
শিখরে চীন
পর্ব ১
মূল: উ শিয়াওবোপ্রকাশিত : নভেম্বর ১৬, ২০১৭
শক্ত একটি অর্থনৈতিক ভিত্তির ওপর দাঁড়িয়ে আছে আজকের চীন। এ অবস্থায় পৌঁছতে এ জাতির রয়েছে নানা ত্যাগ ও পরিকল্পনা। পশ্চাৎপদ চীনা জনগোষ্ঠীকে সুসংবদ্ধ একটি অর্থনৈতিক পাটাতন দিতে যে মানুষটি প্রথম উদ্যোগ শুরু করেন তিনি দেং শিয়াও পিং। মূল লেখাটি ইংরেজি থেকে অনুবাদ করেছেন সাজ্জাদ হায়দার। ছাড়পত্র এটি ধারাবাহিকভাবে প্রকাশ করছে।
প্রথম অধ্যায়: সংস্কার শুরু (১৯৭৮-১৯৮৩)
দেং চীনের দরজা খুলছেন
১৯৭৮ সালের শীতকাল। খুব ঠাণ্ডা পড়েছিল এ বছর। ধূসর বেইজিংয়ের ক্ষীণ আলোয় সিনহুয়া নিউজের সংবাদদাতা হ্মুরধার শ্লেষ মিশিয়ে লেখেন, দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতির পরিবর্তন শুরু হচ্ছে। অবশেষে শীতলতা দূর করে জনগণের জীবনে সামান্য উত্তাপ দিতে সূর্য়ের আলোর আভাস পাওয়া যাচ্ছে। বিশাল এ নগরীর জনাকীর্ণ বসতবাড়ি, সরু আলিগলির বিপুল জনগণ স্বস্তিদায়ক অনুভূতি পেতে শুরু করেছে।
৭৮ সালে চীনের যুগান্তকারী পরিবর্তনের যাত্রা এভাবেই শুরু হয়। এ সময় চীন বিভিন্ন চিন্তাধারায় সাড়া দিতে শুরু করে। দশবছর ধরে সাস্কৃতিক বিপ্লবের ডামাডোল এবং পঁচিশ বছরেরও বেশি সময়ের পরিকল্পিত অর্থনীতি দেশকে ধ্বংসের কিনারায় নিয়ে গিয়েছিল। তখন চীনজুড়ে ছিল একটি মাত্র ব্যাংক। দেশে ছিল না কোনও ইন্সুরেন্স কোম্পানি। ছিল না অর্থনৈতিক প্রতিষ্ঠান। রাষ্ট্রনিয়ন্ত্রিত প্রতিষ্ঠান ও কেন্দ্রীয় কোষাগারসহ দেশের সর্বমোট মজুদ মুদ্রা ছিল মাত্র ১০৮.৯৯ বিলিয়ন আর, এম, বি (চীনা মুদ্রা)। একটি মাত্র ব্যাংকে দেশের সব অর্থের ৮৩.৮% মুদ্রা সঞ্চিত ছিল। রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠানগুলোর স্থায়ী সম্পদ ব্যাংক থেকে বরাদ্দের মাধ্যমে পরিশোধিত করা হয়। ব্যাংক থেকে ধার নিয়ে তখন চলতি মূলধন সংগ্রহ করা হচ্ছিল।
১৯৫৮ থেকে ১৯৭৮- এই দশ বছরে নগর ও শহরে জনগণের গড় আয়ের প্রবৃদ্ধি ছিল ৪ আর, এম, বি (চীনা মুদ্রা) এরও কম। কৃষকদের বার্ষিক গড় প্রবৃদ্ধি ছিল ২.৬ আর, এম, বি (চীনা মুদ্রা) এর কম। এটি অবশ্য অর্থনৈতিক সুবিধা পাওয়া উপকূল অঞ্চলে নয়। বিমান যুদ্ধের ধবংসযজ্ঞ থেকে রক্ষা পেতে চীনের শিল্প প্রতিষ্ঠানগুলো স্থাপিত হয় দূরাঞ্চলে। দেশের দূরতম প্রতিররক্ষা এলাকায়। যৌক্তিক অর্থনৈতিক স্বার্থ উপেক্ষা করে জরুরি শিল্পগুলো স্থাপিত করা হয় পার্বত্য এলাকায়। যেখানে পরিবহন খরচ অনেক বেশি। ইচ্ছাকৃতভাবে শিল্পকারখানাগুলো পরস্পরের কাছ থেকে দূরে বসানো হয়। ফলে শিল্পকারখানাগুলো পরস্পরের সমন্বয়ে অর্থনৈতিক সুবিধা অর্জনে ব্যর্থ হয়। সকল কলকারখানায় উৎপাদন ভয়ানক হ্রাস পায়। বিশেষ করে হালকা শিল্পকারখানাগুলো অচল হয়ে পড়ে। শস্য ও নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যর জন্য জনগণ রাষ্ট্র দ্বারা ইস্যুকৃত কুপন ব্যবহার করছিল।
দেশের সম্ভাবনা প্রায় শেষ হয়ে যাচ্ছিল। ১৯৭৮ সালে একজন ক্ষুদে অথচ বিশাল ব্যাক্তিত্বশালী মানুষ, দেং শিয়াও পিং ইতিহাসের মঞ্চে দ্বিতীয় বারের মতো আর্বিভূত হলেন। তিনি চীনকে নতুনভাবে গঠনের নির্দেশনা দিতে শুরু করলেন। তার কণ্ঠে নুতন সুর ধ্বনিত হতে লাগল। তিনি আমূল পরিবর্তনের জন্য দেশের হাল ধরলেন। তার ছিল বিস্ময়কর একাগ্রতা, রাজনৈতিক প্রজ্ঞা ও সিদ্ধান্ত নেয়ার দৃঢ়তা। দেং শিয়াও পিং ১৯৭৮ সালের মার্চে জাতীয়ভাবে অনুষ্ঠিত এক অধিবেশনে সভাপতি নির্বাচিত হন। এরপরপরই তিনি ‘জাতীয় বিজ্ঞান সম্মেলন’ আহ্বান করেন। এ সম্মেলনে অংশ নেয়া ৬,০০০ শ্রোতাকে বিস্ময় ও আনন্দে ভাসিয়ে তিনি বললেন, ‘বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি হলো প্রাথমিক উৎপাদন শক্তি। বুদ্ধিজীবিরাও শ্রমিক শ্রেণির অংশ।’ এ ধরণের কথা আগে কেউ বলেনি। দু’বছর আগেও বুদ্ধিজীবিরা ছিল উপহাসের বস্তু। এ সভায় দেশের নেতৃবৃন্দ স্বীকার করলেন, বিভিন্ন ক্ষেত্রে চীন বাকি বিশ্ব থেকে পনের থেকে বিশ বছর পিছিয়ে আছে। বিজ্ঞানের উন্নয়নের জন্য তারা একটা পরিকল্পনা-নির্দেশিকা প্রস্তাব করলেন। প্রস্তাবে বলা হলো, বিংশ শতাব্দী শেষে বিজ্ঞানের নানাধাপে চীনা বিজ্ঞান বাদবাকি দেশকে ধরে ফেলবে এবং এগিয়ে যাবে। কিন্তু অবাস্তব এ লক্ষ্য শেষমেষ বাস্তবায়িত হয়নি। তবে গোটা দেশকে জাগাতে এ প্রস্তাবনা কাজ করেছে। চীনা জনগণ অভ্রান্ত গন্তব্যে যাওয়ার জন্য অপেক্ষারত রেলগাড়ির ইঞ্জিনের শব্দ শুনতে পেল।
ইতিহাসের সব পরিবর্তনই ঘটে জনগণের চিন্তাধারার পরিবর্তনের মাধ্যমে। দশ বছরের সাংস্কৃতিক বিল্পবের ফলে জনগণের সৃজনশীলতা ও স্বচ্ছ চিন্তাশক্তিসহ দেশের স্বাভাবিক কার্যক্রম ধ্বংস হয়ে যায়। জনগণের মনজগত, যাকে বলে ‘অতি বাম চিন্তাধারা’ দখল করেছিল। বহু বছর ধরে দেশ বঞ্চিত ছিল বর্হিবিশ্বের তথ্য প্রবাহ থেকে। এ ‘তথ্য অবরোধ’ অবস্থা জনগণের মনোজগত আক্রান্ত করেছিল।
এখন সংবাদপত্রের পাতায় সরকারের নীতি পরিবর্তনের ইঙ্গিত প্রকাশিত হওয়ার পর পরিবর্তন সূচিত হলো। ১১ মে গুয়াংমিং ডেইলিতে, ‘প্রকৃত অভিজ্ঞতাই হলো সত্য নিরূপণের একমাত্র মাপকাঠি’ শীর্ষক নিবন্ধ প্রকাশিত হলো। এ নিবন্ধ সরকারি বার্তা সংস্থা সিনহুয়া লুফে নিল এবং পুনঃমুদ্রিত করল। পরদিনই কমিউনিস্ট পার্টির স্বীকৃত মুখপত্র পিপলস্ ডেইলিতে পুরো নিবন্ধটি প্রকাশিত হলো। লেখক এখানে উল্লেখ করেন, “যে কোনও মতবাদ যদি বাস্তবতাকে উপেক্ষা করে ও সেটাকে অলঙ্ঘনীয় মনে করে, এবং প্রশ্ন করার সুযোগ না থাকে, তবে সেই মতবাদ প্রকৃত মার্ক্সবাদ-লেনিনবাদ অথবা মাওয়ের চিন্তাধারা নয়। এটা হলো পশ্চাৎমুখিতা, অন্ধ আদর্শবাদী ও সাংস্কৃতিক কর্তৃত্ববাদ।” এ নিবন্ধ জাতিকে আলোড়িত করল। কয়েকদিন পর দেং শিয়াও পিং সরকারি ভাষ্যে এই নতুন ধারাকে মার্ক্সবাদ ও লেনিনবাবাদী চিন্তাধারা বলে স্বীকৃতি দিলেন। এ উদ্যমকে ধরে রাখার সব শৃংখল ছিন্ন করার জন্য তিনি সকলের প্রতি আহ্বান জানালেন। তিনি বললেন, “আমাদের চিন্তাধারায় মহামুক্তি নিয়ে আসা প্রয়োজন।” সত্য মূল্যায়নের এই নতুন উদ্যোগই চীনের সার্বিক সংস্কারের অনুঘটক হিশেবে কাজ করছিল। পুরানো রাজনৈতিক নীতিকে উপড়ে ফেলল নতুন ধারা এসে। নতুন চিন্তা ছিল পুরোপুরি ভিন্ন ধরনের। অর্থনীতির নিরিখে এ চিন্তার লক্ষ্য ছিল বাণিজ্যকরণে ধারণাগত কাঠামো ও লক্ষ্যমাত্রা তৈরি করা। বাণিজ্যকে ‘স্বীকৃতি’ ও ‘নীতি’ করার এ মনোভাব এখনো চীনা সংস্কারে শক্ত প্রভাব জুগিয়ে চলছে।
১৯৭৮ সালেই চীনা জনগণ আরেকটি যুগান্তকারী পরিবর্তনের ইঙ্গিত পেল। মহাবিদ্যালয়ে ভর্তির জন্য পরীক্ষা পদ্ধতি ১৯৭৭ সালেই আংশিকভাবে পুনরায় চালু হয়। কিন্ত দশ বছরের মধ্যে প্রথম প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হয় ১৯৭৮ সালে। স্কুলের একটি শ্রেণিতে উত্তীর্ণ হওয়ার পরীক্ষায় ৬০ লাখেরও বেশি লোক অংশ নেয়। এদের অনেকেই ছিল যৌবন পেরিয়ে যাওয়া। ১৯৬০ ও ১৯৭০ দশকে এদের মধ্যে অনেকে নগর ও গ্রাম থেকে বিতারিত করে প্রত্যন্ত এলাকায় পাঠিয়ে দীর্ঘমেয়াদী রাজনৈতিক কর্মসূচিতে অংশ নিতে বাধ্য করা হয়। এ কর্মসূচির কারণে শহরগুলোতে চাকরিজীবীদের সংকট তৈরি হয়। এ কর্মসূচিতে শহরে থেকে বিপুল সংখ্যক শ্রমশক্তি গ্রামের প্রত্যন্ত এলাকায় স্থানান্তর করা হয়। জনগণ এখন যৌথ খামার ছেড়ে নতুন সুযোগ কাজে লাগাতে ব্যগ্র হয়ে ওঠে। কয়েক লাখ পরীক্ষার্থীর মধ্যে মাত্র ৪০০,০০০ লাখ বিদ্যালয়ে প্রবেশের যোগ্যতা অর্জন করে। যারা এ পরিবর্তন পছন্দ করেছিল তাদের ভাগ্য খুলে গিয়েছিল। সেই প্রারাম্ভিক শ্রেণি মেধাবী ছাত্ররাই এখন সরকারি শীর্ষ কর্মকর্তা ও খ্যাতিমান ব্যবসায়ী। “সত্য নিরূপণের মাপকাঠি” শীর্ষক জাতীয় বির্তক সফলভাবে শুরু করার পর দেং শিয়াও পিং এক ঐতিহাসিক সফরে জাপান যান। তরুণ বয়সে দেং ফ্রান্সে পড়াশুনা করেন এবং একটি ছাপাখানায় কাজ করেন। এরপর প্রায় অর্ধশতকের বেশি সময়ের মধ্যে তিনি কোনও পুঁজিবাদী কারখানায় পা দেননি। দেং ২২ অক্টোবর চীন ত্যাগ করেন এবং টোকিও গিয়ে প্রথমে তিনি ইস্পাত ও গাড়ি কারখানাগুলো পরিদর্শন করেন। এরপর তিনি আসেন ম্যাটসুশিয়া ইলেট্রিক কারখানা পরিদর্শনে। সেখানে বৈঠক করেন কোম্পানির প্রতিষ্ঠাতা ৮৩ বছর বয়স্ক কোনোসুকি ম্যাটসুশিয়ার সাথে। চীনে নিযুক্ত তৎকালীন জাপানি রাষ্ট্রদূত নাকায় ইয়োসুকি এ বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন এবং পরবর্তিতে তিনি এ বৈঠকের স্মৃতিচারণ করেন। ম্যাটসুশিয়া দেং এর কাছে জানতে চান জাপানের কোন জিনিসটা সবচেয়ে চিত্তাকর্ষক। দেং জিশাও পিং উত্তরে বলেন, ‘চীনে প্রচণ্ড শীত এবং এই শীতে উত্তাপ পেতে চীনা জনগণ কয়লার টুকরো জ্বালায়। এতে তারা প্রায়ই কার্বন মন-আক্সাইডের বিষক্রিয়ায় আক্রান্ত হয়। তিনি জেনে বিস্মিত হন, জাপানি কয়লা খণ্ড কার্বন মন-অক্সাইড নির্গত করে না। ১৯৭৮ সালে আরেকটি যুগান্তকারী পরিবর্তনের সূচনা হয়। ১৯৭৮ সালের ৩ জুলাই চীনা সরকার ভিয়েতনামকে সাহায্য করা বন্ধ করে দেয়। আলবেনিয়াকে দেয়া সকল অর্থনৈতিক ও কারিগরী সহায়তা চীন বাতিল করে। ২৩ অক্টোবর থেকে আনুষ্ঠানিকভাবে চীন-জাপান শান্তি চুক্তি কার্যকর হওয়া শুরু হয়। ১৯৭৮ সালের ১৬ ডিসেম্বর চীন-মার্কিন যৌথ ঘোষণা প্রকাশিত হয় এবং দু দেশের স্বাভাবিক কূটনৈতিক সর্ম্পক প্রতিষ্ঠিত হয়। চীনা বৈদেশিক নীতিতে ঘটে যাওয়া আরও অনেক সুদূরপ্রসারী পরিবর্তন ইঙ্গিত দ্যায়, চীন আদর্শগত বিবেচনা থেকে সরে এসেছে এবং অর্থনৈতিক উন্নয়নকেই জাতীয় নীতির মূল লক্ষ্য ঠিক করেছে। তখন বড় বড় রাজনৈতিক পরিবর্তনের কেন্দ্র ছিল রাজধানী বেইজিং। কিন্তু ১৯৭৮ সালে অর্থনীতিতে সবচেয়ে বড় ঘটনা ঘটে নগরে নয়, ঘটে একটি অত্যন্ত প্রত্যন্ত বিচ্ছিন্ন দারিদ্রপীড়িত গ্রামে। ২৪ নভেম্বর সন্ধ্যায় অপুষ্টিতে ভোগা, হলদে রঙের দেহধারী ২১ সদস্যের একটি দল ক্ষুদে কুঁড়েঘরে কেরোসিন বাতির ম্লান আলোয় বৈঠকে বসেছিল। গোপন বৈঠকের স্থানটি ছিল অনধুই প্রদেশের ফেনংয়াং কাউন্টির উৎপাদন ব্রিগেডের আওতাভুক্ত শিয়াওগ্যাং গ্রাম। তাদের মুখ ছিল হিংস্র, গায়ে ছিল ছেঁড়া পোষাক। কিন্তু যখন তারা লাল কালিতে আগুল চুবাচ্ছিল এবং সামনে রাখা একটি দলিলে একে একে লাল কালির আগুলের ছাপ দিচ্ছিল, তখন তাদের চোখে মুখে স্থির প্রতিজ্ঞার দ্যুতি ছড়াচ্ছিল। চলমান পদ্ধতি চালিয়ে যাওয়ার পরিবর্তে কারাদণ্ড কিংবা প্রাণদণ্ড বরণের জন্য একে একে সবাই শপথ নিল। এরপ যৌথ জমি ও সম্পদ তারা নিজেদের মধ্যে বণ্টনের চুক্তি করল। পরে এ চুক্তিনামা সংরক্ষণের জন্য চীনা বিপ্লবী জাদুঘরে (বর্তমান চীনা জাতীয় জাদুঘরের অংশ) রাখা হয়। এ চুক্তিকে চীনা কৃষি সংস্কারের প্রথম পদক্ষেপ বিবেচনা হয়।
চলবে...