শঙ্খচিলের প্রবন্ধ ‘গণতান্ত্রিক কেন্দ্রিকতার প্রত্যয়’

প্রকাশিত : সেপ্টেম্বর ১৮, ২০২২

বেশিরভাগ সময় আমরা কোনো বিষয়কে আংশিকভাবে দেখি আর ভুল অবস্থান নেই। অনেকটা চোরের ওপর রাগ করে মাটিতে ভাত খাওয়ার মতো। রাজনৈতিক ক্ষেত্রেও ওই কারণে সমাধানের বদলে সমস্যাকে আরও বেশি পাকিয়ে ফেলি। কেন এমন হয়? কার্যকারণ সম্পর্ককে ঠিকভাবে না বুঝে তার মধ্যের দ্বন্দ্বকে এড়িয়ে গেলেই এমন ভুল হয়। আমরা সাধারণত যা দেখি তা ঘটনার পুরোটা নয়। তার পুরোটা হলো তার কারণ ও ফলাফলের অব্যাহত ধারা। আমাদের চারপাশে দ্বন্দ্ব বিশেষে কারণ ফলাফলে আবার ফলাফল কারণে বদলে যাওয়ার এক মজার খেলা চলে। আমাদের সীমাবদ্ধ বোঝাপরার বাইরেই বেশিরভাগ বস্তুজগৎ প্রবাহমান। তাই সম্পূর্ণ সত্যিকে বুঝতে হয় গতির ধারায়। কার্য-কারণ ও তার ফলাফলের দ্বান্দ্বিক আন্তর্সম্পর্কের নিরীখে। এটা ভুলে গেলেই যে বিচ্যুতিটা হয় তা আমাদের রাজনীতি অর্থাৎ কমিউনিস্ট পার্টির একটা গুরুত্বপূর্ণ মৌলিক নীতিকে সহজেই আঘাত করে। আর তাহলো কমিউনিস্ট পার্টির গণতান্ত্রিক কেন্দ্রিকতার সাধারণ সাংগঠনিক লাইন।

গণতান্ত্রিক কেন্দ্রিকতার মানে হলো, আলাপ আলোচনার মাধ্যমে সিদ্ধান্তগ্রহণ প্রক্রিয়ায় গণতন্ত্র এবং সিদ্ধান্ত প্রয়োগের ক্ষেত্রে কিংবা কাজের ক্ষেত্রে কেন্দ্রিকতা। মাও সে তুং পার্টি প্রশ্নে সুনির্দিষ্টভাবে বলেছেন, যদি বিপ্লব করতে হয় তাহলে অবশ্যই একটা বিপ্লবী পার্টি থাকতে হবে। মার্কসবাদী-লেনিনবাদী তত্ত্বে এবং বিপ্লবী রীতিতে গড়ে ওঠা বিপ্লবী পার্টি ছাড়া শ্রমিকশ্রেণি ও ব্যাপক জনসাধারণের পক্ষে সাম্রাজ্যবাদ ও তার পদলেহী কুকুরদের পরাজিত করা অসম্ভব। জনগণের ভিতরে স্বাধীনতা ছাড়া চলে না, শৃঙ্খলা ছাড়াও চলে না; গণতন্ত্র ছাড়া চলে না, কেন্দ্রিকতা ছাড়াও চলে না। এই ধরনের গণতন্ত্র ও কেন্দ্রিকতার একত্ব এবং স্বাধীনতা ও শৃঙ্খলার একত্বের অর্থ হচ্ছে, গণতান্ত্রিক কেন্দ্রিকতা, যা বিপরীতের সংগ্রামের মাধ্যমে বস্তুর বিকাশের নিয়ম হিসেবে মার্কসবাদী দ্বন্দ্বমূলক বস্তুবাদী দৃষ্টিভঙ্গির চমৎকার প্রয়োগ। মার্কসবাদী চর্চার সর্বত্রই আমরা এই মূলনীতির সফল প্রয়োগ দেখতে পাই। গণতান্ত্রিক কেন্দ্রিককতার গঠন হলো:

১. নীতি নির্ধারক সাধারণ সম্মেলন বা কংগ্রেস সর্বোচ্চ সংস্থা।
২. দুটি কংগ্রেসের মধ্যবর্তী পর্যায়ে সমগ্র পার্টি কেন্দ্রীয় কমিটির অধীন।
৩. নিম্ন কমিটি উচ্চ কমিটির অধীন।
৪. সংখ্যালঘু সংখ্যাগুরুর অধীন।
৫. ব্যক্তি সংগঠনের অধীন।

সুতরাং, মার্কসবাদী-লেনিনবাদী তত্ত্বে এবং বিপ্লবী রীতিতে গড়ে ওঠা বিপ্লবী পার্টির তাৎপর্য বোঝাই হলো একজন মার্কসবাদী লেনিনবাদী ও মাওবাদী বিপ্লবীর মানদণ্ড। কি এই মার্কসবাদী লেনিনবাদী তত্ত্ব ও বিপ্লবী রীতি যা মাওবাদী হয়ে ওঠার মানদণ্ড? মার্কসবাদ হলো সমাজ বিজ্ঞান, যা মানব সমাজ বিকাশের নিয়মগুলো আবিষ্কার করেছে এবং বর্তমান বিশ্বব্যবস্থার আর্থ-সামাজিক সত্যগুলোকে প্রকাশ করে দিয়েছে এবং তারই ধারায় সমাজের অনিবার্য ভবিষ্যৎ পরিণতির পথ ও পদ্ধতির বৈজ্ঞানিক উপায় বাতলে দিয়েছে। এর কীর্তি সম্পর্কে মার্কস বলেন, আমার কথা যদি ধরি, বর্তমান সমাজে শ্রেণির অস্তিত্ব ও তার সংগ্রাম আবিষ্কারের কৃতিত্ব আমার নয়। আমার অনেক আগেই বুর্জোয়া ঐতিহাসিকেরা শ্রেণি-সংগ্রামের ঐতিহাসিক বিকাশ এবং বুর্জোয়া অর্থনীতিকেরা শ্রেণির অর্থনৈতিক অঙ্গ-সংস্থান বর্ণনা করেছেন। আমি নতুন যা করেছি, সেটা শুধু এই প্রমাণ করা যে: ১. শ্রেণির অস্তিত্ব উৎপাদন বিকাশের নির্দিষ্ট এক-একটা পর্যায়ের সঙ্গে জড়িত। ২. শ্রেণি সংগ্রামের অনিবার্য পরিণতি প্রলেতারীয় একনায়কত্ব। ৩. এই একনায়কত্ব সমস্ত শ্রেণির বিলোপ ও শ্রেণিহীন সমাজে উত্তরণের পর্যায় মাত্র।

সুতরাং মার্কসবাদ কি?
দেখা যাচ্ছে, মার্কস বলছেন শ্রেণি ও শ্রেণি সংগ্রামের কথা তিনি নয় বরং বুর্জোয়ারাই স্বীকার করেছে। তাই শ্রেণি বৈষম্য বা শ্রেণি সংগ্রামর কথা মার্কসবাদ নয়, তা বুর্জোয়াদেরই মতবাদ। মার্কসবাদ হলো সেই শ্রেণি ও শ্রেণি বৈষম্যের কারণটিকে আবিষ্কার করা ও তার ফল হিসেবে বর্তমান পুঁজিবাদী ব্যবস্থা থেকে সাম্যবাদী ব্যবস্থায় উত্তরণে শ্রেণি সংগ্রামের হাতিয়ার হিসেবে সর্বহারা একনায়কত্বের অপরিহার্য বৈজ্ঞানিক পথ ও পদ্ধতির সার সুত্রায়ণ করা। সূত্রগুলো হচ্ছে:

১. যেহেতু কিছু মানুষ উৎপাদনের উপকরণগুলোর মালিক আর অন্যরা তা থেকে বঞ্চিত, তাই একেকটি যুগের আলাদা আলাদা উৎপাদন ব্যবস্থা অনুযায়ী সেই মালিক ও বঞ্চিতদের মধ্যে একেকটি আলাদা উৎপাদন সম্পর্কের মাধ্যমে সমাজের উৎপাদন ব্যবস্থা এগিয়ে চলে। একে বলে উৎপাদন সম্পর্ক। যা যে কোনো ব্যবস্থায় শুরুর দিকে সমাজ বিকাশের সহায়ক বা প্রগতিশিল থাকে। আর উৎপাদক, উৎপাদনের উপকরণ ও উৎপাদিত বস্তুর সবটা নিয়ে গড়ে ওঠে উৎপাদিকা শক্তি। কিন্তু যে কোনো ব্যবস্থাতেই একটা সময় পর চলমান উৎপাদিকা শক্তির বিকাশের সঙ্গে অন্য উৎপাদন সম্পর্ক অসঙ্গতিপূর্ণ হয়ে পরে। সেই অবস্থায় চালু উৎপাদন সম্পর্কের সীমাবদ্ধ কাঠামো বিকশিত উৎপাদিকা শক্তিকে নিজের আয়ত্বে ধরে রাখতে পারে না। তখন সমাজে দেখা দেয় বিশৃঙ্খলা। আর তা থেকে বাঁচার জন্য দরকার হয় বিকশিত উৎপাদন শক্তির সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ উৎপাদন সম্পর্ক ও তার অনুকূলে প্রয়োজনিয় নতুন আরেকটি ব্যবস্থার দিকে এগিয়ে যাওয়ার উল্লম্ফন।

এই হলো আরেক দুটি বিপরীত শ্রেণি স্বার্থের সংগ্রামের ফলে মানব সমাজ বিকাশের ঐতিহাসিক ধারা। অনেকটা প্রসূতি মায়ের প্রসবন্মুখ শিশুর জম্মের মতো। কিন্তু পুরোনো উৎপাদন সম্পর্কের শোষণমূলক শ্রেণি স্বার্থ বিকশিত উৎপাদিকা শক্তিকে দরকার মতো নতুন উৎপাদন সম্পর্কের জন্য স্বেচ্ছায় রাস্তা ছেড়ে দেয়না। তখন তাদের মধ্যে অনিবার্য সংঘাতই হলো সমাজ বিকাশ ও ব্যবস্থার এক পর্যায় থেকে আরেক পর্যায়ে উত্তরণের চালিকাশক্তি। যেমন প্রসবন্মূখ সন্তানের জম্মের জন্য প্রয়জন হয় অভিজ্ঞ ধাত্রীর হস্তক্ষেপ, তেমনই সমাজ বিকাশের ঐ বিশেষ মুহূর্তের সঠিক মীমাংসার জন্য দরকার হয় সচেতন সাংগঠনিক হাতিয়ারের সবল হস্তক্ষেপ। আমাদের যুগে যা বিপ্লবী কমিউনিস্ট পার্টি হিসেবে ঐতিহাসিক অনিবার্যতা অর্জন করেছে।

২. শ্রেণি সংগ্রামের ওই নিয়মে যখন উৎপাদিকা শক্তির বিকাশ নতুন উৎপাদন সম্পর্কের দাবি করে তখন ওই নতুন সম্পর্কের উপযোগী হিসেবে যে শ্রেণিটি উঠে আসে, তাকে তার শ্রেণি স্বার্থের অনুকূলে নতুন উৎপাদন সম্পর্কের জন্য সমাজকে তৈরি করতে এবং পুরোনো ব্যবস্থার আবর্জনা ঝেটিয়ে বিদায় করতে যাবতীয় কাঠামো পুনঃনির্মানে তার নিজস্ব শ্রেণি একনায়কত্ব অর্জন করতে হয়। যা এযাবৎকাল এক শোষণমূলক ব্যবস্থার বদলে আরের শোষণমূলক ব্যবস্থায় রূপান্তর মাত্র। অন্তর্বস্তুতে যা অভিন্ন। কিন্তু কালপুরুষের অসীম রসিকতায় আমরা আমাদের যুগে এক গুণগত মোড় পরিবর্তণের দোড়গোড়ায় এসে দাঁড়িয়েছি। বর্তমান পুঁজিবাদী ব্যবস্থা তার নিজের তাগিদেই লাগামহীন মুনাফা ও পুঁজি তথা উৎপাদনের উপকরণের ক্রম ঘণীভবণের তারনায় উৎপাদন ব্যবস্থার যথাসম্ভব সামাজিকিকরণ করতে বাধ্য হয়। যার ফলে হলো সামাজিক দারিদ্রতা ও ব্যপক জনগণকে ক্রম সর্বহারা নিস্ব শ্রমিকে পরিণত করে চলার এক চমৎকার ঐতিহাসিক রসিকতা।

ক্রমবর্ধমান শ্রেণি হিসেবে যে শ্রমিক শ্রেণির মজুরি দাসত্ব ছাড়া বেঁচে থাকার জন্য হাতে থাকে সপরিবারে না খেয়ে মরা বা আত্মহত্যার গণতান্ত্রিক অধিকার। সুতরাং এই শ্রেণিটি কি তার এই দুর্দশাগ্রস্ত শ্রেণি অস্তিত্ব বজায় রাখা বা বিস্তারের কথা ভাবতে পারে? অবশ্যই তা পারেনা। বরং তার এই অবস্থা থেকে মুক্তির জন্য তাকে সীমাহীন বিকশিত উৎপাদিকা শক্তির ন্যায্য ব্যবহারের লক্ষ্যে এগোতেই হয়। যে লক্ষ্য পূরণের জন্য শ্রমিক শ্রেণিকে শুধুমাত্র নতুন উৎপাদন সম্পর্ক তৈরি করা ও পুরোনো পুঁজিবাদী উৎপাদন সম্পর্কের বাঁধা সাফ করার ক্ষুদ্র স্বার্থের বদলে অনেক বড় ও মহৎ উদ্দেশ্যে কাজ করতে হয়। আর তা শ্রমিক শ্রেণি তৈরির কারখানা এই পুঁজিবাদী ব্যবস্থাসহ যাবতীয় শোষণমূলক ব্যবস্থার বদলে সাম্যবাদী ব্যবস্থার প্রতিস্থাপন ছাড়া সম্ভব নয়। অতয়েব মানব সমাজের ক্রমবিকাশের ধারায় এযাবৎ সর্বৎকৃষ্ট বিপ্লবী কর্তব্যের কারিগর হিসেবে বিপ্লবী শ্রমিক শ্রেণিকে রঙ্গমঞ্চে হাজির করেছে এ যুগের ইতিহাস। তাই শ্রমিক শ্রেণি তার এই মহান কর্তব্য ও উদ্দেশ্য পূরণের ঐতিহাসিক দায়িত্ব অবহেলা করতে পারেনা। আর অবশ্যই সম্পূর্ণ সাম্য ব্যবস্থা অর্জিত না হওয়া পর্যন্ত তাই সে তার শ্রেণি একনায়কত্ব প্রয়োগ করবে। যা প্রলেতারিয় একনায়কত্ব হিসেবে মার্কসবাদের মূল কথা। যাকে লেনিন মার্কসবাদের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত বলে বর্ণনা করেছেন। যা অনেকটা মাতৃগর্ভ থেকে খোলা প্রকৃতিতে সদ্যজাতর মানিয়ে নেওয়া পর্যন্ত ধাত্রী মায়ের পরিচর্যার মতন আরকি।

৩) তৃতীয় আবিষ্কার:- শ্রমিক শ্রেণীর একনায়কত্ব কোনো নতুন ব্যবস্থা নয়। তা হলো দুটি পরস্পর বিরোধী ভিন্ন গুনগত একটা পুরোনো ব্যবস্থা থেকে আরেকটা নতুন ব্যবস্থায় যাওয়ার মধ্যবর্তি পর্যায়। যার গুরুত্ব অপরিসীম। কারণ আগের যে কোনো যুগের এক শোষণ ব্যবস্থা থেকে আরেক শোষণ ব্যবস্থায় যেতে শ্রেণি শোষণের ভিত্তি একই থাকত। শুধু এক শোষক থেকে আরেক শোষকের হাত বদল ঘটত। কিন্তু এই প্রথম শোষণ মূলক শ্রেণি সমাজ থেকে শ্রেণিহীন সাম্যবাদী সমাজে যাওয়ার উপায় হিসেবে দরকার হয় হাজার হাজার বছরের শোষণমূলক, বৈষম্যমূলক শিক্ষা সংস্কৃতি, আচার, আচরণ সহ তার সহায়ক সমস্ত জঞ্জাল ও কাঠামোর আমূল উচ্ছেদ সাধন ও তার জাগায় নতুন সাম্যবাদী ব্যবস্থার উপযোগিতা নির্মাণের এক দীর্ঘ সময় ব্যপি উত্তরণ কালের। সেই উত্তরণ কালই হলো এই সর্বহারার একনায়কত্বের পর্যায়। মজার ব্যপার মাতৃ গর্ভ থেকে প্রকৃতিতে ভুমিষ্ঠ শিশুর এক অবস্থা থেকে আরেক অবস্থায় মানিয়ে নেওয়ার সেই যেন আতুরকালিন সময় এই একনায়কত্বের পর্যায়। লেনিন বলেছেন `যাকে অস্বীকার করার অর্থ মার্কসবাদকে অস্বীকার করা।`
এই হলো সংক্ষেপে মার্কসবাদ।

কেন মানব সভ্যতার ক্রমবিকাশে শ্রমিক শ্রেণীর আবির্ভাব ও তার ঐতিহাসিক কাজ অন্য সকল যুগের তুলনায় সবিশেষ গুরুত্বপূর্ণ? কারণ মার্কসবাদ বলে আগের সমস্ত ব্যবস্থাগুলোর মোট সামাজিক প্রয়োজনের থেকে আয়োজন কম ছিল। এক ব্যবস্থা থেকে আরেক ব্যবস্থায় উত্তরণ ছিল সেই প্রয়োজন থেকে আয়োজনের ব্যবধানকে জয় করার পথে যাত্রা। পুঁজিবাদী ব্যবস্থাতেই প্রথম সেই ব্যবধানের দৈন্যদশা কাটিয়ে সামাজিক উদ্বৃত্ত তৈরি হয়। কিন্তু পুঁজিবাদী নিয়মে সেই উদ্বৃত্ত পুঁজি হিসেবে পুণর্উৎপাদনে যুক্ত হয়ে চক্রবৃদ্ধিহারে ক্রম ঘণীভূত উদ্বৃত্ত তথা পুঁজির স্তূপাকার পুঁজিবাদকে বাধ্য করেছে সবদিক দিয়ে উৎপাদন উপায়ের মালিকানাকে ক্রম ব্যক্তিকরণ অথচ উৎপাদন ব্যবস্থাকে যথা সম্ভব সামাজিকিকরণ করতে। যা মানুষের প্রয়োজন ও চাহিদার সমস্ত সীমানা অতিক্রম করে সম্পদ ও প্রাচুর্যের এমন শ্রীবৃদ্ধি ঘটিয়েছে যা আগের কোনো যুগের কল্পনারও অতীত। অথচ ব্যক্তি মালিকানার ফলে সেই সম্পদ থেকে অধিকাংশ মানুষই বঞ্চিত। মোট সামাজিক প্রয়োজনের থেকে প্রাপ্তি বেশি হলেও সামাজিক খিদে ও হাহাকার পুঁজিবাদী সমাজের এক দুর্ভাগ্যজনক অন্তর্দ্বন্দ্ব।

এই অন্তর্দ্বন্দ্ব শোষণ ব্যবস্থাকে আগের সমস্ত নৈতিকতা থেকে মুক্ত করে একেবারেই আর্থিক নগদ মূল্যের স্তরে নামিয়ে এনেছে। এই অবস্থায় শোষিত মানুষের পিছু হটতে হটতে দাসত্ব, ভূমি দাসত্ব হয়ে মজুরি দাসত্বের শেষ সীমায় এসে ঠেকেছে। উৎপাদনের উপকরণ থেকে বঞ্চিত এই মানুষদের শ্রমক্ষমতা বিক্রি করা ছাড়া বেঁচে থাকার আর কোনো রাস্তা নেই। হয় তারা বাধ্যতামূলক পুঁজিপতিদের মজুরি দাসত্ব স্বীকার করবে অথবা না খেয়ে মরবে। তার দায় পুঁজিবাদের নয়। আগের ব্যবস্থাগুলোয় অলাভজনক শোষিতদের হত্যার দায় নিতে হতো শোষকদের। পুঁজিবাদ সে দায়কে ব্যক্তিগত স্বাধীনতা নামে আত্মহত্যার স্তরে নামিয়ে এনেছে। যা তথাকথিত গণতন্ত্রের বহুল ব্যবহৃত ও সহজাত পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া। এটা করতে গিয়ে তাকে মানুষের দ্বারা মানুষের শোষণের সর্বোৎকৃষ্ট উপায়কে রূপ দিতে হয়েছে। তাকে সৃষ্টি করতে হয়েছে সর্বহারা শ্রমিক শ্রেণির মতো ঐতিহাসিক বিপ্লবী শ্রেণিকে।