বললেই আপনারা বুঝতে পারবেন যে আমার অন্য আর যে গুণ-ই থাকুক না কেন, বাগ্মিতা এই গুণটি আমার একেবারেই নেই। তবে তারা যদি বাগ্মিতার গুণ বলতে সত্যকে বুঝিয়ে থাকেন, তবে নিশ্চয়ই আমি একজন বক্তা।  

এরপর বিচারসভায় সক্রেটিস বলেন, এর আগেও আমার বিরুদ্ধে অনেকে অভিযোগ করেছেন, আমি নাকি বাতাসে ভর দিয়ে হেঁটে বেড়াই। কেউ বলেছেন, সক্রেটিস নামের একজন লোক স্বর্গের সন্ধান করছেন। কেউ বলেছেন, সক্রেটিস নাকি ভাবনা নামক একটি দোকান থেকে ছাত্রছাত্রীদের কাছে ভাবনা বিক্রি করেন। পদার্থবিদ্যা, জীববিদ্যা ছাত্রছাত্রীদের তিনি নাকি পড়ান, তিনি নাকি শিক্ষক ইত্যাদি ইত্যাদি। কিন্তু সেসব অভিযোগ কোনোটাই প্রমাণিত হয়নি।

বিচারসভায় সক্রেটিস সবাইকে অবাক করে দিয়ে বললেন, তার প্রধান সাক্ষি হলেন ডেলফির প্রধান দেবতা অ্যাপোলো। একদিন আমি দেবতা অ্যাপোলোকে জিজ্ঞেস করেছিলাম, সক্রেটিসের চেয়েও বেশি জ্ঞান আছে এরকম কোনো জ্ঞানী পুরুষ কোথাও আছে কিনা? জবাবে দেবতা অ্যাপোলো উত্তর দিয়েছিলেন, সক্রেটিসের চেয়ে জ্ঞানী পুরুষ আর কেউ কোথাও নেই। বন্ধুর কাছে এমন দৈববাণী শোনার পর সক্রেটিস বললেন, আমার তো কোনো জ্ঞান নাই। কিন্তু দেবতা অ্যাপোলো মিথ্যে কথা বললেন কেন? দেবতা যে মিথ্যে বলছেন, একথা প্রমাণ করার জন্য আমি একজন জ্ঞানী পুরুষ খুঁজে বের করব।

এরপর সক্রেটিস এথেন্সসহ তার আশেপাশের শহর ও গ্রীসের সর্বত্র জ্ঞানী পুরুষ খুঁজে বের করতে অনুসন্ধান শুরু করলেন। এবং একে একে তাদের জ্ঞানের পরিধি পরীক্ষা করতে শুরু করলেন। তিনি বিস্মিত হয়ে আবিস্কার করলেন যে, সমাজে যারা জ্ঞানী মানী ব্যক্তি হিসেবে সুপ্রতিষ্ঠিত, আদতে তারা কেউই যথার্থ জ্ঞানী নন। কুপমণ্ডুকতাই তাদের জ্ঞানের বৈশিষ্ট্য। সক্রেটিসের যুক্তির কাছে তারা সকলেই পরাস্ত হলেন। তাদের সকলের উদ্দেশ্যে তখন সক্রেটিস একটা তাৎপর্যপূর্ণ কথা বলেছিলেন:

আপনি বা আমি কেউ জ্ঞানী নই। আপনার চেয়ে আমার জ্ঞান শুধু এইমাত্র বেশি যে, আমি জানি আমি কিছুই জানি না, কিন্তু এ জ্ঞানটুকুও আপনার নেই।

সক্রেটিসের এই পরীক্ষা কার্যের জন্যই তথাকথিত জ্ঞানী মানী ব্যক্তিরা সকলেই হয়ে উঠেছিলেন সক্রেটিসের চরম শত্রু। মূলত তাদেরই প্ররোচনায় তিন অভিযোগকারী আদালতে অভিযোগ জানিয়েছিলেন। সক্রেটিস তার সম্পর্কে ওঠা সমস্ত অভিযোগ খণ্ডন করে আদালতে প্রমাণ করেছিলেন যে, তিনি প্রচলিত কোনো দেবদেবীকে উপেক্ষা করেননি। নতুন কোনো দেবদেবীকেও তিনি সন্ধান করেননি। তিনি শুধু সবকিছুর এমনকি দেশের গণতন্ত্রের মহত্ব, গুরুত্ব, পবিত্রতা সম্পর্কে অনবরত প্রশ্ন করেছেন।

তিনি বলেছেন যে সবকিছুকে বিচার করতে হবে যুক্তি দিয়ে। যুক্তির কষ্টিপাথরে বিচার করেই সবকিছুকে গ্রহণ করতে হবে। তিনি ছিলেন একজন মুক্তচিন্তক। তিনি বলতেন, রাষ্ট্র হচ্ছে একটা বিশাল ঘোড়ার মত। বিশাল বপুর জন্য এটা অলস ও মন্থরগতি সম্পন্ন হয়ে পড়ে। আর নাগরিক হিসেবে তার দায়িত্ব হলো হুল ফুটিয়ে ঘোড়াটিকে চাঙ্গা রাখা। এজন্য সবসময় তিনি সবাইকে আলোকিত করার চেষ্টা করেছেন। সবাইকে জাগানোর চেষ্টা করেছেন।

আমি সবাইকে বলেছি যে আত্মার উন্নয়ন বা পরিচর্চা করতে হলে করতে হবে জ্ঞান ও সত্যের চর্চা। জ্ঞানার্জনের মাধ্যমেই আত্মার পরিচর্চা সম্ভব। কারণ জ্ঞানই পূণ্য।

এরকম সচেতন, মুক্তমনা নাগরিক সবসময় রাষ্ট্রের জন্য একজন বিপজ্জনক ব্যক্তি হিসেবে চিন্থিত হন। সক্রেটিসের ক্ষেত্রেও তাই হয়েছিল। সক্রেটিস শেষপর্যন্ত আদালতে দোষীসাব্যস্থ হয়েছিলেন। তবে তাঁকে যে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হবে একথা সম্ভবত জুরিরা পর্যন্ত ভাবেননি। সক্রেটিসের বিচার ছিল পক্ষপাতদুষ্ট এক করুণ বিচিত্র কাহিনী। ৫০০ জন জুরি সক্রেটিসের বিচার করেছিলেন। এই বিচারকমণ্ডলীর সামনে সক্রেটিস এক দীর্ঘ বক্তৃতা দিয়েছিলেন। তাঁর বিরোধীপক্ষ কী বলেছিল তা জানা যায়নি।

তবে সক্রেটিসের জবানবন্দি লিখে রেখে গিয়েছিলেন তাঁর শিষ্য প্লেটো। এক আশ্চর্য সুন্দর বর্ণনায়, বক্তব্যের গভীরতায় এই রচনা বিশ্ব সাহিত্যের এক অমূল্য সম্পদ হিসেবে সমাদৃত।

প্রথমেই সক্রেটিসের শাস্তি মৃত্যুদণ্ড হয়নি। বিচারের শেষ মুহূর্তে শাস্তি এড়াতে না পারলেও মৃত্যুদণ্ডকে এড়াতে পারতেন সক্রেটিস। তখন এথেন্সের বিচার ব্যবস্থায় অপরাধ চিহ্নিত হবার পর অপরাধীকে জিজ্ঞেস করা হতো, সে কী শাস্তি চায়। ৫০০ বিচারকের উপস্থিতিতে সক্রেটিসকেও জিজ্ঞেস করা হলো, তিনি কী শাস্তি চান। কিন্তু যেহেতু তিনি নিজেকে অপরাধী মনে করতেন না, তাই তার আচরণ ছিলো স্বভাবসুলভ অনমনীয়। তিনি শাস্তির পরিবর্তে পুরস্কারের প্রস্তাব করেন!

উদ্বেগহীন সক্রেটিস প্রস্তাব করলেন যেন প্রাইটেনিয়াম হলে তাঁকে নিয়ে বিশেষ ভোজের আয়োজন করা হয়। প্রথাগতভাবে যা করা হতো গ্রীসের বীরদের জন্য। তাতে বিচারকরা বাক্রুদ্ধ হয়ে ওঠেন, তাঁরা মনে করলেন, সক্রেটিস এই বিচারকে প্রহসন মনে করছেন এবং তাঁদের উপস্থিতির সম্মান দিচ্ছেন না। ফলে উচ্চারিত হল, মৃত্যুদণ্ড।

প্রথমে তাঁর বিরুদ্ধে জুরি ছিলেন ২৮০ জন এবং স্বপক্ষে ছিলেন ২২০ জন। তাঁর ঐ উত্তর শুনে বিরুদ্ধে গেল ৩৩০ জন। ৬০ ভোটের ব্যবধানে সক্রেটিস অপরাধী হিসাবে সাব্যস্ত হয়েছিলেন। তাঁকে মৃত্যুদন্ডের আদেশ দেওয়া হলো। সেই ভয়ঙ্কর রায় শুনে এতটুকু বিচলিত হলেন না সক্রেটিস।

স্থির শান্তভাবে বললেন, I to die, and you to live. Which is better God only knows.অর্থাৎ এখন সময় হয়েছে আমাদের সকলকে চলে যাওয়ার, তবে আমি যাব মৃত্যুর দিকে, তোমরা যাবে জীবনের দিকে। জীবন কিংবা মৃত্যু-একমাত্র ঈশ্বরই বলতে পারেন এর মাঝে শ্রেষ্ঠ কে? বিচারের এক মাস পর তাঁর মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয় হেমলক বিষপানের মাধম্যে!  

মৃত্যুর পূর্বে সক্রেটিসের বলা শেষ বাক্য ছিল তাঁর বন্ধু ক্রিটোকে লক্ষ্য করে, `ক্রিটো, অ্যাসক্লেপিয়াস আমাদের কাছে একটি মোরগ পায়, তার ঋণ পরিশোধ করতে ভুলো না যেন। অ্যাসক্লেপিয়াস হচ্ছে গ্রিকদের আরোগ্য লাভের দেবতা। সক্রেটিসের শেষ কথা থেকে বোঝা যায়, তিনি বুঝাতে চেয়েছিলেন মৃত্যু হল আরোগ্য এবং দেহ থেকে আত্মার মুক্তি।

সক্রেটিসের মৃত্যুর পরেই এথেন্সের মানুষ ক্ষোভে দুঃখে ফেটে পড়ল। চারদিকে ধিক্কার ধ্বনি উঠল। বিচারকদের দল সর্বত্র একঘরে হয়ে পড়ল। অনেকে অনুশোচনায় আত্মহত্যা করলেন। অভিযোগকারীদের মধ্যে মেনেতুসকে পিটিয়ে মারা হলো। অন্যদের দেশ থেকে বিতাড়িত করা হলো। দেশের লোকেরা সক্রেটিসের প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে বিরাট মূর্তি তৈরি করেছিল।

লেখক: কথাসাহিত্যিক ও চলচ্চিত্র নির্মাতা