লাবণী মণ্ডলের কলাম ‘জনগণের নতুন সংস্কৃতি’

প্রকাশিত : জুলাই ১৮, ২০২১

আমাদের দেশের শ্রমিক-কৃষকরা সংস্কৃতি কতটা বুঝবে? সাহিত্য-শিল্প তাদের মনে কতটুকু দাগ কাটতে পারবে? এটা খুব কমন একটি প্রশ্ন। ভাসির্টি পড়ুয়া বেশিভাগ ছেলেমেয়েরা ভাবতেই পারে না, উচ্চতর প্রাতিষ্ঠানিক ডিগ্রি না থাকা শ্রমিক ও কৃষকরা সংস্কৃতি বোঝে, শিল্পও বোঝে। কিছুদিন আগে ঢাবি পড়ুয়া এক আপু বেশ গর্ব করেই বলছিলেন, ‘অশিক্ষিতরা যদি শিল্পী হয়, তবে পাঁচ বছর ধরে ঢাবিতে পড়ে আর কী লাভ, কী দরকার!’ বেশ দম্ভ নিয়ে কথাটা বলছিলেন তিনি। আমি তাকে কোনোভাবেই বুঝাতে সক্ষম হইনি যে, শিল্প, সাহিত্য, সংস্কৃতি উৎপাদন ব্যবস্থার সঙ্গে জড়িত। আদিম যুগে মানুষ যখন সভ্যতা গড়ে তুলছিল, তখন থেকেই মানুষের সামাজিক উৎপাদনের কাজ চলে আসছে। আর এর মধ্য দিয়েই শিল্পের সৃষ্টি। খুব স্পষ্টভাবেই অবলোকন করতে পারি, উৎপাদন ব্যবস্থার সঙ্গে শিল্পেরও বিকাশ ঘটেছে, মৌলিক পরিবর্তনও ঘটেছে, আজও ঘটছে, আগামীতেও ঘটবে। এই সমাজবিকাশের সাথে সাথে শিল্পও বিকশিত হয়েছে, গড়ে উঠেছে বহুমুখী সংস্কৃতি।

শ্রেণিবিভক্ত সমাজে কোনো কিছুই শ্রেণির ঊর্ধ্বে নয়, এ কথাটাকে প্রাধান্য দিয়েই হয়তো ওই আপুটা এত দম্ভ করেছিলেন। কিন্তু তিনি বা তারা একবারও বুঝতে চেষ্টা করবেন না, জানতে চেষ্টা করবেন না—শ্রমজীবী মানুষের শিল্পসৃষ্টিরও একটা দীর্ঘ ইতিহাস রয়েছে। সাঁওতাল জাতিসত্তার শিল্প সৃষ্টি মোটেও উপেক্ষণীয় নয়। তাদের নৃত্য, গীত, বাদ্য—সবই উৎপাদন ও সংগ্রামের সঙ্গে সম্পর্কিত। আর তা সমাজ বাস্তবতা থেকেই এসেছে। ওই শিল্প-সংস্কৃতির রচয়িতারা কিন্তু ঢাবির শিক্ষার্থী ছিলেন না। একাডেমিক শিক্ষা নয়, তাদের উৎপাদনী শিক্ষাটাই গুরুত্ববহ। গ্রামের কৃষক ও অন্যান্য শ্রমজীবী মানুষরা শিল্প সৃষ্টিতে অনেক গুণে এগিয়ে। তারা হয়তো ‘ভদ্রলোকের’ ইতিহাসে স্থান পাবেন না, তাদের কথা হয়তো শিল্পকলায় থাকবে না, চারুকলায় থাকবে না, বড় বড় বইয়েও স্থান পাবে না।

আমাদের একটু গভীরভাবে উপলব্ধি করতে হবে। তা নাহলে যে ইতিহাসের সঙ্গেই বেঈমানি করা হবে! মানুষের ইতিহাস মানেই যে সংগ্রামের ইতিহাস। সে ইতিহাসে আমরা দেখতে পাই, ছৌ, গম্ভীরা, জারি, ভাটিয়ালি, কীর্তন, পালা, লেটো, ভাসান, বাউল, কবিয়াল—শিল্পের এক বিশাল ভাণ্ডার গড়েছেন ওই ‘অশিক্ষিত’ কৃষক, শ্রমিকরাই। কাজেই অত দম্ভ করে নিজের শ্রেণির পরিচয় দিয়ে কৃষক-শ্রমিকের শিল্প সৃষ্টিকে খাটো করে দেখার অবকাশ নেই। এ সমাজের ভদ্রস্থ, সুশীলেরা শিল্পী, লেখক, কবি হয়েছেন বলে কৃষক-শ্রমিকদের মধ্য থেকে আসা কেউ তা পারবে না—এ ধারণাটা ভুল। একেবারেই ভুল। উৎপাদন কর্মে নিযুক্ত সাধারণ মানুষের শিল্পবোধ ও শিল্পরুচি আছে। শিল্পের চাহিদাও তাদের মধ্যে ব্যাপকভাবে আছে। যেখানে মূলধারার বাইরে থাকা শিল্প-সাহিত্যকে জায়গা করে দেয়া ও তার বিকাশে কার্যকর ভূমিকা রাখতে হবে বিশ্ববিদ্যালয়ের উচ্চতর ডিগ্রিধারী গবেষকদের। সমাজের সব চেয়ে নিচের স্তরে থাকা মানুষগুলো— যারা এ সমাজে সংখ্যাগরিষ্ঠ তাদের বাদ দিয়ে শিল্প বিকাশের নাম ভাঙালেও তা কার্যত চাপিয়ে দেয়া সংস্কৃতিকেই ধারণ করে।

বিভিন্ন ক্ষেত্রের শিল্পকর্ম আরও সমৃদ্ধ করার ব্যবস্থা করতে হবে। সে কাজের দায়িত্ব বিশেষভাবে গ্রহণ করতে হবে মার্ক্সীয় মতাদর্শ ধারণকারীদেরই। ব্যাপক জনগণের মধ্যে শ্রমজীবী মানুষের শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতির প্রসার ঘটিয়ে তাদের সাংস্কৃতিক মান উত্তরণ সম্ভব। এর মধ্য দিয়ে সমাজে সাহিত্য, শিল্প, সংস্কৃতির যে বিকাশ ঘটবে, তা এ সমাজে প্রচলিত ভোগবাদী সংস্কৃতির বিপরীত।

ইদানীং অনেক সাহিত্যিক, শিল্পী, নাট্যকার- যারা খানিকটা হলেও গতানুগতিকতার বাইরে চর্চা করছেন—তাদের সাহিত্য, শিল্প, গান, নাটক বেশকিছু মানুষের মধ্যে সাড়া ফেলতে সক্ষম হয়েছে। তারা যে সকলেই মার্ক্সবাদী বিপ্লবী মতাদর্শ ধারণ করেন, এমনটা নয়। এমনটা আশাও করা যায় না, কেননা এই সমাজব্যবস্থাটাই আমলা-মুৎসুদ্দি পুঁজিতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থা। যেখানে বুর্জোয়া গণতান্ত্রিক বিপ্লব সম্পন্ন হয়নি। তাই জাতীয় পুঁজির বিকাশও ঘটেনি। এখানকার কথিত দেশীয় পুঁজি বহুজাতিক কোম্পানির সঙ্গে সংশ্লিষ্ট। এখানে চলমান স্বৈরতান্ত্রিকব্যবস্থার বিপরীতে রয়েছে গণতান্ত্রিক চেতনা। এ অবস্থান থেকেই সমালোচনা রয়েছে স্বৈরতন্ত্রের। তাদেরকে শক্তিশালীভাবে কাজে লাগানোর দায়িত্ব নিতে হবে মার্ক্সবাদীদেরই। স্পষ্ট করে বলতে হবে, যে সৃষ্টি মানুষের কাজে না লাগে, সমাজ পরিবর্তনের কাজে না লাগে, সে সৃষ্টির কোনো মূল্যায়ন হয় না। সমাজ পরিবর্তনে কার্যকর যে কোনো সৃষ্টির পাশে দাঁড়াতে হবে। তরুণদের বোধোদয় জাগানোর দায়িত্বও কাঁধে তুলে নিতে হবে।

আমাদের দেশের বর্তমান প্রতিক্রিয়াশীল সমাজ ব্যবস্থায় যে প্রতিক্রিয়াশীল সাহিত্য, শিল্প ও সংস্কৃতির ব্যাপক প্রভাব রয়েছে তার কার্যকর প্রতিরোধ করতে হলে, সমাজতান্ত্রিক সংস্কৃতির বিপ্লবী চিন্তা দ্বারা প্রভাবিত প্রগতিশীল ও নয়াগণতান্ত্রিক সাহিত্য, শিল্প ও সংস্কৃতির প্রভাবকে অনেক বেশি শক্তিশালী করতে হবে। সে কাজ করতে গেলে শুধু সংস্কৃতি-কর্মের বিষয়বস্তুকে সমাজবাদী ছাঁচে ঢেলে নিলেই চলবে না, শুধু বাস্তব ঘটনার সমাবেশও যথেষ্ট হবে না। শক্তিশালী শিল্পের রূপ দিয়ে বাস্তবতার নিরিখে পরিবেশন করাটা জরুরি।

এই ধরনের সাহিত্য, নাটক, অভিনয়, কাব্য বা অন্যান্য শিল্পকর্ম বর্তমান বুর্জোয়া সমাজ ব্যবস্থার মধ্যেও জনগণের উপর তার সুস্থ ও প্রগতিশীল প্রভাব বিস্তার করতে পারবে, জনগণের মধ্যে প্রকৃত গণতান্ত্রিক চেতনাকে প্রসারিত করতে সাহায্য করবে। তখন সর্বহারাশ্রেণীর মতবাদ হিসাবে সমাজবাদের সমর্থক সাহিত্য, শিল্প, সংস্কৃতির অগ্রগতি আরও দ্রুত হবে। ভবিষ্যৎ নয়াসংস্কৃতির পথ প্রশস্ত হবে।

বিপ্লবকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার ক্ষেত্রে সাংস্কৃতিক বিপ্লবের বিকল্প নেই। সেই সাংস্কৃতিক বিপ্লবকে অগ্রসর করতে হলে সমাজে সংস্কৃতিকর্মীদের অবদানকে কাজে লাগাতে হবে। শ্রেণীদ্বন্দ্বটাকে সামনে এনেই আমাদের কৃষক-শ্রমিকদের মধ্যে নতুন সংস্কৃতির বীজ বপন করতে হবে। একইসঙ্গে বড় বড় ডিগ্রীধারীদের এই সত্যটিকে স্বীকার করতে হবে যে, কৃষক-শ্রমিকদের শিল্পমান কোনো অংশেই কম নয়। বরং উৎপাদনে সরাসরি অংশগ্রহণের কারণেই সে মান অনেক বেশি। এই শিল্পমানকে শান দেওয়ার দায়িত্বও নিতে হবে মার্ক্সবাদীদেরই। দ্বান্দ্বিকভাবে বিশ্লেষণ করার দায়ও নিতে হবে। হ্যাঁ, কৃষক-শ্রমিকদের শিল্পে অনেক সামন্তীয় সংস্কৃতি প্রবেশ করেছে, যে সংস্কৃতির অনেকটা বাস্তবতাও ছিল অতীতে। আর বুঝতে হবে, এ কৃষক-শ্রমিকরা এ সমাজেরই মানুষ, এ সমাজেই বেড়ে ওঠা।

সমাজের সমস্যাগুলো থেকে তারা বিচ্ছিন্ন নয়। তাদের চিন্তাও নিখাদ নয়। তারা দ্বান্দ্বিকভাবে বিশ্লেষণ করে শিল্প-সাহিত্য সৃষ্টি করতে পারেনি, যেমনটা মার্ক্সবাদীরা চিন্তা করতে সক্ষম। বিপ্লবী সংগঠনকে শক্তিশালী করতে হলে, সাংস্কৃতিক বিপ্লবের শিক্ষাকে হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করতে হলে—শ্রেণি দৃষ্টিভঙ্গি স্পষ্ট রাখতে হবে, শ্রেণি সমন্বয় ও গোড়ামিবাদ, দুটোকেই খারিজ করে মার্ক্সবাদের মূল দর্শন দ্বন্দ্ববাদকে আঁকড়ে ধরতে হবে। তবেই আমাদের ব্যাপক জনগণ সকল সামন্তীয়, ভোগবাদী সংস্কৃতি থেকে বের হয়ে মানবিক নয়াসংস্কৃতিতে অগ্রসর হবে।