শ্রেয়া চক্রবর্তীর খুদে গল্প ‘শেষ অনুরোধ’

প্রকাশিত : জুলাই ০৪, ২০২০

তিন মাস হলো জরায়ূতে ক্যানসার ধরা পড়েছে সুমনার। সে এখন হাসপাতালে ভর্তি। কেমোথেরাপি চলছে। পার্শ্ব প্রতিক্রিয়ায় মাথার সব চুল ঝরে গেছে। চলে গেছে চামড়ার জৌলুশ। পার্থ কোনোদিন কোনো অভাব রাখেনি সুমনার। প্রাপ্য বিষয় যদি হয় কেবল বস্তুকেন্দ্রিক, তবে তা সাধ্যমত দিয়েছে। তবু কিসের যেন এক অভাব থেকে গেছে সুমনার জীবনে, বিরাট এক শূন্যতা। মানুষ সুমনার প্রতি পার্থ কেমন যেন উদাসীন। সে কি তার স্বভাবসুলভ উদাসীনতা নাকি এটা বিশেষ করে সুমনার প্রতি? সুমনা মানুষ হিসেবে কি চায়, কেমন জীবন তার পছন্দ, ঘরটা কেমনভাবে সাজাতে সে ভালোবাসে, কোন্ ফুল তার প্রিয় ফুলদানিতে, কোন্ রঙের শাড়ি তাকে সবচেয়ে বেশি মানায়— এমন ছোট ছোট বিষয়গুলোর প্রতি পার্থর কোনোদিন কোনো আগ্রহ ছিল না। অথচ সে যে দায়িত্বজ্ঞানহীন, তা নয়। পরিবারের অন্য সদস্যদের প্রতি যথেষ্ট কেয়ারিং। কিন্তু এইসব ছোট ছোট ভালো লাগা মন্দ লাগার বাঁধন যা মানুষকে মানুষের সাথে জোড়ে, সেই বন্ধনটা কোনোদিন তৈরিই হয়নি যেন পার্থর সাথে সুমনার।

সুমনার মাঝে মাঝে মনে হতো, পার্থ আদৌ তাকে চেনে? জানে? বোঝে? পার্থর শরীর খারাপ হলে ওষুধগুলো মুখের কাছে এনে দিত সুমনা। অথচ সুমনার জ্বর হলে পার্থ খোঁজটুকু নিতেও ভুলে যেত। মাঝে মাঝে সুমনার মনে হতো, তবে পার্থ কি তাকে ভালোবাসে না! অথচ সুমনার ক্যানসার ধরা পড়ার পর কেমন বদলে গেছে পার্থ। হাসপাতালে রোজ আসে দেখা করতে। চোখে মুখে কেমন এক উৎকন্ঠা, বিষণ্ণতার ছাপ। কিছুক্ষণ সময় কাটায় সুমনার সাথে। মাথায় হাত রাখে। কোনো কোনোদিন সুমনার জন্য কিছু খাবার নিয়ে আসে। সাথে আনে গল্পের বই। পড়ে শোনায় সুমনাকে। সুমনার মনে হয়, সে যতদিন সুস্থ ছিল ততদিন এত আনন্দে ছিল না, যেমন এখন আছে। জীবনের অদ্ভুত সুন্দর সময়টা যেন তার কাটছে হাসপাতালে পার্থর সাথে।

একদিন পার্থ সুমনাকে বলে, তুমি সেরে উঠলে আমরা একসাথে বেড়াতে যাব কেমন? উত্তাল সমুদ্রে...

সুমনা হাসে। বলে, কিন্তু আমি তো পাহাড় ভালোবাসি। তুমি জানতে না?
পার্থর চোখ দুটো চিকচিক করে ওঠে। অন্য সময় পার্থ যতবার সমুদ্রে যেতে চেয়েছে, সুমনা তাতেই সায় দিয়েছে। সুমনা চাইতো, সে যেমন পার্থর না বলা কথাগুলোও বুঝে যায় পার্থও তারটা তেমন করে বুঝুক।

পার্থ সুমনার হাতে হাত রেখে বলে, বেশ, তাই হবে।
ঝরঝর করে কেঁদে ফেলে সুমনা। পার্থর কাধে মাথা রেখে বলে, আমার একটা অনুরোধ আছে।
কি, বলো।
আমি আর কেমো নিতে চাই না। তুমি আমাকে বাড়ি নিয়ে চলো। আমি ভালো আছি। আমি আর এরচেয়ে বেশি সুস্থ হতে চাই না। দোহাই তোমার।

একথা কেন বলছো তুমি? তোমাকে যে সুস্থ হতেই হবে।
আমি সুস্থ হয়ে গেলে তুমি আমাকে আর এত ভালোবাসবে? বলো? বাসবে?
পার্থ কোনো কথা বলে না। শুধু ওর ঠোঁট দুটো ছুঁয়ে রাখে সুমনার কপালে।