শিক্ষা, রাষ্ট্রপ্রসঙ্গ ও বিবিধ বিবেচনা

আফসানা বেলা

প্রকাশিত : সেপ্টেম্বর ১৬, ২০১৯

শিক্ষা ব্যবস্থা একটি ডিসিপ্লিনিং প্রোসেস, নাগরিককে একটি বিশেষ ব্যবস্থা-কাঠামোতে তা অভ্যস্ত করে এবং বিদ্যমান ব্যবস্থাকে টিকিয়ে রাখতেও সহায়তা করে। তাই রাষ্ট্রের কাছে শিক্ষা ও শিক্ষা ব্যবস্থা ও ব্যবস্থাপনা সবসময়েই গুরুত্বপুর্ণ। শিক্ষা ব্যবস্থাকে মতাদর্শ তৈরির এপারেটাসও বলা হয়, যা দিয়ে নাগরিকের মধ্যে ভাবাদর্শ সঞ্চারিত করা হয়। আমরা সাধারণ মানুষরা ধর্মের বরাতে চলি, আর রাষ্ট্র চলে বিশ্ববিদ্যালয়ে তৈরি করা গবেষণা ও জ্ঞানের বরাতে। সেক্ষেত্রে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোকে জনমুখি হওয়ার প্রয়োজন পরে। অর্থাৎ জনগণের জীবন-জীবিকা, স্বপ্ন-কল্পনা, অনুভূতি কাঠামো, প্রাত্যহিক জীবন ও সংগ্রামের সাথে পাঠ্য বিষয়ের সংযোগ ও সম্পর্ক থাকা উচিত।

ধরা যাক, বাংলাদেশের খনিজ সম্পদ উত্তোলনের বিষয়টি। এই উত্তোলন-কর্ম করে থাকে বিদেশি প্রতিষ্ঠান। তো, এই খনিজ উত্তোলনের ইঞ্জিনিয়ারিং জ্ঞান-চর্চা একাডেমিকালি আমাদের দেশে হওয়ার কথা, যাতে এ দেশেই দক্ষ লোক তৈরি হয়। আবার, আমাদের মৎস্য সম্পদ নিয়ে সরকার যদি নীতি প্রণয়ন করতে চায় তবে মৎস্য সম্পদ নিয়ে এ দেশে যে গবেষণা বা জ্ঞান উৎপাদিত হয়েছে সেখান থেকেই তাকে দিকনির্দেশনা নেয়ার কথা। তাই দেখা যাচ্ছে, রাষ্ট্রকে গড়ে তোলার সাথে শিক্ষা ব্যবস্থার বা একাডেমির সম্পর্ক আছে। ‘শিক্ষা’র প্রকৃত প্রতিষ্ঠান গড়া না গেলে রাষ্ট্র গঠনকাজেও কমতি থেকে যাবে। এরিস্টোটল মানুষকে রাজনৈতিক প্রাণী বলেছিলেন। তিনি অনেক সময়ই মানুষকে রাষ্ট্রের জায়গা থেকে দেখেছেন, আবার অন্য চিন্তকরা রাষ্ট্রকে নাগরিকের জায়গা থেকেও দেখেছেন। জনগণের কাছ থেকে যা কিছু অস্পষ্টভাবে শেখা হয়, তা স্পষ্ট করে প্রকাশ করার দায় শিক্ষা ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানের।

শিক্ষা ব্যবস্থার মাধ্যমেই রাষ্ট্র নির্ধারণ করে, সে কী ধরনের জাতি গঠন করতে চায়। যেমন, লর্ড মেকলে তার প্রস্তাবিত শিক্ষা ব্যবস্থার মধ্য দিয়ে রক্তে-বর্ণে ভারতীয়, কিন্তু চিন্তায়-রুচিতে ইংরেজ— এমন ভারতীয় গড়ে তুলতে চেয়েছিলেন। কারণ এমন শ্রেণি গড়ে তুলতে পারলে শাসনে সুবিধা। বিদ্রোহ ও বিপ্লবের সম্ভাবনা কম। সিপাহি বিদ্রোহের পরপরই কোলকাতা, পাঞ্জাব ও মাদ্রাজ বিশ্ববিদ্যালয় গড়ে তোলা হয়েছিল, যাতে ইংরেজি ভাষা ও জ্ঞানবিজ্ঞানের সাথে পরিচিত হয়ে জনগণ ইংরেজ শাসনের মহিমা উপলব্ধি করে ও ইংরেজশাসন বিরোধী অন্দোলন বেগবান না হয়। তাহলে বোঝাতেই পারা যাচ্ছে, শিক্ষা রাষ্ট্রের জন্য কতটা জরুরি। শিক্ষা যে ব্যক্তির জন্যেও জরুরি তা বলাই বাহুল্য। কিন্তু কার জন্য কতটুকু আনুষ্ঠানিক শিক্ষা প্রয়োজন সেটির আলোচনাও দরকার সময়-সময়ান্তরে।

দুই.
প্রাথমিক শিক্ষা বাধ্যতামূলক করা সরকারের খুব গুরুত্বপূর্ণ কাজ। প্রাথমিক শিক্ষা হোক আর বিসিএসই হোক, সবাইকেই একটা ধরাবাঁধা শিক্ষাগত নিয়মের মধ্য দিয়ে যেতে হয় যোগ্যতা প্রমাণের জন্য। এটাই আধুনিক কালের বিধিবদ্ধ ব্যবস্থা। একটি দেশের নির্বাচিত সরকারের নির্দিষ্ট মেয়াদ নির্ধারিত আছে; কিন্তু ঠিক কতটুকু তাত্ত্বিক ও বাস্তব শিক্ষা প্রয়োজন একটি দেশকে লিড করার জন্য, সেই নির্দেশনাও সংবিধান বা আইনে থাকা দরকার। একটু ভাবি তো, যদি অন্যান্য চাকরির জন্য শিক্ষাগত যোগ্যতা নির্ধারিত থাকে, তবে রাজনৈতিক পদগুলোর জন্য নয় কেন? একটি সাধারণ এবং অদ্ভুত ব্যাপার, কলেজ বা বিশ্ববিদ্যালয়ের যে সকল ছাত্রছাত্রীদের পড়াশুনার সাথে তেমন যোগাযোগ রাখতে দেখা যায় না তারাই সাধারণত রাজনীতির সাথে সম্পৃক্ত থাকে (কিছু বিরল ব্যতিক্রম বাদে)। একজন শিক্ষিক বা ইঞ্জিনিয়ার হতে চাওয়াটা যতটা সম্মানজনক ও স্বাভাবিক বোধ হয়, কেউ রাজনীতিবিদ হতে চাইবে, এ ব্যপারটা ততটাই অস্বাভাবিক ঠেকে আমাদের কাছে, বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে।

এ দেশের একজন উচ্চশিক্ষিত মেয়ে বা ছেলে কেন সহজভাবে ভাবতে পারে না যে, সে ভবিষ্যতে রাজনীতি করবে? দেশের রাজনীতিবিদ যারা থাকবে তাদের হওয়ার কথা একেকজন ইনটেলেকচুয়াল ও প্রাসঙ্গিকভাবে এডুকেটেড। আমাদের দেশে ৩০-৩৫ বছরে (যদিও কোনো জাতির জন্য এটি খুব দীর্ঘ সময় নয়, আবার একেবারে কমও নয়) উল্লেখযোগ্য রাজনৈতিক নেতৃত্ব তৈরি না হওয়ার পেছনে চেনামুখসমূহেরই দীর্ঘদিন ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত থাকাটাকে দায়ী করেন বিশেষজ্ঞরা। তাই মনে করি, রাষ্ট্রীয় পদগুলো ২ মেয়াদের বেশি হওয়া উচিত নয়। ২ মেয়াদের মাঝখানেও পর্যাপ্ত বিরতি থাকলে ভালো যাতে ক্ষমতার আলিঙ্গন মুক্ত হয়ে সাধারণ নাগরিক হয়ে ওঠা হয়, তাহলে জনগণের প্রয়োজনগুলোকে বুঝতে পারা হয়ে ওঠবে আরো একটু বেশি। গণতান্ত্রিক-অগনতান্ত্রিক-স্বৈরাচারি ও একনায়িকাতান্ত্রিক শাসনের যে অভিজ্ঞতা বাংলাদেশের আছে তা থেকে দুটো উপসংহার টানা যায়:

(১)ক্ষমতা নিয়ে বেশিদিন নাড়াচাড়া করার সুযোগ খুব নিষ্ঠাবান কাউকেও দেয়া উচিত নয়।
(২) যোগ্য তরুণ গোষ্ঠীকেও যেন রাজনৈতিক পদগুলোতে জায়গা করে দেয়া যায় সেই ব্যবস্থা করা উচিত।

যাই হোক, বাংলাদেশ ও ভারতবর্ষের ইতিহাসে যেসব অসামান্য নেতৃবৃন্দের আমরা সাক্ষাৎ পাই, তারা একইসাথে শিক্ষিত বা স্বশিক্ষিত ও প্রজ্ঞাবান। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের অসামান্য নেতৃত্বের গুণের পাশাপাশি তাঁর বিদ্যাবত্তা ও গভীর অন্তর্দৃষ্টির খবর পাওয়া যায় তাঁর ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’ ও ‘কারাগারের রোজনামচা’ পড়লে। জহরলাল নেহেরুর Discovery of India, মহাত্মা গান্ধীর My Experiment with truth প্রকাশ করে তাদের ভেতরকার দার্শনিক সত্তা। একেক জন তাদের সময়ের শ্রেষ্ঠ মানুষ জ্ঞানে, কর্মে, স্বপ্ন দেখা ও দেখানোতে। আমেরিকার অবিসাংবাদিত নেতা আব্রাহাম লিঙ্কন গণতন্ত্রের সংক্ষিপ্ততম সংজ্ঞা সরবরাহ করেছেন, Govt of the people, by the people, for the people। নেলসন মেন্ডেলার Long Walk to Freedom বইয়ে পাওয়া যায় তার সংগ্রাম, অধ্যয়ন ও অধ্যবসায়ের কথা। Francis Bacon এর ‘অফ স্টাডিজ’ প্রবন্ধে আমরা Expert man ও Learned man এর মধ্যে পার্থক্য পড়েছি। একজন রাজনীতিবিদকে একই সাথে হতে হয় এক্সপার্ট ম্যান ও লার্নেড ম্যান।

ইতিহাস পরিক্রমায় দেখতে পাই, প্রতিটি মহান রাজনীতিবিদই একেক জন রাষ্ট্রদার্শনিক। আমার মনে হয়, ইংরেজি Politician শব্দটির চেয়ে বাংলাভাষার ‘রাজনীতিবিদ’ শব্দটি অধিক অর্থবহ। একজন শিক্ষককে যেমন শিক্ষাবিদও হতে হয়, তেমনি যিনি রাজনীতি করেন তাকে রাজনীতিবিদও হতে হয়। অর্থাৎ রাজনীতি বিশারদ হতে হয়। অর্থাৎ, তিনি স্বদেশ ও বিশ্বের শাসনতান্ত্রিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক ইতিহাস জানবেন, নানা বিদ্যায় বিভূষিত থাকবেন। ফলে একজন রাজনীতিবিদ সক্ষম হয়ে উঠবেন তার অধীনস্ত আমলামণ্ডলীকে, যারা মূলত বেকন কথিত Expert man, তাদেরকে যথাযথ ডিরেকশন ও ভিশন দিতে। তা না-হলে, অনির্বাচিত চাকুরিজীবি কর্মকর্তাগণই হয়ে উঠবেন দেশের ভাগ্যবিধাতা যা দেশ ও দশের জন্য কল্যাণকর হবে না। কারণ শুধু রাজনীতিবিদগণেরই জবাবদিহি করতে হয় জনগণের কাছে। জাতির মেরুদণ্ড সোজা রাখার দায়িত্ব যারা নেন বা ভবিষ্যতে নিবেন, তারা নিজেদের মেরুদণ্ড ও মস্তক আগে সুদৃঢ় করবেন, সেই প্রত্যাশা সবার।

আমাদের এমএ তে পাঠ্য Civil Disobedience প্রবন্ধের প্রথম প্যারাতেই হেনরি ডেভিড থরো রাষ্ট্রের বল প্রয়োগকারি একটি চরিত্রের প্রতি আমাদের নজর ফিরিয়েছেন। তার মতে, সেই সরকারই সেরা সরকার যা Governs not at all। অর্থাৎ যে রাষ্ট্র বলের উপর নির্ভর না কোরে ন্যায়-নীতির উপর নির্ভর করে সেই রাষ্ট্র বা সরকারই সেরা। ৯/১০ এপ্রিল, ২০১৮- এর কোটা সংস্কারের অহিংস আন্দোলনে আইনশৃঙ্খলারক্ষী বাহিনী শিক্ষার্থীদের উপর যেভাবে হামলে পড়েছে তা ‘ন্যায়’কে ফিজিকাল ফোর্স দিয়ে দমনের সামিল। অথচ ন্যায়কেই এবং যা-কিছু ন্যায্য তাকেই প্রতিষ্ঠিত ও সমুন্নত রাখা উচিত রাষ্ট্রের। কোনো নির্দিষ্ট শ্রেণির দাবির প্রতি যদি প্রায় সকলেরই সম্মতি গড়ে ওঠে তখন তার ন্যয্যতা নিয়ে প্রশ্ন থাকে না। আবার হেনরি ডেভিড থরো বলছেন, আমি একাই যদি `ন্যায়` হই, তবে আমিই সংখ্যাগরিষ্ঠ (If I am just, I am the majority)।

যাই হোক, একটি ন্যায়-ভিত্তিক সমাজ ও রাষ্ট্র গঠনে পেশাগত ও বিশেষায়িত নানা জ্ঞানের পাশাপাশি নৈতিক ও নান্দনিক শিক্ষার প্রয়োজন অনস্বীকার্য।