শুভদীপ বড়ুয়ার ‘নিঃশব্দ পাহাড়’ একটি দীর্ঘ হাঁটা

দীপ মণ্ডল

প্রকাশিত : মে ০৬, ২০২০

উপন্যাসের এক স্তর থেকে আরেক স্তরে যখন ঢুকছি, কিছু অধ্যায় আমাকে বারবার পড়তে হয়েছে। গ্রিক মিথ থেকে শুরু করে মিশরের আদি গল্প হয়ে বর্তমান সময় সব যেন একাকার হয়ে গেছে। এই উপন্যাসের পটভূমি আফগানিস্তান, পাকিস্তান, সোভিয়েত ইউনিয়ন, আমেরিকা এবং ভারত। অথবা বলা যেতে পারে, গোটা পৃথিবী।

সেই খ্রিস্টপূর্ব চতুর্থ শতাব্দী থেকে প্রায় দু’হাজার বছরের আফগান ইতিহাস, তার মিথিক্যাল বাস্তবকে লেখক নিপুণ হাতে তুলে ধরেছেন। এই উপন্যাসকে কী উপন্যাস বলবো— রাজনৈতিক উপন্যাস, না দার্শনিক উপন্যাস? উপন্যাসটি পড়তে পড়তে নিজেকেই যেন অচেনা লাগে। আর আফগানিস্তানের পরিবর্তিত হয়ে যাওয়াটা যেন আমাদের অস্তিত্বের পরিবর্তনেরই এক রূপ। উপন্যাসের চরিত্ররা মহসীন খান, মাহিল, স্যামুয়েল পিটার্স, শামেমা বা শীনকালন— প্রত্যেকের চোখে পৃথিবীর রূপের যথার্থ অবস্থান স্পষ্ট করে দেন লেখক তার কথকতার বুনটের মুন্সীয়ানায়।

যে কাঠামোয় এই উপন্যাস লেখা হয়েছে তা সত্যিই তারিফযোগ্য। গ্রিক সিভিল ওয়ার থেকে সেখানকার রিফিউজিদের আমেরিকায় পুনর্বাসন, আবার আফগানিস্তান থেকে পাকিস্তানে আফগানদের পুনর্বাসন; তার রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট, আফগান ইতিহাস, মিথ আর বাস্তবকে যেভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন লেখক, তাতে তার সুদক্ষতার পরিচয় পাওয়া যায়।

কখনো জানতে পারি চার্লিজ অ্যাঞ্জেল, The Duke of Hazard এর মতো আমেরিকান টিভি শো অথবা পরিচয় ঘটে আমেরিকান Nitty Gritty Dirt Band এর সাথে। আবার কুর্ট কোবেইনের গাওয়া সেই গান The man who sold the world. কী পাইনি এই উপন্যাসে! ইউলিসিসের কোনও এক চরিত্র, Alice in wonderland, হোর্হে লুইস বোর্হেস, জালালউদ্দিন রুমি, স্যার মুহম্মদ ইকবাল, রুডিয়াক কিপলিং থেকে গন উইথ দ্য উইন্ড’র থিম সং।

উপন্যাসের এক চরিত্র মাহিল, তার হাতে ইয়াসুনারি কাওয়াবাতার উপন্যাস Master of Go. গো একটি জাপানিক খেলা। কাওয়াবাতার এই উপন্যাস পড়তে গিয়ে মাহিলের মনে পড়ে গিয়েছিল এই উপন্যাসের আর এক চরিত্র স্যামুয়েল পিটার্সের কথা। স্যাম বলেছিল, দাবার সঙ্গে একেবারে প্রাথমিক ফারাকটুকু লক্ষ্য করুন আপনারা, দাবার গুটিগুলো ঘর দখল করে বসে থাকে, আর গো-এর গুটিগুলো দখল নেয় পাশাপাশি দুটি ঘরের সংযোগে সৃষ্টি হওয়া বিন্দুগুলো। ঘর দখল করে বলেই দাবার ঘুটিগুলোর প্রত্যেকে প্রত্যেকের থেকে ভীষণ আলাদা। আলাদা তাদের সামাজিক অবস্থান কি আভিজাত্য। কিন্তু গো-এর সবগুলো গুটি অবিকল একরকম দেখতে। শুধু দাবার মতোই একপক্ষ শাদা, আর আরেক পক্ষ কালো।

গো এমন একটি খেলা, যেখানে কোনও একটি মাত্র গুটির নিজস্ব কোনও গুরুত্ব কি ঐতিহ্য কোনোটাই নেই। তারা সকলে যেন অদৃশ্য কারও নির্দেশ মেনে খেলতে নেমেছে, বা যুদ্ধে নেমেছে। সেই সর্বেসর্বা রাজা হতে পারেন, বা স্বয়ং ঈশ্বর। দাবার রাজকীয় নির্দেশনা গো-তে অনুপস্থিত। গো-তেও রাজা আছেন, আছেন প্রভুও। কিন্তু তিনি বোর্ডের বাইরে বসে। তিনিই খেলোয়াড়। যার নির্দেশে বোর্ডের ওপর একের পর এক বিন্দু জয় করে চলেছে তার সেনারা। কিন্তু তিনি স্বয়ং বোর্ডের বাইরে। তিনি জানেন, তিনিই আসল রাজা, নয়তো এতগুলো সেনাকে তিনি নিয়ন্ত্রণ করতে পারতেন না। ব্যক্তিচিন্তার সম্পূর্ণটাই বোর্ডের বাইরে ছেড়ে আসা হয় গো-তে। বোর্ডের ওপর প্রত্যেকের অস্তিত্ব সমান এবং সীমিত। তাই ট্যাকটিক বলে কোনও শব্দ নেই গো-তে, স্ট্রাটেজি`র ওপর নির্ভর করে গুটি বসাতে হয় বোর্ডে। সেই কারণে গো-তে মাস্টার বা প্রভু হয়ে উঠতে জীবনের অর্ধেকেরও বেশি সময় পেরিয়ে যায়।

ভাবুন, আপনি জীবনের পথে এগিয়ে চলেছেন জীবনকে সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ করতে করতে, অথচ আপনারা সাহায্যকারী মানুষগুলো উদাস। ওরা আপনারই ওপর নির্ভরশীল। ওরা জানে, ওদের সমস্ত অধিকার সীমিত করে দেয়া হয়েছে আদিকাল থেকে। তাই গো-এর যিনি মহোত্তম খেলোয়াড় বা মাস্টার তার দূরদর্শিতার সঙ্গে অনায়াসে এক সাধক কিংবা ঋষির চেতনার তুলনা চলে, নয়ত এই পৃথিবীকে নিয়ন্ত্রণ করতে আরও প্রকাণ্ড হিংসা আর অসূয়ার প্রয়োজন হতো।

পাকিস্তানের গায়িকা নাজিয়া হাসানের `বাৎ বান যায়ে` গানটি রীতিমতো কয়েকবার শুনলাম উপন্যাসটি পড়তে পড়তে। আবার শীনকালন যখন পাকিস্তানের হাইওয়ে দিয়ে ট্রাক চালিয়ে নিয়ে যাচ্ছে আর শ্রেয়া ঘোষালের `জাদু হে নাশা হে` গানটি শুনতে শুনতে তার তখনকার অনুভূতির সাথে নিজের অনুভূতিকে একটু পরখ করে নিতে চাইছিলাম। কখনও আবার নিজের অজান্তেই হেসে উঠি যখন সৌরভ ঘটকের বান্ধবী তাকে বলে উঠে— ‘বাট আই ডিডনট লাইক হিজ হারপুন! হি হিজ এ গুড লাভার, বাট এ পুওর বয়ফ্রেন্ড।’ তখন ভাবি ইস্ আমাকেও যদি কেউ এরকমটি করেও বলতো!

কখনো কখনো স্যামুয়েল পিটার্সের মনে হয় সারা পৃথিবীর সমস্ত শহরগুলো যেন একই, কোনও ভিন্নতা যেন চোখে পড়ে না। আর এই অভিন্নতার মধ্যেও বৈচিত্র্য কোনও বৈপরীত্য বা বিরোধভাব খুঁজে বেড়াচ্ছে অচেতন মন।

লেখকের কলমে কাশ্মীরের বর্ণনা মুগ্ধ করে। সেই ১০০১ খ্রিস্টাব্দে গজনির সুলতান মাহমুদ খাইবার পাস পার হয়ে গান্ধার (পেশোয়ার) আক্রমণ করলেন, আর তার মধ্যবর্তী সময় পার করে ২০০৮ খ্রিস্টাব্দে মুম্বাই শহরের হোটেল-তাজ এবং পার্শ্ববর্তী বিভিন্ন প্রমোদাঞ্চলে লস্কর-এ-তইবা’র তরফে হানা— আমাদেরকে অনেক প্রশ্নের মুখোমুখি করে দেয়।

উপন্যাসের আরেক চরিত্র শামেমা যে উদ্বাস্তু হয়ে প্রথমে পাকিস্তান, তারপর ভারতের কাশ্মীরে বসবাস করছে। অথচ তার তো থাকা উচিত আফগানিস্তানে। কেউ কি চায় তার নিজের দেশ, ঘর-বাড়ি ছেড়ে অচেনা দেশে, অচেনা ভাষায় কথা বলতে! তাই সে যখন স্যামের দেখা পায় তখন তার হাতে নিজের আত্মাটুকু প্রদান করে। আর বলে— ‘আত্মা। আমার আত্মা। আপনি আফগানিস্তানে গেলে, নুরিস্তানে যাবেন নিশ্চয়ই। ওখানে খুব উঁচু একটা পাহাড় আছে, সারা বছর পাহাড়টা তুষারে শাদা হয়ে থাকে। লোকে ওকে ডাকে সপিন-ঘর বা শাদা পাহাড় বলে। আসলে ওর নাম নিঃশব্দ পাহাড়। কারণ ঐ পাহাড়ের কাছাকাছি গেলে মানুষ নীরব হয়ে যায়, নিজের সঙ্গে কথা বলতে শুরু করে। ঐ পাহাড়ের শরীরে মিলিয়ে যায় মানুষের আত্মা। মৃত্যুর পর মানুষকে কবর দেয়া হলে, তার আত্মাটা বেরিয়ে যায় কফিন থেকে, বেরিয়ে সে নিঃশব্দ পাহাড়ের শরীরে গিয়ে একদিন মিশে যায়। আমাদের গাঁয়ে কেউ মারা গেলে দেখতে পাবেন, পাহাড়ের গায়ের শাদা রঙ আরও শাদা, মানুষজন আরও নীরব। আমার পিতা, পিতামহ, প্রপিতামহ, সকলের আত্মা ঐ পাহাড়ের গায়ে মিশে রয়েছে। আমি চাই সাহিব, আমার আত্মাটিকে আপনি ঐ পাহাড়ের গায়ে ছেড়ে দিয়ে আসুন। আমি জানি, আমি কোনোদিনও দেশে ফিরতে পারব না। আপনি এই উপকারটুকু করবেন কি সাহিব? বলুন যাবেন তো নুরিস্তান?

উপন্যাসের মাধ্যমেই `গণতান্ত্রিক সমাজতান্ত্রিক আফগানিস্তান` যখন মধ্যযুগীয় হিংসাশ্রয়ী-রক্ষণশীলতার অনুগামী-তালিবান সরকার দায়িত্ব নিল, তখন সামাজিক পরিবর্তন প্রকটভাবে লক্ষ্য করা গেল। নিজের চোখেই যেন দেখলাম একজন `লস্কর-ই-তইবা`র সদস্য পাকিস্তানে ধাপে ধাপে কীভাবে প্রশিক্ষণ নিচ্ছে। ৫,৮৭,৭৮৫ শব্দের বাংলা ভাষার এই বৃহত্তম উপন্যাস `নিঃশব্দ পাহাড়`, যার প্রতিটি পাতা যখন এক এক করে পড়ে চলেছি, তখন আমি যেন এক বিরল মুগ্ধতা আর বিস্ময়ে অবাক হয়েছি। আসলে এই উপন্যাস যতটা না আশ্চর্যের তার থেকেও চমকপ্রদও।

‘জাগতিক মোহ আর তার সংশ্লিষ্ট লালিত্যকে উপেক্ষা করে মানুষ যখন জীবনের কাছে আরও বড়ো লালিত্য আর সুন্দরের প্রত্যাশা করে, তখন যদি তার সামনে এসে দাঁড়ায় `হিমালয়`, তবে সে আর কিছুতেই মুখ ফিরিয়ে নিতে পারবে না।’ —হ্যাঁ, এই উপন্যাস আমার কাছে হিমালয়েরই মতন। উপন্যাস তিনখণ্ডে সমাপ্ত। প্রথম ও দ্বিতীয় খণ্ড প্রকাশ পেয়েছিল ২০১৯ সালে। তারপর কোনও এক অজানা কারণে তৃতীয় খণ্ড আর প্রকাশ পায়নি। কিন্তু আমি এই উপন্যাসের তৃতীয় খণ্ডের পাণ্ডুলিপির কপি পড়তে পেরেছি বলে নিজেকে ধন্য মনে করছি। আশা রাখছি খুব তাড়াতাড়ি এই উপন্যাসের শেষ খণ্ড তথা পূর্ণাঙ্গ রূপে বইটি প্রকাশ পাবে কোনও এক সৎ এবং নির্ভীক প্রকাশকের হাত ধরে।

উপন্যাস: নিঃশব্দ পাহাড়। লেখক: শুভদীপ বড়ুয়া। প্রথম প্রকাশ: ফেব্রুয়ারি ২০১৯। প্রকাশক: একলব্য প্রকাশন, কলকাতা। মূল্য: দুইখণ্ড একত্রে ১২০০ টাকা

একুশে বইমেলা ২০১৮