আবুল হোসেন ভট্টাচার্য

আবুল হোসেন ভট্টাচার্য

সত্যসন্ধানি আবুল হোসেন ভট্টাচার্য

সুমাইয়া মাসরুরা

প্রকাশিত : অক্টোবর ০৪, ২০২১

১৯১৬ সালে ফরিদপুর জেলার দাসের জঙ্গল গ্রামের ভট্টাচার্য পরিবারে জন্ম হয় এক ছোট্ট ছেলের। তিথি নক্ষত্র বিচার করে ছেলেটির নাম রাখা হয়, সুদর্শন ভট্টাচার্য।

সুদর্শনের বাপ-দাদারা ছিলেন খুবই নিষ্ঠাবান ব্রাহ্মণ। সেই সুবাদে ছেলেটি ছোট থেকেই অসংখ্য দেবদেবির সাথে পরিচিতি হয়েছিল। বাবা-ঠাকুরদার নামে বহু জায়গা থেকে চিঠিপত্র আসতো। প্রতিটি পত্রের শীর্ষে দেবদেবির নাম লেখা থাকত: শ্রীশ্রী কালী শরণম, শ্রী শ্রী দূর্গা সহায়, নারায়ণ শরণং, গনেশায় নম:, প্রজাপতি  শরণম, বাগদেবী শরণং, হরি সহায়, লক্ষ্মীমাতা শরণং, জয়মা সিদ্ধেশ্বরী, জয়মা জগদম্বা, হুংফট, ওঁ, ওম, শ্রীশঃ, শ্রীব, হং রিং ক্লিং ইত্যাদি।

একদিন হঠাৎ ছেলেটির শিশুমনে প্রশ্ন জাগল, আমি বড় হলে কার নাম লিখবো? এতসব দেবদেবির মধ্যে কে সবচে বড় এবং গ্রহণযোগ্য?
সবাই বড় এবং গ্রহণযোগ্য, ঠাকুরমার উত্তর।

সবাই যদি বড় এবং গ্রহণযোগ্য হয় তবে আমিতো সবাইকে বাদ দিয়ে একটি নামই লিখবো, এ অবস্থায় বাদ পড়া দেবদেবিরা রাগ করবেন না?
ছেলেমানুষের এত কথা ভালো নয়। মন দিয়ে লেখাপড়া কর। বড় হয়ে যখন শাস্ত্র পড়বি তখন সবই জানতে পারবি।

‘ছেলেমানুষ’ হলেও জবাবটা সুদর্শনের মনঃপুত হলো না। অগত্যা পাঠশালার পণ্ডিতমশাইকে জিজ্ঞেস করেই ফেললেন। পণ্ডিতমশাই ছিলেন সুদর্শনের জীবনে আসা প্রথম মুসলিম। তিনি যা জবাব দিলেন তার চুম্বকাংশ হচ্ছে, প্রভুর সংখ্যা বেশি হলে এমন মুশকিল হয়েই থাকে। তবে আমার মনে হয়, তোমাদের শাস্ত্রেও এমন একজন প্রভুর কথা লেখা রয়েছে যিনি সর্বশক্তিমান এবং সকলের চেয়ে বড়। বড় হয়ে যখন শাস্ত্র পড়বে তখন সেই সর্বশক্তিমানকে খুঁজতে চেষ্টা করবে।

অজ পাড়াগাঁয়ের দরিদ্র এবং অল্প শিক্ষিত সেই স্নেহশীল পণ্ডিত ছোট্ট সুদর্শনের অন্তরে আল্লাহর ইচ্ছায় তাওহিদের যে বীজ বপন করে দিয়েছিলেন, তা মহীরুহে পরিণত হতে খুব বেশি সময় লাগেনি। ব্রাহ্মণের ঔরসে জন্ম নেয়ায় একসময় সুদর্শন `দ্বিজত্ব` লাভ করেন এবং পূজা-অর্চনার অধিকার লাভ করেন। কঠিন কঠিন শ্লোক মুখস্থ করেন, আহার-বিহারে স্বাত্তিকতা বজায় রাখতে শুরু করেন। সেই সাথে সন্ধ্যা, আহ্নিক ও তর্পণ তো ছিলই। শাস্ত্র পড়ে হিন্দুধর্ম সম্পর্কে গভীর জ্ঞান অর্জন করতেও সময় লাগল না।

কিন্তু যতই পড়লেন, স্রষ্টা সম্পর্কে সঠিক জানার তিয়াস বাড়তো ছাড়া কমতো না। অগণিত দেবদেবির অসংখ্য কাহিনি, `লীলাখেলা` আর স্ববিরোধীতাগুলো পড়তে পড়তে তিনি হাঁপিয়ে উঠলেন। পিতৃপ্রদত্ত ধর্ম তাকে খুব বেশি দিন আটকে রাখতে পারলো না। সুদর্শন বেরিয়ে পড়লেন সত্যের সন্ধানে।

চার্চের পাদরির সাথে দেখা করলেন, বাইবেল পড়লেন। কথা হলো মুসলিম মাওলানাদের সাথে। প্রচলিত তিনটি ধর্ম নিয়ে বিস্তর পড়াশোনা শেষে সত্য সম্পর্কে তার আর কোনো দ্বিধা রইল না। পুরোহিত সুদর্শন ভট্টাচার্য হয়ে উঠলেন আবুল হোসেন ভট্টাচার্য।

আবুল হোসেন ভট্টাচার্য একটি ইতিহাস, একটি অনন্য উদ্যম আর প্রেরণার নাম। সত্যের মহিমান্বিত আহ্বানকে সবার কাছে পৌঁছে দিতে তিনি ছিলেন সদা সচেষ্ট। আল্লাহর ইচ্ছায় তার হাতে অসংখ্য মানুষ সত্যের দিশা পেয়েছে। তিনি শুধু সত্যের সন্ধান দিয়েই ক্ষান্ত থাকেননি, নওমুসলিমদের পুনর্বাসনের জন্যও অক্লান্ত পরিশ্রম করেছেন। একজন দরদি অভিভাবকের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছেন।

‘আমি কেন ইসলাম গ্রহণ করলাম’ বইটি তার ইসলাম গ্রহণের অনবদ্য কাহিনি। এটা শুধু জীবনী নয়, একটা দাওয়াতি বইও। হিন্দুধর্মের যে অংশগুলো তার মনে সংশয় সৃষ্টি করেছিল এবং যে যে জায়গায় আজও একত্ববাদের নিদর্শন ছড়িয়ে আছে সেগুলো তিনি একত্র করার চেষ্টা করেছেন। কোনো সত্যান্বেষী হিন্দু ভাইবোন বইটা পড়লে তার ভেতর পরিবর্তন আসবে, আশা করা যায়।