শামসুর রাহমানের পাঁচটি কবিতা

প্রকাশিত : অক্টোবর ২৩, ২০২০

বাংলাদেশের প্রধান কবি শামসুর রাহমানের আজ ৯১তম জন্মদিন। ১৯২৯ সালের ২৩ অক্টোবর বুধবার পুরান ঢাকার মাহুতটুলির ৪৬ নম্বর বাড়িতে তিনি জন্মগ্রহণ করেন। ২০০৬ সালের ১৭ আগস্ট তিনি দেহ ত্যাগ করেন। কবির জন্মদিনে ছাড়পত্রের পক্ষ থেকে শ্রদ্ধার্ঘ্য হিসেবে তার পাঁচটি কবিতা পুনর্মুদ্রণ করা হলো:

অভিশাপ দিচ্ছি

আজ এখানে দাঁড়িয়ে এই রক্ত গোধূলিতে
অভিশাপ দিচ্ছি।
আমাদের বুকের ভেতর যারা ভয়ানক কৃষ্ণপক্ষ
দিয়েছিল সেঁটে,
মগজের কোষে কোষে যারা
পুতেছিল আমাদেরই আপনজনের লাশ
দগ্ধ, রক্তাপ্লুত,
যারা গণহত্যা
করেছে শহরে গ্রামে টিলায় নদীতে ক্ষেত ও খামারে
আমি অভিশাপ দিচ্ছি নেকড়ের চেয়েও অধিক
পশু সেই সব পশুদের।
ফায়ারিং স্কোয়াডে ওদের
সারিবদ্ধ দাঁড়
করিয়ে নিমিষে ঝা ঝা বুলেটের বৃষ্টি
ঝরালেই সব চুকেবুকে যাবে, তা আমি মানি না।
হত্যাকে উৎসব ভেবে যারা পার্কে মাঠে
ক্যাম্পাসে বাজারে
বিষাক্ত গ্যাসের মতো মৃত্যুর বীভৎস গন্ধ দিয়েছে ছড়িয়ে,
আমি তো তাদের জন্য অমন সহজ মৃত্যু করি না কামনা।
আমাকে করেছে বাধ্য যারা
আমার জনক জননীর রক্তে পা ডুবিয়ে দ্রুত
সিঁড়ি ভেঙে যেতে আসতে
নদীতে আর বনবাদাড়ে শয্যা পেতে নিতে
অভিশাপ দিচ্ছি আজ সেইখানে দজ্জালদের।

সুধাংশু যাবে না

পাগলামি করিসনে বন্ধু সুধাংশু
সময় যে পার হয়ে যাচ্ছে
এবার যে তোর পালানোর বেলা
জিদ করিসনে বন্ধু, এখনই তুই পালা।
জানি তুই কী ভাবছিস বন্ধু সুধাংশু
দাঁড়িয়ে হাহাকারের ছোঁয়ায় জড়ানো শ্মশানসম বাস্তুভিটায়
সেই হারিয়ে যাওয়া প্রাণচঞ্চল দিনগুলো, আমাদের ছেলেবেলা
কিন্তু এবার যে তোর পালানোর বেলা, এবার তুই পালা।
আমি জানি নির্বাক দাঁড়িয়ে তুই কী ভাবছিস বন্ধু সুধাংশু
সেই একপাল বন্ধুগুলো— রামী, শেপু, কাকলী আরও অনেকে
প্রাণময় কোলাহলে কাটিয়েছি সকাল-দুপুর-সন্ধ্যা বেলা
কিন্তু এবার যে তোকে পালাতে হবে, এবার তুই পালা।
আমি বুঝি তোর শঙ্কা আগামী বিরহ বেদনার বন্ধু সুধাংশু
আড়াই যুগ ধরে তিলে তিলে গড়ে উঠা আত্মার সম্পর্ক—
এই বাস্তুভিটার সাথে আর একঝাঁক বন্ধুর ভালবাসা প্রাণঢালা।
কিন্তু এবার যে তোকে পালাতে হবে, এবার তুই পালা।
কোথায় সেই কলকাকলিতে মুখরিত সবুজ সুন্দর কাপালি-ভিটাটি বন্ধু সুধাংশু
দুটি জীর্ণ-শীর্ণ ঘর চির-দুঃখীর মতো দাঁড়িয়ে আছে আজ সেই কাপালি ভিটায়।
কোথায় সেই রামী, শেপু, কাকলি আরও সেই প্রিয় বন্ধুগুলা
ওরা যে সবাই পালিয়েছে, এবার তোর পালা।
তুই কি জানিস বন্ধু সুধাংশু
তোর বিদায়ে ভীষণ ব্যথা পাবে আমার ওিই ছ’বছরের অবুঝ বোনটি ‘নেহা’
কাটাবে কত সন্ধ্যা অধীর প্রত্যাশায়, সুধাংশু ভাইকে জড়িয়ে ধরবে, কোথায় চকলেটগুলা?
তবুও তোকে পালাতে হবে যে, এবার তুই পালা।
আরও জানি বন্ধু সুধাংশু
তোর ষোড়শী বোনটি ‘মিলা’ দুষ্টামির ছলে আর বলতে পারবে না, আলমদা তুমি এত কৃপণ কেন?
চলো মেলায় নিয়ে, কিনে দিতে হবে সুন্দর একটি মালা।
তথাপি তোকে পালাতে যে হবে, এবার তুই পালা।
তোকে যে বলা হয়নি বন্ধু সুধাংশু
মিলার সহপাঠী আমার ভাইটি রিপন বলছিল সেদিন, ভাইয়া মিল’টা যা সুন্দর হয়েছে না!
বলে দিয়েছি ওকে, সুন্দরী মেধাবী মিলা বিশ্ব জয় করবে, তোর মতো গর্দভটি ওর দিকে তাকাবে না।
তোর হাতে যে সময় নেই বন্ধু, এবার তুই পালা।
মিলাকে যে বিশ্ব জয় করতেই হবে বন্ধু সুধাংশু
অসাধারণ সুন্দরী মেধাবী মিলার জন্য এক ধর্ষিত, অচ্ছুৎ, অভাগী নারীর জীবন—
হবে মানবতার জন্য এক অমার্জনীয় ব্যর্থতা।
তাই আমার কাতর মিনতি বন্ধু, এখনই তুই পালা।

তুমি বলেছিলে

দাউদাউ পুড়ে যাচ্ছে নতুন বাজার।
পুড়ছে দোকানপাট, কাঠ,
লোহা-লক্কড়ের স্তূপ, মসজিদ এবং মন্দির।
দাউদাউ পুড়ে যাচ্ছে নতুন বাজার।

বিষম পুড়ছে চতুর্দিকে ঘরবাড়ি।
পুড়ছে টিয়ের খাঁচা, রবীন্দ্র রচনাবলি, মিষ্টান্ন ভাণ্ডার,
মানচিত্র, পুরনো দলিল।
মৌচাকে আগুন দিলে যেমন সশব্দে
সাধের আশ্রয় ত্যাগী হয়
মৌমাছির ঝাঁক,
তেমনি সবাই
পালাচ্ছে শহর ছেড়ে দিগ্বিদিক। নবজাতককে
বুকে নিয়ে উদ্ভ্রান্ত জননী
বনপোড়া হরিণীর মতো যাচ্ছে ছুটে।
অদূরে গুলির শব্দ, রাস্তা চষে জঙ্গি জীপ। আর্ত
শব্দ সবখানে। আমাদের দুজনের
মুখে খরতাপ। আলিঙ্গনে থরো থরো
তুমি বলেছিলে,
‌`আমাকে বাঁচাও এই বর্বর আগুন থেকে, আমাকে বাঁচাও,
আমাকে লুকিয়ে ফেলো চোখের পাতায়
বুকের অতলে কিংবা একান্ত পাঁজরে
আমাকে নিমেষে শুষে নাও
চুম্বনে চুম্বনে।`

দাউদাউ পুড়ে যাচ্ছে নতুন বাজার,
আমাদের চৌদিকে আগুন,
গুলির ইস্পাতি শিলাবৃষ্টি অবিরাম।
তুমি বলেছিলে,
আমাকে বাঁচাও।
অসহায় আমি তাও বলতে পারিনি।

আকাশে অনেক মুখ

এ কেমন সন্ধ্যা ঘিরে ধরেছে আমার
প্রিয় এই শহরকে আজ। চতুর্দিকে
গুঁড়িয়ে পড়ছে ঘরবাড়ি। নরনারী, শিশুদের
বুকফাটা কান্নায় কাঁপছে পথঘাট, গাছপালা।

এই তো নিজেকে আমি ইট, পাথরের
স্তূপ থেকে আহত শরীর তুলে দেখি আশেপাশে,
সবদিকে অগণিত লাশ, কোনও কোনও
স্থানে ভাঙা পুতুল-জড়ানো হাতে নিষ্প্রাণ বালিকা।

আমাদের ছোট ঘরবাড়ি খুঁজে খুঁজে
আখেরে অধিকতর ক্লান্ত শরীরে অজানা
জায়গায় ভগ্নস্তূপে বসে পড়ি। হঠাৎ সমুখে
একটি ধূসর খাতা দেখে দ্রুত হাতে তুলে দিই।

আবিষ্কৃত খাতার প্রথম দুটি পাতা
গায়েব হলেও অবশিষ্ট বেশ কটি পাতা জুড়ে
রয়েছে কবিতা, সত্যি বলতে কী, কতিপয় পদ্য
পড়তেই উদ্ভাসিত প্রকৃত কবির পরিচয়।

কখন যে রাত ওর কোমল শরীর
নিয়ে সারা শহরে ছড়িয়ে পড়ে, অদূরে গাছের
পাতাময় ডাল থেকে পাখির নিঝুম গান ঝরে
জ্যোৎস্নার ধরনে। ভেসে ওঠে আকাশে অনেক মুখ।

বারবার ফিরে আসে

বার বার ফিরে আসে রক্তাপ্লুত শার্ট
ময়দানে ফিরে আসে, ব্যাপক নিসর্গে ফিরে আসে,
ফিরে আসে থমথমে শহরের প্রকাণ্ড চোয়ালে।
হাওয়ায় হাওয়ায় ওড়ে, ঘোরে হাতে হাতে,
মিছিলে পতাকা হয় বারবার রক্তাপ্লুত শার্ট।
বিষম দামাল দিনগুলি ফিরে আসে বারবার,
বারবার কল্লোলিত আমাদের শহর ও গ্রাম।

‘আবার আসবো ফিরে’ বলে সজীব কিশোর
শার্টের আস্তিন দ্রুত গোটাতে গোটাতে
শ্লোগানের নিভাঁজ উল্লাসে
বারবার মিশে যায় নতুন মিছিলে, ফেরে না যে আর।
একটি মায়ের চোখ থেকে
করুণ প্লাবন মুছে যেতে না যেতেই
আরেক মায়ের চোখ শ্রাবণের অঝোরে আকাশ হ’য়ে যায়।
একটি বধূর
সংসার উজাড়-করা হাহাকার থামতে না থামতেই, হায়,
আরেক বধূর বুক খাঁ-খাঁ গোরস্থান হ’য়ে যায়,
একটি পিতার হাত থেকে কবরের কাঁচা মাটি
ঝ’রে পড়তে না পড়তেই
আরেক পিতার বুক-শূন্য-করা গুলিবিদ্ধ সন্তানের লাশ
নেমে যায় নীরন্ধ্র কবরে।