লাবু সরকারের গল্প ‘পাপ’

প্রকাশিত : মার্চ ১৬, ২০২০

শেখ হাসিনা মেডিকেল হাসপাতালের বেডে শুয়ে কাতরাচ্ছে জব্বার দাদা। গতরাতে হঠাৎ করে তার বুকের বাঁ পাশে ব্যথা শুরু হয়। তার ছেলেমেয়েরা তাকে জোর করে হাসপাতালে নিয়ে এসেছে। তার ইসিজি করিয়ে কোনো সমস্যা পাওয়া যায়নি। বাঁ পাশের ব্যথা তো ভালো নয়। গতকাল যখন ব্যথা শুরু হলো শুধু মিনুকে বললো সে। আলতো চিনচিনে ব্যথা এরকমটা অনুভব হচ্ছিল। তবে বড় কোনো সমস্যা নয়, এটা নিশ্চিত।

জব্বার দাদার ছেলের বউ মিনু বারবার বলছিল, কী এমন দরকার বলুন এত ভাবার। মাকে নিয়ে ভেবে ভেবেই আপনি মরে যেতে চান! যে চলে যায় তাকে নিয়ে ভেবে কি লাভ বলুন?

চলে যাওয়া সবকিছু শুধু মোহ। এ মোহ থেকে নিজেকে সরাতে না পারলে শুধু বুকে কেন সব জায়গায় ব্যথা হবে। জীবনে অনেক কিছু হারাতে শিখতে হয়। না হলে বিপদ। হারিয়ে হারিয়ে যা পাওয়া যায় তাহা হয় নিরাপদ, খাঁটি, বিশ্বস্ত।

প্রচণ্ড ক্ষুধা অনুভব করছে জব্বার দাদা। হাসপাতালের খাবার সে খেতে পারে না। কেমন যেন সব খাবার মিষ্টি মিষ্টি লাগে। নিশ্চয় একজন অসুস্থ মানুষের মিষ্টি খাবার ভালো লাগার কথা নয়। তাছাড়া চতুর্দিকে মেডিসিনের গন্ধে জব্বার দাদার বমি বমি ভাব হয়। বাড়ি থেকে খাবার আনা নিষেধ। হাসপাতালে আসলে বুঝা যায় মানুষ কতটা অসহায়। প্রতিটা অসুস্থ মানুষের মুখ দেখে মনে হয়, নিষ্পাপ, সরল সহজ মানুষ। একমাত্র অসুস্থ মানুষের মধ্যেই ফুটে ওঠে মানুষের সরলতা। তখন মনে হয়, এর জম্ম যেন এইমাত্র হলো। সে দুনিয়ার কিছু এখনো দেখেনি, বুঝেও না। অথচ এই মানুষ সুস্থ অবস্থায় কতকিছুই না করেছে। কতো জনকে ঠকিয়েছে। সৃষ্টিকর্তা সব মানুষকে মৃত্যুর সময় জম্মের রূপ দিয়ে পৃথিবী থেকে নিয়ে যান।

জব্বার দাদার ডান পাশের দেয়ালের পরে অনেক হট্টগোল শোনা যাচ্ছে। অনেক মানুষের গলা একসাথে শোনা যাচ্ছে। হয়তো বড় ধরনের সমস্যাগত কোন রোগী এসেছে। মুখগুলো দেখতে পাওয়া যাচ্ছে না। একজন বলছে, ওই ওর হাত পা বেঁধে রাখ। আরেকজন বলছে, আরে না না, বাঁধা যাবে না। ভালোভাবে বুঝিয়ে বল।

কি বুঝিয়ে বলবো, এর হিতাহিতজ্ঞান থাকলে তো। নেশাগ্রস্থ মানুষকে বুঝিয়ে লাভ আছে নাকি!
তয় কি করবি, ইঞ্জেকশনতো দিতেই হবে।
রশি নিয়ে আয় হাত পা বেধে তারপর সেলাইন দেই।

এমন সব কথাবার্তা শুনে জব্বার দাদার আগ্রহ জাগলো কি হইছে ঘটনাটা জানার। সে আস্তে আস্তে বেড থেকে নেমে এগিয়ে গেল। গিয়ে যা দেখলো এবং বুঝলো তা হলো একটি মধ্যবয়স্ক পুরুষকে কয়েকজন মিলে চেপে ধরে রেখেছে। লোকটির মুখ দিয়ে লালা ঝড়ছে। ঘটনাটি এরকম, এই ব্যক্তিটিকে টাঙ্গাইল বাসস্ট্যান্ডের এক কোনায় পড়ে থাকতে দেখে কিছু মানুষ তাকে জোর করে এখানে নিয়ে এসেছে। অজ্ঞান পার্টি তাকে নেশা খাইয়ে তার সবকিছু নিয়ে গেছে বলে সবার ধারণা। লোকটির পোশাকআশাক দেখে যথেষ্ট গরীব লোক বলেই মনে হচ্ছে। হিতাহিতজ্ঞান না থাকার কারণে সে কিছু চিনতে ও বলতে পারছেনা। নেশাগ্রস্থের মতো শুধু হাত পা নাড়াচ্ছে। কাউকে ধরতে দিচ্ছে না তাকে। কতোটা অসহায় এই মানুষটি। হয়তো যেখানে তার বাড়ি সেখানে তার কতো সম্মান। হয়তো অসহায় কোন পরিবারের সে একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তি।

জব্বার দাদার ব্যাথাটা বাড়ছে আস্তে আস্তে। সে তারাতারি ওখান থেকে চলে আসলো। সারারাত ঘুমাতে পারেনি সে। মাথার মধ্য একটা চিন্তা ঘুরপাক খাচ্ছে। সে বহুবছর আগের কথা। তখন জব্বারের শরীর ভর্তি শক্তি। যৌবনের টগবগে বসন্ত তখন।

গ্রামের শেষ মাথায় থাকতো অবলা বৌদি। যুবতী বয়সে জামাই মারা যাওয়াতে খুব অসহায় হয়ে পরে। আস্তে আস্তে গ্রামের উঠতি বয়সের যুবক ছোকরাদের ভিড় জমতে থাকে। এদের মধ্যে জব্বার ছিল নিয়মিত। বৌদিকে খুশি করার জন্য কখনো বাবার পকেটের টাকা, কখনো মায়ের ট্রাংকের পয়সা, কখনও বা পাড়াপ্রতিবেশির বাড়িতে চুরি করা ছিল নিত্য দিনের।

একদিন বৌদি দাবি করে বসলো তাকে একটা গলার হার গড়িয়ে দিতে হবে। নইলে সে জব্বারকে আর ভালোবাসবে না। তারচেয়ে নাকি নিতাই বেশি খুশি করতে চায় তাকে। সে তাকে মাকড়ি গড়িয়ে দিতেও ইচ্ছুক। জব্বারের শরীর ভর্তি ক্রোধ, রাগান্বিত হয়ে সে ঘর থেকে বের হয়ে গেল। যেভাবেই হোক তাকে টাকা জোগাড় করতেই হবে।

অনেক ভেবেচিন্তে জব্বার সেদিন রাতে তিন মাথার মোড়ে এসে দাঁড়ালো। হাতে একটা মলমের কৌটা। এটা সে হিজলপুরের তার এক বন্ধুর কাছ থেকে সংগ্রহ করেছে। এই তে মাথার রাস্তা দিয়ে কয়েক গাঁয়ের মানুষ যাতায়াত করে। গাঁয়ে ঢুকার একমাত্র রাস্তা এটি। রাত্রি তখন দ্বিপ্রহর হঠাৎ একজন মানুষ বিড়ি টানতে টানতে এ পথের মাথায় নামলো। জব্বার সজাগ হয়ে গেল। সে চোখে দেখতে পেল অবলা বৌদি নিতাইকে নিয়ে বিছানা বালিশ এক করছে। আস্তে আস্তে ঝোপের ভিতর থেকে জব্বার তে মাথায় দাঁড়ালো। লোকটি কাছাকাছি আসতেই পিছন থেকে লোকটির দুচোখে মলম লাগিয়ে দিল। চোখের যন্ত্রণায় লোকটি চিৎকার করে উঠলো। জব্বার লোকটির মুখে গামছা গুজে দিল। তারপর হাত পা বেধে লোকটির সবকিছু নিয়ে নিল। সকালে গাঁয়ের মানুষ মাসুদ মিয়াকে তে মাথার মোড়ে হাত পা বাঁধা অবস্থায় পায়। হাসপাতালে নিলে ডাক্তার মাসুদ মিয়ার দুটি চোখকেই অন্ধ ঘোষণা করলো। চিরতরে মাসুদ মিয়ার জীবনের আলোকবাতি নিবে গেল।

এরপর কতো কতরাত, কতদিন, কতোমাস, কতো বছর পেড়িয়ে গেল। অবলা বৌদির সাথে নিতাই অন্তরজ্ঞ অবস্থায় ধরা পড়াতে অবলা বৌদিকে গ্রামের মানুষ গ্রাম থেকে বের করে দিল। জব্বার বিয়ে করলো, সংসারি হলো, ছেলেমেয়ের জম্ম দিল, তাদের বিয়ে দিল, নানা দাদা হলো। তারও পরে জব্বার শেখ সবার কাছে জব্বার দাদা হলো।

এই নেশাগ্রস্ত লোকটিকে দেখার পর থেকে জব্বারের অতীত স্মৃতি বড্ড পিঢ়া দিতে লাগলো। পাপ বুঝি এমনই, নতুন পাপ পুরনো পাপকে জাগ্রত করে। মানুষের এমন কোন পাপ করা উচিত নয় যে পাপ একশত বছর পরেও জেগে উঠে, ভাবিয়ে তুলে। আসলে মানুষের পাপ`ই করা উচিত নয়। কারণ পাপ মানুষের অনেক ভালো দিক বন্ধ করে দেয়। যা থেকে মানুষ চাইলেও মুক্তি পায়না তেমনটা মানুষ কেন করে।

জব্বার দাদার চারিপাশে কতো আত্বীয় স্বজন ভিড় করছে। কতো আদর সমাদর। সামান্য অসুখ নিয়ে হাসপাতালে এলেও নিজেকে মনে হচ্ছে সবচেয়ে ভয়ংকর রোগী, বড় অসহায়। পৃথিবীতে পাপের চেয়ে বড় কোন অসুখ নেই এটা আজ হাড়েহাড়ে বুজতে পারছে জব্বার দাদা। সে কিছুতেই শান্তি পাচ্ছে না। পুরনো পাপ তাকে শান্তি দিচ্ছে না। বারবার মনে হচ্ছে, এমন কোনো কিছু যা করে পাপটা থেকে মুক্তি পাওয়া যেতো। পাপ ও অভিশাপ থেকে মুক্তি পাওয়ার মতো শান্তি শুধু এ পৃথিবীতে কেন বোধহয় কোন পৃথিবীতেই তৈরি হয়নি।

জব্বার শেখ তার ছেলে-মেয়ে নাতি-নাতনি সবাইকে ডেকে বললো, ‘আমি এ বছর হজ্বে যাবো না।‘ লোকটিকে দেখিয়ে বলল, আমার হজ্বের সমস্ত টাকা তার চিকিৎসা এবং তার পরিবারের জন্য ব্যয় করবো। এমনকি আমার সম্পত্তির অর্ধেক তার ছেলেমেয়েদের দান করবো।

ছেলেমেয়েরা হতবিহ্বল হলেও জব্বার দাদার কথা অমান্য করার সাহস কারো নেই। আজ থেকে অনেক বছর আগে এরকম একটি মানুষের জীবনের সমস্ত আলো সে কেড়ে নিয়েছিল। আজ সে তার পাপের পায়শ্চিত্য করতে চায়।

সপ্তাহখানেক পরে নেশায় আক্রান্ত ব্যক্তিটি পুরোপুরি সুস্থ হয়ে তার কাছে এলো। লোকটি ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে রইলো জব্বার দাদার দিকে। কোন কথাই লোকটি বলতে পারছে না। শুধু দুজন দুজনকে চেয়েচেয়ে দেখছে। দুজনের চোখ`ই আত্মসমর্পণের চোখ। একজনের কৃতজ্ঞতার আরেকজনের পাপমুক্তির। জব্বার দাদা অপলক চেয়ে রইলো লোকটির দিকে। তার মনে হতে লাগলো, এই লোকটিই বুঝি সেদিনের সেই লোক। যার সর্বস্ব সে কেড়ে নিয়ে ছিল। আজ লোকটির সবকিছু ফিরিয়ে দিতে পেরে নিজেকে দায়মুক্ত মনে হলো, পাপমুক্ত মনে হলো। মনে হতে  লাগলো শত বছরের অভিশাপ থেকে সে মুক্ত হতে যাচ্ছে। প্রশান্তিতে ভরে এলো মন।
পাপমোচন হলো।
শাপমোচন হলো।