সরকার আবদুল মান্নানের গদ্য ‘রঙের শৈশব, শৈশবের রং’

প্রকাশিত : মার্চ ০৬, ২০২৪

ভাবের রং আছে কিনা, জানি না। তবে অনেকে বলেন, ভাবেরও রং আছে। যেমন তারুণ্যের রং সবুজ, বেদনার রং নীল, বিপ্লবের রং লাল, হতাশা ও নৈরাশ্যের রং হলুদ, বিমর্ষতার রং ধূসর ইত্যাদি। রঙের এইসব প্রতীক নানা সময়, নানা দেশে নানান রকম। নিশ্চয়ই এসব রং মানুষ দিয়েছে। তা না হলে ভাবের কোনো রং থাকার কথা নয়। কারণ, রঙের সঙ্গে আলোর সম্পর্ক, রঙের সঙ্গে দেখার সম্পর্ক। ভাব দেখা যায় না। ভাব থাকে মাথার ভেতরে। অনেকে বলেন মনে, হৃদয়ে। মাথায়, মনে বা হৃদয়ে আলো যেতে পারে না। তা হলে আলোকিত মানুষের কী হবে? ভেতরে আলো যেতে না পারলে আলোকিত মানুষ হওয়া যাবে কী করে? আসলে এটা প্রতীকী ব্যবহার। যে আলো দিয়ে দেখা যায়, যে আলোতে রং হয়, সে আলো মানুষের দেহের ভেতরে বা মনের ভেতরে প্রবেশ করে না। সুতরাং যেখানে আলো নেই, সেখানে রং নেই। তা হলে ভাবে রং মাখালো কে? আমার মনে হয়, ভাবে রং মাখিয়েছেন ভাবুকগণ, কবিগণ।

কিন্তু বস্তু আছে, রং নেই, এমন কি হয়? হয় না। বস্তুর গায়ে রং থাকে, প্রাণীর গায়ে রং থাকে, উদ্ভিদের গায়ে রং থাকে। শুধু যে গায়ের উপরে থাকে, তা নয়, ভেতরেও থাকে। কত রকমের রং যে দেহের ভেতরে বিরাজ করে, তার ইয়ত্তা নেই। আলো যেতে পারল না, কিন্তু রং তো ঠিকই হলো। তার মানে যেখানে আলো নেই, সেখানে রং নেই, এ কথা ঠিক নয়। কিন্তু সেটাও কোনো সমস্য নয়, ভেতরে-বাইরে রং হোক। পৃথিবীর সব মানুষ, সব প্রাণী, সব উদ্ভিদ, সব বস্তু আর ভাব রঙিন হয়ে উঠুক, তাতে কোনো সমস্যা নেই। সমস্যাটা অন্য জায়গায়। এক আলো থেকে এত রং হয় কী করে! আলো থেকে হয় কি না, তা তো জানতাম না, ছোটবেলায় এই তত্ত্ব জানার কথাও নয়। কিন্তু জানতে হবে।

সে সময় আমাদের পৃথিবী খুব নতুন ছিল। প্রজাপতিটা ওড়ে। ওটা নতুন। পিঁপড়া দলবেধেঁ কোথায় যায়! ওটাও নতুন। সেই নতুন পৃথিবীতে আমাদের আনন্দ আর কৌতূহলে ত্যাক্ত-বিরক্ত হয়ে উঠতেন বড়রা। বড়রা ছিল বাজে লোক। কিছুতেই তাদের কোনো কৌতূহল ছিল না, আনন্দ ছিল না। সারাক্ষণ রাগারাগি, ফাতাফাতি। তো আমরা কী করব? আমরা তো তখন চিৎ হয়ে শুয়ে, পা আকাশের দিকে ছুড়ে ছুড়ে, আঙ্গুল চোষার বয়স পেরিয়ে এসেছি। হুট করেই আমাদের কাজ বেড়ে গেল। এত বড় একটা পৃথিবীর সবকিছু জানার কাজ। সবকিছু জানতে হবে। কিন্তু বেশি সময় নেই। কেন বেশি সময় নেই, সেটা জানতাম না। আপনাদের নিশ্চয়ই মনে আছে, “পাতা নড়লে বাতাস আসে, নাকি বাতাস এলে পাতা নড়ে” এই সমস্যার সমাধান কী করে হয়েছিল কিংবা “ঢাকার গাছ সাদা কেন” এই বাক্যে ‘ঢাকা’ এর স্থলে ‘ঢাকার’ হওয়াতে, মানে একটি অতিরিক্ত ‘র’ কী ধরনের বিপর্যয় তৈরি করেছিল।

ওই সমস্যাগুলো আমাদের জীবনে বিপর্যয় নিয়ে এসেছিল। কিন্তু তার জন্য চড়চাপড় খেয়েছি। বাঁশের কঞ্চি আর গাছের ডালা পিষ্ঠদেশে নিপতিত হয়েছে। কিন্তু সেটা কোনো বিষয় ছিল না। বড়দের ওই বাজে ব্যবহারে আমাদে তেমন কিছু যেত-আসতো না। ধরেই নিয়েছিলাম, বড়রা এরকমই, ফালতু। তবে সমস্যাগুলোর সমাধান পেয়ে গিয়েছিলাম। এমনকি, শব্দ কীসের ভেতর দিয়ে দ্রুত চলে, লোহায় কেন জং ধরে, এমন সব জটিল সমস্যার সমাধানও বড়দের কাছ থেকে পেয়ে গিয়েছিলাম। কিন্তু রঙ্গের বিষয়টা আজও সমাধান হলো না।

দিগন্ত প্রসারিত সরষে খেত। সেই সরষে খেতের উপর দিয়ে হলুদের ঢেউ বয়ে যাচ্ছে। ওই ঢেউয়ের তলায় সবুজ পাতাদের দেখা যায়। ওরা হলুদ ঢেউয়ে আনন্দে ভাসে আর ডোবে এবং ডোবে আর ভাসে। এক নদী হলুদের মধ্যে, সবুজের এই লাজুক উন্মোচন যখন নানা দিকে আলোর বিচ্ছুরণ ঘটিয়ে যাচ্ছিল, তখন গফুর বলল, দেখ দেখ ক্যামন অইলদা! সব অইলদা অইয়া গেছে। আমি বললাম, ভিত্তে ভিত্তে সবুজ আছে। অইলদা আর সবুজ। সোন্দর। শিশিরের জলে পা ভিজে গেছে। ভেজা মাটি আর ঘাস লেগে লেগে পায়ের তলা ভারি হয়ে উঠছে। তখন প্রকৃতির এই সুন্দর আমাদের শিশুমনে রং ছড়িয়ে দেয়। সুতরাং বিষয়টি এখানে শেষ হতে পারত। কিন্তু হলো না।

গফুর বলল, কত রং, কত রং! এত রং অয় ক্যামনে? এক গাছে হলুদ আর সবুজ! ক্যামনে অয়? গফুর জানে, এই প্রশ্নের কোনো উত্তর আমার কাছে নেই। ও আর আমি একই গোয়ালের গোরু। সুতরাং প্রশ্ন আমাকে করেনি গফুর। বিস্ময়ের সঙ্গে ও শুধু স্বগতোক্তি করেছে। কিন্তু স্বগতোক্তির মধ্যেই তো হারিয়ে যেতে দেওয়া যায় না জিজ্ঞাসা। বললাম, তাই তো। হঠাৎ করে রঙের এক জগৎ উন্মোচিত হয়ে গেল আমাদের কাছে। দেখি চারদিকে, ডানে-বাঁয়ে, উপরে-নিচে সর্বত্র শুধু রং আর রং। এত রং! মনে হলো রঙের এক দুনিয়ার মধ্যে আমরা ডুবে আছি। এবং আমরা নিজেরাও হাজারটা রং। গফুর বলল, দেখ আমাগো চুল, চামরা, চৌখ, নৌখ সবকিছুর রং ক্যামন আলাদা! ও আমার সামনে হাতের কব্জি প্রসারিত করে ধরে। আমিও আমার হাতের কব্জি প্রসারিত করি। চারটি কব্জি চিৎ করে, উপুর করে, কাত করে নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ করি। নোখের রং আলাদা। নোখের বারতিটুকুর রং আলাদা। নোখের গোড়ায় চামরার রং আলাদা। শরীরের চামরার রং আলাদা। ওর গায়ের রং আর আমার গায়ের রং আলাদা।

এসব রঙের কী নাম, জানি না। কিন্তু সব আলাদা। আমরা মাটির দিকে তাকাই, জলের দিকে তাকাই, গাছের দিকে তাকাই, লতার দিকে তাকাই, পাতা আর ফুলের দিকে তাকাই। পাখি দেখি, প্রজাপতি দেখি, গোরু দেখি, ছাগল দেখি, হাস-মুরগি দেখি। আমাদের মাথায় আর ধরে না। সব কিছুর রং আলাদা, সব আলাদা। পরে আবিষ্কার করি, আমরা যেসব ফল খাই, তার বাইরের রং এক রকম, আর ভেতরের রং আরেক রকম। আমরা এও পর্যবেক্ষণ করি, গাছের গোড়ার রং এক রকম, শাখা-প্রশাখার রং আরেক রকম; ফুলের রং এক রকম, ফলের রং আরেক রকম। এ সবের আবর রং বদলায়। কত যে বদলায়, তার ইয়ত্তা নেই। গফুর বলে, গাছের ভিত্তে দিয়া এত রং যায় ক্যামনে? আমরা পরীক্ষা করে দেখলাম। পাতা ছিড়লাম। ছেড়া বোঁটায় সবুজ রং নেই। পানির মতো সামান্য কস। সরষে গাছ ভাঙলাম। ভেতরে হলুদ রং নেই। কচুরি ফুলের ডগা ছিড়লাম। কোনো রং নেই। শুধু পানির মতো সামান্য রস। তা হলে রং আসে কোথা থেকে?

কয়েক দিন বড় ভাই-বোনদের খুব জালাতন করলাম। তাদের হাতে চড়চাপড়ও খেলাম। কিন্তু কাজের কাজ কিছু হয়নি। কেউ বলতে পারেনি, কী করে রং হয়। শেষপর্যন্তু ছোট কাকুর স্মরণাপন্ন হলাম। প্রশ্ন শুনে তিনি মোটামুটি ঘাবড়ে গেলেন। বললেন, কঠিন। তার পরেও তিনি দমবার পাত্র নন। বললেন, রং না থাকলে কি কোনো কিছু সোন্দর লাগে? লাগে না।

লেখক: শিক্ষাবিদ ও সাহিত্যিক