সরকার আবদুল মান্নানের প্রবন্ধ ‘সাংস্কৃতিক সাক্ষরতা’

প্রকাশিত : সেপ্টেম্বর ০৮, ২০২২

সাক্ষর, সাক্ষরতা, literacy এইসব অভিধার সঙ্গে আমরা পরিচিত। কেউ যখন কোনো ভাষার বর্ণ চিনতে পারে, উচ্চারণ করতে পারে এবং লিখতে পারে তখন তাকে আমরা বলি সাক্ষর; অর্থাৎ অক্ষরজ্ঞানসম্পন্ন মানুষ, পড়তে পারে, লিখতে পারে। বাংলা একাডেমি থেকে প্রকাশিত ব্যবহরিক বাংলা অভিধানে সাক্ষরদের বলা হয়েছে, অল্পশিক্ষিত; শিক্ষাপ্রাপ্ত; literate। অর্থাৎ প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা তাদের তেমন নেই।

প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা যত অল্পই থাকুক না কেন, একজন সাক্ষর মানুষের জীবনে যে ঘটনাটি ঘটে তা নিঃসন্দেহেই পৃথিবীর সবচেয়ে তাৎপর্যপূর্ণ ঘটনা; আর তা হলো, ব্যক্তি যে-ভাষার মানুষ ওই ভাষার জ্ঞানের জগৎ তার সামনে উন্মোচিত হয়ে পড়ে। কারণ সে পড়তে শিখেছে এবং লিখতে শিখেছে। পড়তে পারা মানে যুগে যুগে অসংখ্য ভাবুকের ভাবনার বিচিত্র ঐশ্বর্য তিলে তিলে সঞ্চিত হতে হতে জ্ঞানের যে বিপুল ভণ্ডার রচিত হয়েছে, সে ওই জ্ঞানভাণ্ডারের সঙ্গে পরিচিত হতে পারে এবং নতুন জ্ঞান সংযুক্ত করতে পারে। একজন মানুষের জন্য এর চেয়ে বড় সৌভাগ্যের বিষয় আর কিছু হতে পারে না। কিন্তু সকল সাক্ষর মানুষ যে এই সৌভাগ্যের তাৎপর্য অনুধাবন করতে পারে, তা নয়। অধিকন্তু বলা যায়, শুধু অল্প শিক্ষিত সাক্ষর মানুষই নয়, প্রাতিষ্ঠানিক সর্বোচ্চ শিক্ষায় শিক্ষিত অধিকাংশ মানুষও ওই সৌভাগ্যের সুযোগ গ্রহণ করে না। জ্ঞানকাণ্ডের বিচিত্র শাখা-প্রশাখার সঙ্গে পরিচিত হয়ে নিজেকে সমৃদ্ধ ও আলোকিত করে তোলার পরিবর্তে তারা কূপমণ্ডুকতার মধ্যে বসবাস করে এবং এক জীবন এভাবেই কাটিয়ে দেয়। এমনকি কোনোদিন তারা বুঝতেও পারে না যে, অফুরন্ত ঐশ্বর্যের ভাণ্ডরে অবগাহন করার সৌভাগ্য লাভ করা সত্ত্বেও তারা সেই সুযোগ গ্রহণ করেনি।
একটি মানবিক পরিবার, একটি মানবিক সমাজ, একটি মানবিক রাষ্ট্র এবং একটি মানবিক পৃথিবী গঠনে তাদের যে ভূমিকা রাখার দায় ছিল, মানুষ হিসেবে সেই দায়িত্ব তারা পালন করতে পারল না এই জন্য যে, ওই জীবনের আনন্দ ও ঐশ্বর্যের আস্বাদ লাভ করার শক্তি তাদের মধ্যে তৈরি হওয়ার রসদ ছিল না। অর এখানেই আমাদের প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার সীমাবদ্ধতা।

নির্দিষ্ট কাউকে বা কিছুকে এর জন্য দায়ী করা যায় না। বরং প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার যে কাঠামোর মধ্যে শিশু-কিশোররা বেড়ে ওঠে, সেই কাঠামোয় তাদের ওই শিক্ষা দেওয়ার কোনো সুযোগ নেই যে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা হলো শেখার বিচিত্র উপায়ের সঙ্গে পরিচিত হওয়া এবং জীবনভর শিক্ষার যে পথ সামনে পড়ে থাকে, শিক্ষার সেই পথঘাটে স্বস্বচ্ছন্দে বিচরণ করতে শেখা। অধিকন্তু আমাদের দেশে ব্রিটিশদের শাসনামলে গুণগত শিক্ষার যে গুরুত্ব ছিল, সমাজে শিক্ষিত মানুষের যে কদর ছিল, শিক্ষকদের যে মর্যাদা সমাজে প্রতিষ্ঠিত ছিল, পাকিস্তানি শাসনামলে তার মারাত্মক অবনমন ঘটে এবং স্বাধীন বাংলাদেশে ক্রমেই তা তলানিতে গিয়ে ঠেকে। এই সময় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে শিক্ষকদের রাজনীতি বেড়েছে; সামাজের বিচিত্র দ্বন্দ্ব-সংঘাত ও হানাহানির সঙ্গে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো অনেক বেশি সম্পৃক্ত হয়ে পড়েছে; স্থানীয় রাজনীতি ও জাতীয় রাজনীতির প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ প্রভাবে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে অস্থিরতা বেড়েছে; শিক্ষকদের প্রতি শিক্ষার্থী, অভিভাবক ও অন্যান্য অংশীজনদের আস্থা কমেছে; রাজনীতি, স্বার্থ, শিক্ষদের অশিক্ষকসুলভ আচরণ ও শিক্ষার্থীদের অসৌজন্যমূলক ও অশ্রদ্ধেয় আচরণের প্রেক্ষিতে শিক্ষক-শিক্ষার্থীর সম্পর্কের মারাত্মক অবনতি হয়েছে। অনেক ক্ষেত্রে ম্যানেজিং কমিটি ও গর্ভানিং বডির সদস্যদের সঙ্গে শিক্ষকদের তিক্ত সম্পর্কের প্রভাব পড়ছে শিক্ষার্থীদের উপর, শিক্ষার উপর। এবং শিক্ষকদের সঙ্গে প্রশাসনের সম্পর্কের অবনতি হয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে কেন্দ্র করে গবেষণার ভেতর দিয়ে নতুন জ্ঞান সৃষ্টির যে প্রত্যয় ছিল তারও কোনো বিকাশ লক্ষ করা যায়নি। এছাড়া বহুত্ববাদের বিকাশ ও ঐক্য এবং গণতন্ত্রের চর্চার ভেতর দিয়ে রাষ্ট্র পরিচালনায় দক্ষ নাগরিক হয়ে ওঠার প্লাটফর্ম হওয়ার কথা ছিল বিশ্ববিদ্যালয়গুলো; তাও হয়নি। অধিকন্তু সামরিক শাসকরা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোকে ছাত্ররাজনীতি, ক্ষমতা ও অবৈধভাবে অর্থ উপার্জনের অভয়ারণ্য করে তোলে। এর ফলে এক সময় বিশ্ববিদ্যালয়গুলো রণক্ষেত্রে পরিণত হওয়ার দুঃসময় অতিক্রম করতে হয়েছে আমাদের। অথচ কুদরা-এ-খুদা শিক্ষা কমিশনের রিপোর্টের মধ্যে আলোকিত নাগরিক তৈরি করার বিস্তৃত নির্দেশনা ছিল এবং শেখ মুজিবুর রহমান শিক্ষিত, দক্ষ, সংবেদশীল, অসাম্প্রদায়িক, গণতন্ত্রী, দেশপ্রেমিক, সৌন্দর্যপ্রিয় ও মানবিক প্রজন্ম তৈরি করতে চেয়েছিলেন। কিন্তু তা আর হয়নি। বরং ওই স্বপ্নের সম্পূর্ণ উলটো একটি প্রতিক্রিয়াশীল জনগোষ্ঠী তৈরি করার জন্য যত রকমের চেষ্টা করা যায় তাই করা হয়েছে। এই সামগ্রিক পরিস্থিতি শিখন-শেখানো কার্যক্রমে মারাত্মক প্রভাব ফেলেছে।

এক যুগে পরিমাণগত শিক্ষার অশ্চর্য অগ্রগতি সাধিত হয়েছে। বলা যায়, কোথাও কোথাও প্রয়োজনের চেয়ে বেশি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান স্থাপিত হয়েছে। শিক্ষকদের সুযোগ-সুবিধা বেড়েছে। অধিকাংশ শিশু স্কুলমুখী হয়েছে। শিশুদের কোলাহলে স্কুলগুলো মুখর হয়ে ওঠেছে। বিশেষ করে নারীশিক্ষার ক্ষেত্রে যে অগ্রগতি সাধিত হয়েছে তার কোনো তুলনা চলে না। এর ফলে পরিমাণগত শিক্ষা আশানুরূপ বেড়েছে; অর্থনৈতিক কর্মযজ্ঞের দৃশ্যগ্রাহ্য বিকাশ সাধিত হয়েছে এবং প্রতিষ্ঠার জন্য প্রাণান্তকর প্রতযোগিতা প্রবল আকার ধারণ করেছে। কিন্তু এই অগ্রগতিতে মানবীয় আখ্যান রচিত হওয়ার খুব বেশি সুযোগ সৃষ্টি হয়নি।

তারপরেও অসাধারণ কিছু পরিবার, কছু শিক্ষক নানারকম প্রতিকূল পরিস্থিতিতে সন্তান-সন্ততিদের জন্য, শিক্ষার্থীদের জন্য ভালোবাসা ও মমত্বের প্রদীপ জ্বালিয়ে রাখেন সর্বক্ষণ এবং সেখান থেকে আলো নিয়ে এগিয়ে যায় কিছু সন্তান-সন্ততি, কিছু শিক্ষার্থী। এইভাবে মানবীয় আকাঙ্ক্ষার তৃষ্ণা বেঁচে থাকে ব্যক্তিজীবনে, পরিবারে, সমাজে, প্রতিষ্ঠানে ও রাষ্ট্রে। এই মানবীয় আকাক্সক্ষার একটি অতীব গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায় হতে পারে সাংস্কৃতিক সাক্ষরতা।

দুই.
প্রশ্ন ওঠে সাংস্কৃতিক সাক্ষরতা কী এবং সাক্ষর মানুষ কী করে সাংস্কৃতিক সাক্ষরতা অর্জন করে মানবীয় গুণে গুণান্বিত হয়ে উঠতে পারে? সাংস্কৃতিক সাক্ষরতার বিষয়টি নতুন কোনো প্রতিপাদ্য নয়। বিচিত্র ধর্ম বর্ণ শ্রেণি পেশা জাতি উপজাতি ও ভিন্ন ভাষাভাষী মানুষের সংস্কৃতিকে সম্মান করার ঐতিহ্য আমাদের দেশে নতুন কোনো বিষয় নয় নিশ্চয়ই। বহুদিন ধরে আমাদের এই দেশে যে অসাম্প্রদায়িক জীবনাচরণ সর্বত্র বিরাজমান ছিল, সেখানে বিদ্যমান ছিল সংস্কৃতিগত ভিন্নতাকে শ্রদ্ধা করার একটি সহজাত জাতিগত সংস্কৃতি। ধর্মের ভিন্নতা, জাতপাত ও বংশ-পদবির ভিন্নতা, পেশাগত ভিন্নতা, লৈঙ্গিক ভিন্নতা ইত্যাকার নানারকম ভিন্নতা তখন ছিল। এইসব ভিন্নতাকে আশ্রয় করে সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে তখনো উঁচু-নিচু, সম্মান-অসম্মান, গ্রাহ্য-অগ্রহ্য এবং প্রাধিকার ও বঞ্চনার বিষয় প্রবলভাবেই ছিল। কুসংস্কার, কুসংস্কৃতি, অপসংস্কৃতি, টেবু তখনো ছিল এবং কমবেশি এখনো আছে। এবং এ সবেরও একটি সামাজিক প্রভাব নানাভাবে ক্রিয়াশিল ছিল। কিন্তু এইসব ভিন্নতা ও বিশ্বাসকে কেন্দ্র করে তখন যুদ্ধংদেহি মনোভাব তৈরি হওয়ার সুযোগ ছিল না এবং প্রতিনিয়ত সামাজিক অশান্তি তৈরি হতো না। বিশেষ করে খুব স্থিতিশীল ও মন্থর গতিতে এগিয়ে চলা সমাজে এইসব ভিন্নতা জটিল কোনো রূপে আর্বিভূত হওয়ার সুযোগ ছিল না। ফলে প্রাতিষ্ঠানিকভাবে সাংস্কৃতিক সাক্ষরতা তত্ত্ব হিসেবে পরিচিত না থাকলেও সমাজের ভেতরগত একটি প্রবণতা হিসেবে সর্বত্রই বিদ্যমান ছিল।

কিন্তু একবিংশ শতকে এসে বিষয়টি যখন কোনো কোনো দেশে অধ্যয়নের একটি নতুন জ্ঞানকাণ্ড হিসেবে আবির্ভূত হয় এবং শিক্ষার্থীদের পাঠ্যতালিকার অন্তর্ভুক্ত করার মতো একটি সুশৃঙ্খল অধ্যায় হিসেবে গ্রাহ্য হয় তখন সংস্কৃতিগত ভিন্নতাকে শ্রদ্ধা প্রদর্শনের প্রথাগত প্রবণতার বাইরেও সাংস্কৃতিক সাক্ষরতা আলাদা একটি জ্ঞানকা- হিসেবে অনিবার্য হয়ে ওঠে। বিশেষ করে গ্লোবালাইজেশনের এই যুগে যখন ক্রমেই হারিয়ে যাচ্ছে ভাষা ও সংস্কৃতিগত সীমানার গণ্ডি তখন সাংস্কৃতিক সাক্ষরতা একটি অতীব গুরুত্বপূর্ণ জীবনোপাত্ত হিসেবে আর্বভূত হওয়াই স্বাভাবিক। অভিবাসনের দেশ আমেরিকা। হিসাব বর্হিভূত অসংখ্য দেশ ছাড়াও গুরুত্বপূর্ণ ৭৬টি দেশের মানুষ বসবাস করে এই দেশে। সুতরাং এ ধরনের বহু সংস্কৃতি ও ধর্মের দেশে সাংস্কৃতিক সাক্ষরতার বিষয়টি অন্য যে কোনো দেশের চেয়ে অনেক বেশি তাৎপর্যপূর্ণ।

E. D. Hirsch, Jr. The New Dictionary of Cultural Literacy গ্রন্থের মুখবন্ধে বলেছেন:
American patriotism is built of shared knowledge, attitudes, loyalties, and values, including the values of nonexclusion, toleration, and respect for other religions and cultures. Americans have proved that it is possible to feel patriotic about a cosmopolitan, diverse country, which is loved more for its vital diversity than for its racial or ethnic purity. That was Walt Whitman’s patriotism, and Herman Melville’s. For most of our history, the United States has imagined itself as a patriotic rather than as a nationalist state. [Houghton Mifflin Company, 2002]

এ হলো সাংস্কৃতিক সাক্ষরতার মূল প্রতিপাদ্য। অন্যের সংস্কৃতি সম্পর্কে জ্ঞানার্জন এবং ব্যবহারিক জীবনে ওই ‘অপর’ সংস্কৃতিকে শ্রদ্ধা করার মানসিকতাই হলো সাংস্কৃতিক সাক্ষরতা। উদাহরণ দিই। সনাতন ধর্মাবলম্বী বিবাহিত নারীরা কপালে সিঁদুর পরে। কিন্তু ইসলাম ধর্মাবলম্বী একজন মুসলমান নারী সিঁদুর পরে না। সুতরাং স্পষ্টতই যে ধর্মভিত্তিক সংস্কৃতির ভিন্নতার বিপুল একজগৎ আছে। বিশ্বাসের উপর ভিত্তি করে এই যে ভিন্নতার জগৎ তৈরি হয়েছে সে সম্পর্কে স্পষ্টা ধারণা না থাকলে ভুল বোঝাবুঝির আশঙ্কা থেকে যায়। একজন গর্ভবতী মুসলিম নারী রাস্তা দিয়ে হেঁটে যাওয়ার সময় সনাতন ধর্মাবলম্বী কেউ যদি সিঁদুরহীন নারীকে গর্ভবতী দেখে খারাপ কথা বলে তা হলে সামাজিক শৃঙ্খলা নষ্ট হয়, শান্তিপূর্ণ সহবস্থান বিঘ্নিত হয়। তেমনিভাবে সিক ধর্মাবলম্বী পুরুষগণ ভরাট শ্মশ্রুমণ্ডিত হয়ে মাথায় পাগড়ি ধারণ করে। তাদেরকে মুসলিম মৌলবাদী ও জঙ্গিবাদী মনে করে আক্রমণ করা হয়েছে আমেরিকায়। তেমনিভাবে মুসলিম নারীদের কেউ কেউ হিজাব পরিদান করে এবং পুরুষরা শ্মশ্রুম-িত হয়ে মাথায় টুপি ও পরনে লম্বা পাজামি ধারণ করে। এমন কাউকে দেখে যদি অশ্রদ্ধা প্রদর্শন করা হয় এবং এমন কি হেনস্তা করা হয় তা হলে সামাজিক সহবস্থান ও শান্তি বিঘ্নিত হবে।

সংস্কৃতির দিক থেকে সবচেয়ে বড় ভিন্নতা দেখা দেয় সাধারণত ধর্মকে কেন্দ্র করে। কিন্তু আরও নানা রকম ভিন্নতা আছে। ওইসব ভিন্নতার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো লৈঙ্গিক ভিন্নতা, ভাষাগত ভিন্নতা, জাতিগত ভিন্নতা, পেশাগত ভিন্নতা, পরিবেশ ও আবহাওয়াগত ভিন্নতা, দৈহিক গড়ন ও বর্ণগত ভিন্নতা, যৌনাচরণগত ভিন্নতা, মতাদর্শগত ভিন্নতা ইত্যাদি। এইসব ভিন্নতার বাইরে অছে ব্যক্তিতে ব্যক্তিতে ভিন্নতা ও স্বতন্ত্র্যের বিপুল এক জগৎ। এই ভিন্নতাকে আশ্রয় করে মানুষে মানুষে পোষাক-পরিচ্ছদ, খাদ্যাভ্যাস ও জীবনাচরণগত নানারক ভিন্নতা তৈরি হয়। বিশেষ করে বিচিত্র ধর্ম, ভাষা ও সংস্কৃতির মানুষ যেসব দেশে বিপুল পরিমাণে বসবাস করে সে সব দেশে এই বৈচিত্র্য সব চেয়ে বেশি দৃশ্যমান। যেমন আমেরিকা, কানাডা ও ইউরোপের দেশগুলোর কথা উল্লেখ করা যায়। ভারতের মতো বহু ভাষা, ধর্ম ও সংস্কৃতির দেশেও এই বৈচিত্র্য তাৎপর্যপূর্ণ। এই বৈচিত্র্যের মধ্যে ঐক্য সাধিত হয় কীভাবে? কীভাবে একটি শান্তিপূর্ণ সহবস্থানের পরিবেশ তৈরি হয়? কিংবা অশান্তির পরিবেশ যখন সৃষ্টি হয় তখন তার পেছনে কী কী কারণ নহিত থাকে?

বহু বৈচিত্র্যের মধ্যে ঐক্য সাধিত হয় মূলত সাংস্কৃতিক জ্ঞান ও তার সুষ্ঠু ব্যবহারের মাধ্যমে। অর্থাৎ প্রতিটি ভিন্নতার পটভূমি আছে, তাৎপর্য আছে, মাহাত্ম্য আছে এবং শ্রদ্ধা করার মতো সৌন্দর্য আছে। নাগরিকদের মধ্যে এই জ্ঞানের যুথবদ্ধতা তাদেরকে ঐক্যের সংহতি দান করে। আমাদের দেশে নান ধর্মাবলম্বী মানুষ বসবাস করেন। তাদের ধর্মীয় অনুষ্ঠানাদি অছে এবং ধর্মকে কেন্দ্র করে তাদের কিছু খাদ্যাভ্যাস থেকে শুরু করে জীবনাচরণে ভিন্নতা আছে। আমরা যদি স্কুলের শিক্ষাক্রমের ভেতর দিয়ে এই জ্ঞানের সঙ্গে পরিচিত হতে পারি এবং এই ভিন্নতাকে সম্মান ও শ্রদ্ধা করার পাঠ যদি সেই স্কুল জীবন থেকেই আমাদের দেওয়া হয় তা হলে শান্তিপূর্ণ সহবস্থানের শক্তি তৈরি হবে। বিপরীতক্রমে এই জ্ঞানের অভাবে আমাদের মধ্যে অহমিকা ও অজ্ঞতা তৈরি হয় এবং আমরা ভিন্নতাকে বৈরী জ্ঞান করি। ফলে সংঘাত অনিবার্য হয়ে ওঠে।

তিন.
জাতীয়তাবাদ ও দেশপ্রেমের ধারণা নিয়ে অনেকদিন ধরে কথা হচ্ছে। রীন্দ্রনাথ ঠাকুর জাতীয়তাবাদকে সুদূরপ্রসারি কোনো মঙ্গলজনক অভিধা হিসেবে গ্রহণ করেননি। কারণ এর পরিণতি সম্পর্কে তিনি ভালোভাবেই অবহিত ছিলেন। হিটলার ও মুসোলিনির জাতীয়তাবাদ তিনি দেখেছেন। উগ্র জাতীয়তাবাদ কতটা ভয়াবহ হয়ে উঠতে পারে, সমগ্র বিশ্ব তার পরিণতি দেখেছে। তাই তিনি এক জাতিসত্তার সঙ্গে আরেক জাতিসত্তার অস্তিত্বের বহুমাত্রিক রূপ দেখতে চেয়েছেন এবং একটি সহজ যোগসূত্র স্থাপনের চেষ্টা করেছেন। গোরা, ঘরে বাইরে, চার অধ্যায় প্রভৃতি উপন্যাসে এবং তাঁর অসংখ্য প্রবন্ধে তাঁর এই ভাবনার পরিচয় বিধৃত হয়েছে। দেশপ্রেমের সঙ্গে সঙ্গে তিনি সর্বমানবীয় সংহতির আকাঙ্ক্ষা ব্যক্ত করেছেন সর্বত্র। একবিংশ শতকে এসে সেই ভাবনাকে কেন্দ্র করে তৈরি হয়েছে নতুন এক জ্ঞানকাণ্ড যার নাম সাংস্কৃতিক সাক্ষরতা।

এ মতাদর্শের প্রবক্তা E. D. Hirsch, Jr. The New Dictionary of Cultural Literacy গ্রন্থের মুখবন্ধে বলেছেন: Artificial distinctions of class and caste would be erased, and patriotic feelings would grow. The love of country— patriotism— is a very different sentiment from nationalism. A fine book by Benedict Anderson, Imagined Communities, beautifully distinguishes between nationalist and patriotic sentiments. Nationalism is an aggrandizing, tribalistic sentiment that defines one’s own group as opposed to alien groups, which are seen as potential rivals or enemies to be overcome or excluded. Patriotism, by contrast, implies love of country without necessarily implying hostility to anybody else. [Houghton Mifflin Company, 2002]

এই জ্ঞান মানুষের মধ্যে একদিকে দেশপ্রেম তৈরি করে এবং অন্যদিকে তাকে মানবতাবাদী মানুষ হিসেবে বিশ্বপ্রেমে উদ্বুদ্ধ করে। দেশপ্রেম ও মানবতাবাদ দৈশিক ও বৈশ্বিক পটভূমিতে মানুষের মধ্যে এই প্রতীতির জন্ম দেয় যে, দেশের এবং বিশ্বের যে কোনো প্রান্তের যে কোনো মানুষের শরীর থেকে এক ফোঁটা রক্ত ঝরলে তার কষ্ট ও দায় থেকে কেউই মুক্ত থাকতে পারে না। দেশ, ভাষা, জাতি, ধর্ম, বর্ণ, পেশা নির্বিশেষে এই বোধ কীভাবে মানুষের মধ্যে জাগ্রত করা যায়? কীভাবে মানুষের মধ্যে এই প্রত্যয় ও প্রতীজ্ঞার জন্ম দেওয়া যায় যে, মানুষের বিচিত্র পরিচয় থাকবে এবং এক সময় সেইসব পরিচয়কে অতিক্রম করে তার ‘মানুষ’ পরিচয়টিই মুখ্য হয়ে উঠবে? এমনই এক পটভূমতে হাইরেস অসাধারণ একটি বক্তব্য প্রদান করেছেন।

তিনি লিখেছেন: You can not spill a drop of American blood without spilling the blood of the whole world... We are not a narrow tribe of men— No: our blood is as the flood of the Amazon, made up of a thousand noble currents all pouring into one... For who were our father and mother? Or can we point to any Romulus and Remus for our founders? Our ancestry is lost in the universal paternity, and Caesar and Alfred, St. Paul and Luther, Homer and Shakespeare are as much ours as Washington, who is as much the world’s as our own.

সাংস্কৃতিক সাক্ষরতার মাধ্যমে মানুষকে এই পরিচয়ের গুরুত্ব অনেকাংশে উপলব্ধি করানো সম্ভব বলে মনে করা হয়। তবে বিষয়টি এমন নয় যে, প্রাতিষ্ঠানিক অধ্যয়নের অন্তর্ভুক্ত হওয়া মাত্রই শিক্ষার্থীরা বিষয়টিকে আত্মস্থ করে ফেলবে। অধিকন্তু নিরন্তর অধ্যবসায় ছাড়া এমন একটি অনুধ্যান তৈরি হওয়া সম্ভব নয়। উদহরণ দিই। মাতৃভাষা ছাড়া অন্য একটি ভাষা আত্মস্থ করার জন্য নিরন্তর পরিশ্রম করতে হয়। বিশেষ করে সেই ভাষার সাহিত্য ও সংস্কৃতি অনুধাবনের যে দক্ষতা ও গভীরতা অর্জন করতে হয় তার জন্য নিষ্ঠা ও সততার সঙ্গে চেষ্টা চলিয়ে যেতে হয়। একইভাবে জ্ঞানকাণ্ডের যে কোনো শাখায় ব্যুৎপত্তি লাভের জন্য নিরন্তর অধ্যবসায় ছাড়া আর কোনো পথ খোলা থাকে না। নিঃসন্দেহেই এর সঙ্গে ভালো লাগা ও ভালোবাসা বোধ থাকতে হয়। তা না হলে মহৎ কোনো অর্জন সম্ভব হয় না। সাংস্কৃতিক সাক্ষরতা লাভের জন্যও তেমনিভাবে গভীর অনুধ্যানের সঙ্গে নিরন্তর প্রচেষ্টা চালিয়ে যেতে হয়। কারণ যোগাযোগের এই মাধ্যমটি ভিন্ন প্রকৃতির এবং এর মূল উদ্দেশ্য হলো শ্রদ্ধা করতে, সম্মান করতে ও ভালোবাসতে শেখানো। এই শ্রদ্ধা, সম্মান ও ভালোবাসা ‘ভিন্ন’তার প্রতি, ‘অপরে’র প্রতি। বিষয়টি সহজ নয়। স্কুলের শিক্ষাক্রম, শিখন-শেখানো কৌশল, মূল্যায়ন পদ্ধতি, শিক্ষক, সহপাঠী এবং সামগ্রিক পরিবেশ যদি অনুকূল না হয় তা হলে সাংস্কৃতিক সাক্ষরতা অর্জন করা কঠিন। কারণ বিষয়টি ব্যক্তিগত নয়, সামষ্টিকÑ সফল যোগাযোগের উপর এর সাফল্য নির্ভর করে এবং ধীরে ধীরে সামষ্টিক মনোবৃত্তি বাড়তে থাকে। ভিন্নতার প্রতি সহানুভূতি ও মমত্বের এই সামাজিক প্রসারণ ও বিস্তৃতি এর সাফল্যের নিয়ামক।

লেখক: কথাসাহিত্যিক শিক্ষাবিদ