শাহিদ মোবাশ্বের

শাহিদ মোবাশ্বের

শাহিদ মোবাশ্বের কলাম ‘বইমেলা কেন’

প্রকাশিত : জানুয়ারি ৩০, ২০২৪

গত বছরের ফেব্রুয়ারি মাসে তুরস্ক থেকে প্রকাশিত "দৈনিক সাবাহ" পত্রিকায় প্রকাশিত এক প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, জাতিসংঘ শিক্ষা, বিজ্ঞান ও সাংস্কৃতিক অর্গানাইজেশন- ইউনেস্কো পৃথিবীর সাত হাজার ভাষার মধ্যে ছ`হাজার সাতশ আদিবাসীদের ভাষাকে সবচেয়ে "বিপন্ন ভাষা" হিসেবে চিহ্নিত করেছে! অর্থাৎ এই ভাষাগুলো বিলুপ্তির সম্মুখীন বলে মনে করছে জাতিসংঘের এই অঙ্গ সংগঠনটি। প্রতিবেদনটিতে আরও বলা হয়েছে, প্রায় তিন হাজার ভাষার বিলুপ্তি ঘটবে চলতি একুশ শতকের মধ্যেই যার অর্থ হচ্ছে সাংস্কৃতিক ও ভাষাগত বৈচিত্র্যের বিলুপ্তি! এই ভাষার বিলুপ্তির আরও একটি অর্থ হচ্ছে মানবতার সর্বজনীন এবং স্বাভাবিক ঐতিহ্যের চিরতর বিলুপ্তি।

 

জাতিসংঘের মতে, ভাষার বৈচিত্র্যের এই বিলুপ্তি জৈবিক জীবন থেকে শুরু করে সাংস্কৃতিক জীবন পর্যন্ত সবকিছুতেই প্রভাব বিস্তার করে। উল্লেখ্য ১৯৫০ সালের পর থেকে যে সকল ভাষা আর চর্চিত হচ্ছেনা সেই ভাষাগুলোকে "দি এটলাস অব দি ওয়ার্ডস ল্যাংগুয়েজ ইন ড্যাঞ্জার" এর "বিলুপ্তির" সংজ্ঞায় রাখা হয়েছে। আর এই তালিকায় রয়েছে ক্যাপপাডোসিয়ান গ্রীক (টারকিয়ে), গোথিক, মোজারাবিক, প্রাচীন প্রুসিয়ান, ওয়েস্টার্ণ মানসি এবং যুক্তরাষ্ট্রের হুরোন-ওয়েনডট এর মত ভাষাগুলো।

 

তরুণ ভাষাভাষীরা যখন দাদা-দাদী বা নানা-নানী তথা বৃদ্ধ-বৃদ্ধায় পরিণত হয়ে পড়েন এবং নিজেদের চর্চিত ভাষা আংশিক এবং কদাচিৎ ব্যবহার করেন তখন তাদের ভাষাকে "অতীব বিপন্ন" হিসেবে গণ্য করা হয়। আর পরবর্তী প্রজন্মের মাঝে সঞ্চারিত না হলে এই বৃদ্ধ-বৃদ্ধা বয়সী লোকজনের চর্চিত ভাষাকে "মারাত্মকভাবে বিপন্ন" হিসাবে বর্ণনা করা হয়। আবার ছেলেমেয়েরা যদি গৃহে তাদের নিজ মাতৃভাষায় কথা না বলে তবে তা "নিশ্চিতভাবেই বিপন্ন" এবং নির্দিষ্ট কোন এলাকায় কোন ভাষার ব্যবহার সীমিত করা হলে সেই ভাষাকে "ঝুঁকিপূর্ণ" হিসেবে গণ্য করা হয়।

 

যে ভাষার উপর কোন বিধিনিষেধ নেই এবং সকল প্রজন্ম ঐ ভাষায় কথা বলে সেই ভাষাকে নিরাপদ বলে ধরে নেয়া যায়। আর এই শ্রেণীবিভাগ অনুযায়ী এ পর্যন্ত ব্যবহৃত পৃথিবীর চার শতাংশ ভাষার পূর্ণ বিলুপ্তি হয়েছে, অর্থাৎ আর ঐ সকল ভাষায় কথা বলার আর কেউ নেই।

 

বর্তমানে চর্চিত ভাষার দশ শতাংশ ভাষা "অতীব বিপন্ন ", নয় শতাংশ ভাষা "মারাত্মকভাবে বিপন্ন" ১১ শতাংশ ভাষা "নিশ্চিতভাবেই বিপন্ন " এবং আরও ১০ শতাংশ ভাষাকে "ঝুঁকিপূর্ণ" হিসেবে গণ্য করা হয়।

 

চলতি শতকের মধ্যে এ সকল ভাষার বিলুপ্তি হতে পারে বলে ইউনেস্কো আশঙ্কা প্রকাশ করছে! ফলে জাতিসংঘ ২০০০ সাল থেকে প্রতি বছর একুশে ফেব্রুয়ারি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসাবে পালন করছে। প্রতিবেদনটিতে ভাষাগত বৈচিত্র্যের গুরুত্ব তুলে ধরার ক্ষেত্রে অবদান রাখার জন্য বাংলাদেশকে ধন্যবাদ জানানো হয়েছে।

 

পৃথিবীর মোট জনগোষ্ঠীর ৪ শতাংশ অর্থাৎ ২৩৩.৭ মিলিয়ন মানুষের প্রথম ভাষা বাংলা। বাংলাদেশের ৯৮ শতাংশ মানুষের মাতৃভাষা বাংলা। দেশটির জাতীয় ও দাপ্তরিক ভাষাও বাংলা। আর ভারতের ২৩টি দাপ্তরিক ভাষার একটি বাংলা। দেশটির পশ্চিমবঙ্গ, ত্রিপুরা ও আসামের বারাক উপত্যকার দাপ্তরিক ভাষা বাংলা। ২০১১ সাল থেকেই দেশটির ঝাড়খণ্ড রাজ্যের দ্বিতীয় দাপ্তরিক ভাষা হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে বাংলা। এ ছাড়া ভারতের বিহার, মিজোরাম, উড়িশ্যা, মেঘালয়ের উল্লেখযোগ্য সংখ্যক বাংলা ভাষী মানুষের বসবাস রয়েছে। মোট কথা আমেরিকা, ইউরোপ, মধ্যপ্রাচ্যসহ পৃথিবীর সব প্রান্তে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে বাংলা ভাষাভাষী ৩৪ কোটি মানুষ।

 

বাংলা ভাষাভাষী মানুষের - বিশেষত শিক্ষিত সচেতন শ্রেণীর প্রত্যাশা নিজেদের এবং পরবর্তী প্রজন্মের মাঝে মাতৃভাষা বাংলার চর্চা অব্যাহত থাকুক, স্বগৌরবে টিকে থাকুক। এই প্রত্যাশা বাস্তবায়ন প্রচেষ্টায় বই পাঠকে অভ্যাসে পরিণত করার লক্ষ্যে বিশ্বের বিভিন্ন স্থানে বইমেলার আয়োজন করা হয়।

 

এসব বইমেলায় বিভিন্ন ধরনের বইয়ের স্টলের পাশাপাশি বাংলা নাটক, বাংলা চলচ্চিত্র, বিষয়ভিত্তিক আলোচনা, কবিতা আবৃত্তি, চিত্রাংকন ইত্যাদি আয়োজনের মধ্য দিয়ে শেষ হয়। তবে বাংলা ভাষাচর্চা, প্রসার ও রক্ষা সংক্রান্ত সর্বজনীন কর্মকৌশল নিয়ে কোনো সরব আলোচনা চোখে পড়ে না! এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশ, পশ্চিমবঙ্গ, আসাম ও ত্রিপুরাসহ বাংলা ভাষাভাষী সব অঞ্চলের সরকারি পর্যায়ে দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তাদের সমন্বয়ে কমিটি গঠন করা অত্যাবশ্যক। আর বিষয়টি যেহেতু মানবীয় যোগাযোগের সঙ্গে সম্পর্কিত তাই ওই কমিটিতে অভিজ্ঞ যোগাযোগবিদদের অন্তর্ভুক্ত করে সবার মতামতের ভিত্তিতে বাংলা ভাষা চর্চা, প্রসার ও রক্ষা সংক্রান্ত একটি সর্বজনীন কর্মকৌশল প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন করা গুরুত্বপূর্ণ!

 

আমরা যারা যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য আর কানাডার মতো পাশ্চাত্যের উন্নত দেশগুলোতে বসবাস করি তাদেরই এই সর্বজনীন কর্মকৌশল প্রণয়ন নিয়ে কাজ শুরু করতে হবে। আমাদের বাংলা ভাষা চর্চা, প্রসার ও রক্ষাবিষয়ক আলোচনা করে ব্যাপক জনমত তৈরি করতে হবে। সেই সাথে ওই আলোচনার সুপারিশগুলো সংশ্নিষ্ট কর্তৃপক্ষের নজরে আনতে হবে। কাজটি হবে এক ধরনের প্রেসার গ্রুপের মতো।

 

বইকে অতীত ও ভবিষ্যতের মধ্যে সংযোগ এবং বিভিন্ন প্রজন্ম ও সংস্কৃতির মধ্যে সেতু হিসেবে বর্ণনা করা হয়। আর তাই বই পড়ার অভ্যাস শুরু করতে হবে ব্যক্তি পর্যায় থেকেই। কেননা শিক্ষা কেউ কাউকে দিতে পারে না। আর তাই ঘরে ঘরে লাইব্রেরি গড়ে তুলে স্বশিক্ষায় শিক্ষিত হতে হবে। লাইব্রেরি গড়ে আমাদের সন্তানদের স্বচ্ছন্দচিত্তে স্বশিক্ষিত হওয়ার সুযোগ করে দিতে হবে, শিক্ষার পথ দেখিয়ে দিতে হবে, তাদের মাঝে কৌতুহল আর জ্ঞান পিপাসাকে জাগিয়ে দিতে হবে এবং তাদের মনোরাজ্যে ঐশ্বর্যের সন্ধান দিতে হবে। আর তা করতে হবে বই পড়ার অভ্যাস গড়ে তোলার মধ্য দিয়ে।

 

নেলসন ম্যান্ডেলা একদা বলেছিলেন, `যে শুধু বুঝতে পারে, তার সাথে যখন তুমি কথা বলো তখন তা তার মস্তিস্ক পর্যন্ত পৌঁছায়, আর যখন তুমি তার নিজ ভাষায় কথা বলো তখন তা তার অন্তর পর্যন্ত পৌঁছে যায়!` এর অর্থ এই যে, আমরা যেন আমাদের সন্তানদের সাথে মাতৃভাষা বাংলায় কথা বলি যাতে করে আমাদের বার্তা তাদের হৃদয় পর্যন্ত পৌঁছে যায়।

 

আমরা যেন আমাদের সন্তানদের এ কথা শেখাই যে, সাহিত্যচর্চা শিক্ষার প্রধান অঙ্গ। সাহিত্যচর্চাই তার মনকে সচল আর সমৃদ্ধ করতে পারে। তার দর্শন, অন্তরের স্বপ্ন, আশা-নৈরাশ্য, অনুরাগ-বিরাগ, দর্শন, ধর্মনীতি, বিজ্ঞান- এসব কিছুর সমন্বয়েই সাহিত্য। তাদের আরও শেখাই যে সাহিত্যচর্চার মাধ্যমেই প্রত্যেক মানুষ তার স্বীয় শক্তি ও রুচি অনুসারে নিজের মনকে নিজের চেষ্টায় আত্মার রাজ্যে জ্ঞানের পথে এগিয়ে নিয়ে যেতে পারে। মনকে সজাগ ও সবল রাখতে না পারলে জাতির প্রাণ যথার্থ ফুর্তি লাভ করে না; অতপর যে জাতি যত নিরানন্দ সে জাতি তত নির্জীব। একমাত্র আনন্দের স্পর্শে মানুষের মন-প্রাণ সজীব ও সতেজ হয়ে ওঠে। সুতরাং, সাহিত্যচর্চার আনন্দ থেকে বঞ্চিত হওয়ার অর্থই হচ্ছে জাতির জীবনীশক্তি হ্রাস করা। একমাত্র বই পড়েই এই সাহিত্যচর্চা সম্ভব। আর সেই বই হতে হবে মাতৃভাষার তথা বাংলা বই।

 

সন্তানদের আরও শেখাই যে আমাদের সবচেয়ে পছন্দের শখগুলোর অন্যতম হচ্ছে বই পড়া। বই মানুষের মনুষ্যত্বকে জাগিয়ে তোলে! আর বই পড়ে তথা সাহিত্যের রস আস্বাদন করার মাধ্যমেই জীবনকে মহৎ আর সুন্দর করা যায়! নিজ ভাষা তথা বাংলা ভাষার বই পড়েই তা আরও বেশি করে অর্জন সম্ভব। তবে সাহিত্যচর্চার জন্য চাই লাইব্রেরি। আর তাই ঘরে ঘরে লাইব্রেরি গড়ে তুলে সন্তানদের জীবনকে মহৎ আর সুন্দর করে তুলতে হবে আমাদেরই!

 

উন্নত বিশ্বে বসবাসকারী আমরা অনেকেই সন্তানদের ভবিষ্যৎ নিয়ে উদ্বিগ্ন থাকি! বিপথগামী হওয়ার আশঙ্কায় থাকে বহু মাতা-পিতা! এসব বিপথগামীতা থেকে তাদের বিরত রাখার অন্যতম কৌশল হতে পারে বই পড়া। সে ক্ষেত্রে সন্তানদের মাঝে ইরানি দার্শনিক ও কবি ওমর খৈয়ামের উক্তি- মদ রুটি ফুরিয়ে যাবে, প্রিয়ার কালো চোখ ঘোলাটে হয়ে যাবে, কিন্তু বই, সে তো অনন্ত যৌবনা, যদি বইয়ের মতো বই হয়- ছড়িয়ে দিতে হবে।

 

আর তাই শুধু ঢাকা, কলকাতা, ওয়াশিংটন ডিসি আর নিউইয়র্ক শহরে নয়, ক্যালিফোর্ণিয়া, টেক্সাস, ফ্লোরিডা ও মিশিগানে, কানাডার টরেন্টো, অটোয়া ও কুইবেক, ইংল্যান্ডের লন্ডন, বার্মিংহাম, ল্যানচেচ্টার ও ব্রিস্টলেসহ বাঙ্গালী অধ্যুষিত পৃথিবীর সব বড় বড় শহরে বইমেলার আয়োজন করতে হবে। বাংলাদেশের প্রতিটি বিভাগীয় শহর, সম্ভব হলে প্রতিটি জেলা শহরে বইমেলার আয়োজন করতে হবে।

 

৩৪ কোটি বাঙালির মাতৃভাষা বাংলাকে পৃথিবীর বুকে স্বগৌরবে টিকিয়ে রাখতে এবং পারিবারিকভাবে প্রাত্যহিক জীবনে বাংলা চর্চার মাধ্যমে ঘরে ঘরে এ ভাষার চর্চা জোড়ালো করতে পৃথিবীর বিভিন্ন জায়গায় আরও অধিক সংখ্যক বইমেলার আয়োজন করতে হবে।

লেখক: যুক্তরাষ্ট্র প্রবাসী সাংবাদিক