প্রতীকী ছবি

প্রতীকী ছবি

শিমুল বাশারের গদ্য ‘ফিরে দেখা: পূর্বপুরুষের খোঁজে’

প্রকাশিত : জানুয়ারি ১৯, ২০২০

আমার বাপ-দাদা ও তার পূর্বপুরুষেরা প্রকারান্তরে নব্যপ্রস্তর যুগের মানুষ ছিলেন। মূলত তারা কৃষিকাজ করতেন। তারা যে অঞ্চলে বাস করতেন, সেখানকার মানুষ মাছ, গরু-ছাগল, হাঁস-মুরগি তাদের ঘরেই প্রতিপালন করতেন। চারপাশের ভূপ্রকৃতি আজও সেসবের সাক্ষী দেয়। যদিও আমার বাবা শেষজীবনে ব্যবসায়ী হয়েছিলেন। সে হিসেবে বলা চলে, তিনি ইউরোপের শিল্প বিপ্লবের প্রভাবে প্রভাবিত হয়েছিলেন ৯০ দশকের পরে। নব্যপ্রস্তুর যুগের জীবনযাপন থেকে প্রাচীন যুগ কিংবা মধ্যযুগে খুব একটা পরিবর্তন ওই অঞ্চলের মানুষের মাঝে আসেনি। পাল রাজা, সেন রাজা, সুলতানি আমল ও মোঘলরা এ অঞ্চলে দীর্ঘদিন শাসন করেছিলেন। এসব কারণে তাদের মাঝে ধর্ম ও দর্শনগত কিছুটা প্রভাব অবশ্য পরিলক্ষিত হয়, কিন্তু সেটা তাদের জীবনধারণ ও জীবনাচরণকে আমূল পাল্টে দেয়নি।

নব্যপ্রস্তর যুগ অর্থাৎ খ্রিস্টপূর্ব ৮,০০০ থেকে খ্রিস্টপূর্ব ৫.০০০— এ সময়টায় মানব সভ্যতায় যেসব বিপ্লব সূচিত হয়, তার মধ্যে উদ্ভিদ ও পশুর গৃহপালন এবং নিয়মানুগ কৃষিপদ্ধতি রপ্ত করা একটি অনন্য মাইলফলক। কৃষির উন্নয়নের সঙ্গে সঙ্গে বেশির ভাগ মানুষ যাযাবর জীবনযাত্রা ত্যাগ করে স্থায়ীভাবে কৃষকের জীবন গ্রহণ করে। তবে বহু সমাজে যাযাবর জীবনব্যবস্থা রয়ে যায়। বিশেষ করে ভৌগোলিকভাবে বিচ্ছিন্ন অঞ্চলগুলিতে। এছাড়া যেখানে আবাদযোগ্য উদ্ভিদ প্রজাতির অভাব ছিল, সেখানে। কৃষি থেকে প্রাপ্ত খাদ্য নিরাপত্তা ও উদ্বৃত্ত উৎপাদনের ফলে গোষ্ঠীগুলি ধীরে ধীরে বৃদ্ধি পেয়ে আরও বড় সামাজিক প্রতিষ্ঠানের জন্ম দেয়। আমার বাপ-দাদারা পরিবারের মানুষ ছিলেন, সমাজ প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। আমার বাবাও পরিবার নিয়ে বাস করতেন। জীবনের শেষদিন পর্যন্ত সমাজের সবার খোঁজ-খবর নিতেন। বাজার করতে একটি নির্দিষ্ট এলাকায় যেতেন।

হিস্ট্রিয়ানদের বই পড়ে আপনি হিস্টি জানতে পারবেন খুব কম। হিস্ট্রি পড়ার বিষয়ও নয়। এটি পাঠ করতে হয়। এই পাঠের জন্য আপনাকে প্রত্নতত্ত্ব বুঝতে হবে আগে। প্রত্নতত্ত্ব হচ্ছে পুরাতন বিষয়ক জ্ঞান, বস্তুগত নিদর্শনের ভিত্তিতে অতীত পুনঃনির্মাণ করার বিজ্ঞান। অতীতের সংস্কৃতি ও পরিবেশগত বিষয় নিয়ে চর্চা করে এমন অন্যান্য বিজ্ঞান বা বিষয়গুলো যেমন— ভূতত্ত্ব, পরিবেশ বিজ্ঞান, ভূগোল, মনোবিজ্ঞান, দর্শন। ধর্মতত্ত্বের সাথে প্রত্নতত্ত্বের পার্থক্য হলো, এটি কেবল বস্তুগত নিদর্শন অর্থাৎ প্রামাণ্য তথ্য নিয়ে কাজ করে এবং তার সাথে মানুষের জীবনধারার সম্পর্ক নির্ণয় করে। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, ভূতাত্ত্বিক ও পরিবেশ বিজ্ঞানীরা প্রাচীন ভূমিরূপ ও অন্যান্য পরিবেশগত তথ্য বিশ্লেষণ করে, ভূগোল আপনাকে পৃথিবীর স্থানিক জ্ঞান, ভূমি ও এর গঠন বিন্যাস সম্পর্কিত বিষয় সম্পর্কে ধারণা দেবে।

ইতিহাস পাঠের জন্য এসবের সমন্বিত জ্ঞানের দরকার হবে। আর পড়তে চাইলে আপনি হাজার হাজার ইতিহাসের বই পড়ে ফেলতে পারেন। এতে মুখস্থ করার বিদ্যাটাই শুধু জুটবে, এর বেশি কিছু নয়। যেমন, এক সময়ের বাংলার রাজধানী মহাস্থানগড়। এসব পুরাকীর্তি আপনাকে ইতিহাস পাঠের সুযোগ করে দিতে পারে। অন্যদিকে ইতিহাস পড়তে চাইলে? আপনার রেফারেন্স কি হবে? ইতিহাসতো শাসকের সেবকেরা লেখে? পরাজিতের কথা ইতিহাসে থাকে না। এমনকি এক শাসক আরেক শাসকের কীর্তি সমূলে নিশ্চিহ্ন করে। তাহলে আপনি যদি ইতিহাস পড়ে শিখতে চান তাহলে যা শিখবেন তা আপনাকে নিশ্চিত করে ভুল পথ দেখিয়ে দেবে। বই পড়ে জেনেছি, বিখ্যাত চীনা পরিব্রাজক হিউয়েন সাঙ ৬৩৯ থেকে ৬৪৫ খ্রিস্টাব্দের মধ্যবর্তী সময়ে পুন্ড্রনগরে এসেছিলেন। তার ভ্রমণের ধারাবিবরণীতে তিনি তখনকার প্রকৃতি ও জীবনযাত্রার উল্লেখ করে বর্ণনা দেন।

বৌদ্ধশিক্ষার জন্য প্রসিদ্ধ হওয়ায় চীন ও তিব্বত থেকে ভিক্ষুরা তখন মহাস্থানগড়ে আসতেন লেখাপড়া করতে। এরপর তারা বেরিয়ে পড়তেন দক্ষিণ ও পূর্ব এশিয়ার বিভিন্ন দেশে। সেখানে গিয়ে তারা বৌদ্ধ ধর্মের শিক্ষার বিস্তার ঘটাতেন। এইতো? কিন্তু আপনি যদি প্রত্নতত্ত্ব বোঝেন তবে জানতে পারবেন। যিশু খ্রিস্টের জন্মেরও আগে অর্থাৎ প্রায় আড়াই হাজার বছর আগে এখানে সভ্য জনপদ গড়ে উঠেছিল, প্রত্নতাত্ত্বিক ভাবেই তার প্রমাণ মিলেছে। প্রাচীর বেষ্টিত এই নগরীর ভেতর রয়েছে বিভিন্ন আমলের প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন।

মহাস্থানগড়ে কয়েক শতাব্দী পর্যন্ত মৌর্য, গুপ্ত, পাল ও সেন শাসকবর্গের প্রাদেশিক রাজধানী ও পরবর্তীকালে হিন্দু সামন্ত রাজাদের রাজধানী ছিল। তৃতীয় খ্রিস্টপূর্বাব্দ থেকে পঞ্চদশ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত অসংখ্য হিন্দু রাজা ও অন্যান্য ধর্মের রাজারা রাজত্ব করেন এ অঞ্চলে। হিউয়েন সাংয়ের সেসব বৌদ্ধরা এখন এ অঞ্চলে কোথায়? ইতিহাস বলে, সেন বংশের শেষ রাজা লক্ষ্মণ সেন (১০৮২-১১২৫) যখন গৌড়ের রাজা ছিলেন তখন এই গড় অরক্ষিত হয়ে যায়। প্রশ্ন হচ্ছে, মহাস্থানগড় যখন রক্ষিত ছিল তখনকার সভ্যতায় এ অঞ্চলে মুসলিম নিদর্শন খোঁজাকে নাল এন্ড ভয়েডের কোন ভাগে রাখবেন? বৌদ্ধরাই বা কেন এ অঞ্চলে আর সংখ্যা গরিষ্ঠ নেই? যদি আরবে মুসলিম সভ্যতার সূচনা ৫৭০ এর পরে হয়ে থাকে তবে এ ভারতবর্ষে মুসলিমদের আপনি বহিরাগত বলবেন নাকি বলবেন না? আমাদের মধ্যে যারা ইসলাম ধর্ম নিয়ে মাতামাতি করছি এবং একে অপরের সাথে বিরোধের সৃষ্টি করছি, সেটাকে রাজনৈতিক দৃষ্টি দিয়ে বিচার করবেন নাকি আর্থ সামাজিক পরিচয় সঙ্কটের মানদণ্ডে বিচার করবেন?

লেখক: কবি, গল্পকার ও গণমাধ্যমকর্মী