সানোয়ার রাসেল

সানোয়ার রাসেল

সানোয়ার রাসেলের গদ্য ‘এই মাটি এই হাওয়ার স্পর্শে’

প্রকাশিত : সেপ্টেম্বর ০৭, ২০২২

অনেক শতাব্দী আগে অস্তাচলের কাছে যুলকারনাইন সূর্যকে পঙ্কিল জলাশয়ে ডুবতে দেখেছিলো। সূর্য, যা প্রতিদিন পশ্চিমে অস্ত যায় আর সিজদায় রত হয়ে আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করতে থাকে। পরদিন আবার উদিত হওয়ার অনুমতির জন্য এবং একদিন যাকে আর অনুমতি দেওয়া হবে না, যে পথে এসেছো সেই পথেই ফিরে যাও। সেই সূর্যকে যুলকারনাইনের মতো আমিও অস্ত যেতে দেখছিলাম এক মুমুর্ষু নদীর ওপাড়ে। আর ভাবছিলাম যুলকারনাইন সূর্যকে পঙ্কিল জলাশয়ে ডুবে যেতে দেখেছিল, এই ঘটনাটা কেন এত গুরুত্ব পাওয়ার দাবি রাখে। এর আগে কেউ কি আর সূর্যকে ডুবতে দেখেনি? নাকি যুলকারনাইন এর আগে কখনও সূর্যের অস্তগমন অমন মনোযোগে পর্যবেক্ষণ করেনি? আমি ও আমার পথের বিশ্বস্ত সঙ্গী পাদুকাদ্বয় যখন এইসব নিয়ে চিন্তিত হতে যাচ্ছি ঠিক তখনই গ্রামের মেঠো পথে হাল্কা ধুলো উড়িয়ে এক সৌম্যকান্ত লোককে আমরা আমাদের দিকে অগ্রসর হতে দেখি। আর তাকে দেখামাত্রই আমাদের যুলকারনাইন বিষয়ক অসংলগ্ন চিন্তার জাল ছিন্ন হয়ে যায় যার কারণ হিসাবে আমরা পরে আবিষ্কার করেছিলাম যে শয়তান আমাদের তখন ত্যাগ করেছিল।

আমরা সৌম্যকান্ত লোকটির দিকে আগ্রহভরে তাকিয়ে থাকি। মূলত তার অবয়বে এমনই একটি পবিত্র ছাপ আমরা লক্ষ্য করি যে, আমরা তার দিকে আগ্রহভরে না তাকিয়ে থাকতে পারি না। আমার পাদুকাদ্বয় ছটফট করে ওঠে। বুঝতে পারি তারা অগ্রসর হতে চাইছে। আমি তবু আরও একটু অপেক্ষা করতে বলি তাদের। লোকটি আরও কাছে আসে। যেন এক পশলা বৃষ্টির শান্তি নিয়ে কিংবা ভাঁটফুলের সুরভী নিয়ে সে আমাদের নিকট আবির্ভূত হয়। আমরা তাকে অপরিচিত ভাবতে পারি না। সে আমাদের তার সাথে হাঁটতে আহ্বান করে। আমরা মন্ত্রমুগ্ধের মতো হাঁটতে থাকি। অথচ আমরা যেখানে যেতে চেয়েছিলাম কিছুক্ষণ আগেও জানতাম না সেই জায়গাটা ঠিক কোথায় আছে। কিন্তু এখন আমরা নিশ্চিত হয়ে যাই যে এই মানুষটার সঙ্গে চলতে থাকলে আমরা যেই জায়গাটা খুঁজছিলাম সেই জায়গাটা পেয়ে যাব। খুব বেশি সময় হাঁটতে হয় না। আমাদের রাহবার এইবার থেমে গিয়ে বলে, `আমরা পৌঁছে গেছি`। আমরা তার স্মিত পবিত্র হাসি দেখতে পাই। আর তখনই আমরা তাকে চিনে ফেলি। এ হলো আযান।

আমাদের নিয়ে এসেছে এই মসজিদে। সূর্যকে ডুবতে দেখার ক্ষণকাল আগে থেকেই যেখানে আসার পথ আমরা খুঁজছিলাম এবং সেই সূত্রে যুলকারনাইন বিষয়ক বেহুদা ভাবনা আমাদের পেয়ে বসেছিল। বস্তুত শয়তানই কালক্ষেপণের জন্য সেই সময় সেই ভাবনায় আমাদের নিমজ্জিত করছিল আর ঠিক তখনই সেখানে আযান এসে হাজির হলে শয়তান আমাদের ছেড়ে পালায়। এখন আমরা তা বুঝতে পারি। আমরা আরও বুঝতে পারি কাজে কাজেই মন্দ লোকের ভালো কথাও মন্দ। গোবরের স্তূপের উপর যতই সবুজ ঘাস গজাক না কেন, মাঠের গালিচা ভেবে তাতে বসে পড়া যায় না। আমি ও আমার সঙ্গী পাদুকাদ্বয় মসজিদটিকে দেখতে পাই আর ছোট্ট মসজিদটিকে দেখে আমার আম্মার কথা মনে হতে থাকে। মাটির মেঝে আর টিনের চালের মসজিদ, সেই চালের টিন আবার গোটাকতেক মরিচার দাগ অঙ্গে নিয়ে মেহেদীর মতো কালচে লাল বরণ হয়ে আছে। তার সবুজ তৃণাচ্ছিদ আঙ্গিনার এক কোণে যেখানে অনেকগুলো পেঁপেগাছ জড়াজড়ি করে দাঁড়িয়ে আছে, সেইখানে কয়েকটি অযুর বদনা রাখা।

সেই সান্দ্র সন্ধ্যার নিভে যাওয়া আলোয় অপ্সৃয়মান সবুজের চাদরে আবৃত পেঁপেগাছতলার দিকে তাকিয়ে আমার শৈশবের কথা মনে হতে থাকে। ঠিক এমনই আঁধার নেমে আসতো আমাদের কলতলার পাকা মেঝেতে। আর তখন মানে আমাদের ছেলেবেলায় নিয়ম করে লোডশেডিং হতো। বিরোধীদলের মিছিলের একটা প্রধান শ্লোগান ছিল লোডশেডিং নিয়ে টিটকারিমূলক, `অমুক ভাইয়ের উন্নতি, সন্ধ্যার পরে মোমবাতি` এই ধরণের। আমরা বলতাম কারেন্ট চলে গেছে। কারেন্ট চলে গেলে আম্মা হারিকেন ধরাতেন। প্রতিদিনের পরিচর্যায় হারিকেনের চিমনিটা কি সুন্দর ঝকঝকে হয়ে থাকতো। আমরা হারিকেনের চিমনির উপরের উত্তপ্ত টিনের মাথা থেকে কেরোসিনপোড়া ঘ্রাণ পেতাম। কি আপন সেই ঘ্রাণ! হারিকেনের হলদে আলোয় আমরা বই খুলে চিৎকার করে পড়া মুখস্থ করতাম। আর তাকিয়ে থাকতাম চিমনির ভিতরের সলতের আলোয়। হারিকেনের শিখা কখনও সূচাগ্র হতো না। কেমন একটা ট্রাপিজিয়াম তৈরি করে রাখতো সবসময়। সেই ঘোরলাগা মায়াবী আলো যেন এই মসজিদের দহলিজে নেমে আসতে দেখি। আর পেঁপেগাছের অপসৃয়মান সবুজ যেন আম্মার শাড়ির জমিনের মতো পরিচিত লাগে। আমি তার নিচে বসে অযু করি। আম্মার শাড়ির আঁচল আমাকে আশ্রয় দেয়, আমাকে পবিত্র করে।

আমি আমার সঙ্গীদ্বয়কে বাইরে রেখে মসজিদে প্রবেশ করি। মাটির মেঝের উপর চটের মাদুর পাতা। সাকুল্যে চারটে কাতার করা যায়। মুসল্লি গোটা পাঁচ ছয়। সকলেই প্রায় বয়ঃবৃদ্ধ। অথচ যৌবনকাল হলো ইবাদাতের শ্রেষ্ঠ সময়! এই জনপদ কি তবে যৌবনশূন্য? এই মাগরিবের ওয়াক্ত, এই সূর্যের ডুবে যাওয়া, এই যে পাতায় পাতায় আত্মনিমগ্নতা, এই সব সমর্পণের গান কি তাদের কর্ণকুহরে প্রবেশ করে না? এইসব ভাবনাকে দূরে সরিয়ে ইক্তেদায়িতু বিহাজাল ইমাম বলে সালাতে মন দিলাম। সালাতান্তে জিকিরের সময় দেখতে পাই মসজিদটি চুপ করে এসে আমার সামনে এসে বসেছে। আমি তার ছোট্ট ও অপ্রশস্ত মিহরাবের দিক নজর দিই। টিনের মসজিদে টিনের মিহরাব। তাতে ইমামের জায়নামায রাখার পর আর জায়গা নেই। কাজেই মিম্বরটির জায়গা হয়েছে মিহরাবের বাইরে, ডানদিকে একটু এগিয়ে। সেই মিম্বরটিও খুব সাধারণ, ছোটখাট তিনটি সিঁড়ি। এই মিম্বরের সাথে আমি আমার দেখা বড় বড় মসজিদের মিম্বরের তুলনা করতে চাই। কী বিশাল সেই মিম্বরগুলো! দামী কাঠের তৈরি সেই সব মিম্বরগুলোতে কতো আশ্চর্য সুন্দর সব কারুকাজ! সেই সুউচ্চ মিম্বরগুলোর ধাপে চড়ার সময় ইমাম সাহেবের কি মনে হয়? আমার কেন জানি মনে হয় তারা হাতীর পিঠে চড়ার অনুভূতি পেতে পারেন।

ছোটবেলায় একবার মিরপুরের চিড়িয়াখানায় গিয়ে হাতির পিঠে চড়েছিলাম। তখন সেখানে দর্শনীর বিনিময়ে হাতির পিঠে চড়ার ব্যবস্থা ছিল। এখনও আছে কিনা, জানি না। বহুদিন সেখানে যাওয়া হয়নি। হাতি! সে এক বিশাল জানোয়ার। রশি দিয়ে ঘেরা বৃত্তাকার একটা অঞ্চল। প্রবেশমুখে হাতিটা স্টেশনে দাঁড়ানো ট্রেনের মতো দাঁড়িয়ে আছে। তার ওপরে মাহুত বসা। হাতির গায়ে একটা মই ঠেকিয়ে তাতে ওঠার ব্যবস্থা করা আছে। আমি ও আরো কয়েকজন শিশু সেই মই বেয়ে হাতির পিঠে চড়লাম। তারপর সারিবদ্ধভাবে বসলাম মাহুতের পিছনে, যেমন ইমামের পিছনে মুক্তাদিরা বসে থাকে। হাতি আমাদের নিয়ে সেই বৃত্তাকার পথে এক চক্কর ঘুরিয়ে আনলো। আমরা নেমে গেলাম। সেই বিশাল হাতির পিঠে চড়ার অনুভূতি আমার আজও মনে আছে। মনে হচ্ছিল একটা আস্ত পৃথিবী আমাকে পিঠে নিয়ে ঘুরছে। অতবড় হাতীটার পিঠে বসা মাহুতকে খুব ক্ষুদ্র মনে হচ্ছিল। বড় বড় মসজিদের ওই বিশাল বিশাল মিম্বরে যখন ইমাম সাহেবেরা উঠে দাঁড়ান তখন তাদেরকেও সেই মাহুতের মতো মনে হয় আমার কাছে। সেই তুলনায় এই ছোট্ট মিম্বরের ওপর দাঁড়ানো ইমামকে অনেক বড় মনে হওয়ার কথা। এই সবই আপেক্ষিকতা।

জিকির শেষ হতেই মসজিদটি এগিয়ে এসে পরম প্রিয়জনের মতো আমার সাথে মুসাহাফা করে ও কুশলাদি জানতে চায়। সে বলে সে নাকি আমাকে দেখেই বুঝতে পেরেছে যে আমি তাকে ভালোবেসে ফেলেছি। আমি তার সাথে কথা বলতে থাকি। আমি তার কাছে জানতে চাই যে, সে কিভাবে আমার ভালোবাসার কথা বুঝতে পারে। মসজিদ বলে আমার রূকু আর সিজদাহ তার কাছে সেই ভালোবাসার সাক্ষ্য দিয়েছে। সে জানায় সে শুধু আমার নয়, আমার পিতার ভালোবাসার সংবাদ সম্পর্কেও জ্ঞাত। তার এই কথা আমার মনে বিস্ময়ের উদ্রেক করে। কেননা আমার পিতা, যাকে আমি আব্বা বলে সম্বোধন করতাম, কখনও এই অঞ্চলে এসেছেন বলে আমি মনে করতে পারি না। তখন মসজিদটি এক আশ্চর্য খবর আমার কাছে প্রকাশ করে। দুনিয়া জাহানের সমস্ত মসজিদ একে অপরের খবর রাখে। মসজিদুল আকসায় কে কে সিজদাবনত হয় সেই খবর এই ছোট্ট মসজিদ জানতে পারে, আবার এই ছোট্ট মসজিদে সিজদাকারীর খবর মসজিদুল হারামে পৌঁছে যায়। বরং আরও খাঁটি কথা হলো দুনিয়া জাহানের সমস্ত মসজিদ আসলে একই। তাই  মসজিদের প্রতি আব্বার ভালোবাসা এদের কারও কাছেই অজানা থাকে না। আমি এই কথার সূত্রে আব্বার কথা মনে করার চেষ্টা করি।

আব্বা, যিনি বারযাখের জগতে চলে গেছেন, আল্লাহ রাব্বুল আলামীন তাকে জান্নাতুল ফিরদাউস দান করুন। তিনি ছিলেন সরকারি কর্মচারি। এমন এক সরকারি কর্মচারি যাকে কেবল বেতনের উপর নির্ভর করেই সংসার চালাতে হতো। আমরা শৈশব থেকেই একটা কথার সাথে খুব পরিচিত ছিলাম, তা হলো বাজেট। আমাদের শৈশবে নতুন জামা কেনা হতো বছরে এক বার। তা হলো ছোট ঈদের সময়। ঈদুল ফিতরকে আমরা ছোট ঈদ বলতাম। সেই ঈদে আব্বা-আম্মার সাথে কেনাকাটা করতে যেতাম। তখনও শপিং কথাটা আমাদের মতো নিম্ম-মধ্যবিত্ত পরিবারে প্রচল হয়নি। আমরা বলতাম মার্কেটিং। মার্কেটিং এর সময় দেখতাম পছন্দের জামা-কাপড় ইত্যাদি ক্রয়ের সময় আব্বা-আম্মা কি ভীষণ মরিয়া হয়ে দর কষাকষি করতেন। সবশেষ অস্ত্র হিসাবে আব্বা বলতেন ভাই বাজেটে কুলাচ্ছে না। তখন, সে সময় আব্বার মুখ কি ভীষণ অসহায় লাগতো! আর এক অবর্ণনীয় লজ্জায় আমার কোথাও গিয়ে লুকিয়ে থাকতে ইচ্ছা করতো। সারকথা এই যে আমরা বাজেটের মাপে জীবনের মাপ ঠিক করতে শিখে গিয়েছিলাম।

এইসব টানাপড়েন সত্ত্বেও মসজিদের প্রতি ভালোবাসায় আব্বার কখনই কোন কমতি দেখিনি। আব্বার ছিলো শিফটিং ডিউটি। কখনও মর্নিং, কখনও ইভিনিং, কখনও নাইট শিফটে কাজ করতে হতো। কিন্তু যত ক্লান্ত হয়েই বাসায় ফিরতেন, ওয়াক্তের সালাতের সময় ঠিকই মসজিদের দিকে রওনা হয়ে যেতেন। তার সেই সীমিত বাজেট থেকে একটা অংশ নিয়মিত মসজিদের তহবিলে জমা হতো। প্রখর রোদ, তুমুল বৃষ্টি, ঝড়, এই সব প্রাকৃতিক দুর্যোগের সময়ও তাকে বলে কয়ে মসজিদে গমন থেকে বিরত রাখা যায়নি। এমনকী যখন স্ট্রোকজনিত অকাল বার্ধক্যে তার পদক্ষেপ ভারসাম্যহীন হয়ে পড়েছিলো, তখনও তাকে দেখেছে পা টেনে টেনে মসজিদে গিয়ে সালাত আদায় করতে। মসজিদের প্রতি তার এই ভালোবাসা তার মৃত্যুর পূর্ব পর্যন্ত জারি ছিলো। অতএব, আব্বা সম্পর্কে এই ছোট্ট মসজিদটির মূল্যায়ন আমি অস্বীকার করতে পারি না।

মসজিদটি আমাকে আরও অনেক কথা বলে চলে। আমি তার কাছে জানতে চাই, এই যে তার এই জীর্ণদশা, এই নিয়ে তার কোন কষ্ট আছে কিনা। প্রত্যুত্তরে সে জানায় যে, সমস্ত প্রশংসা আল্লাহর আর সে অনেক বড় বড় মসজিদের চেয়ে ভালো আছে। সে আমাকে বলে, তুমি কি দেখোনি যে দুনিয়ার কত মস্ত বড় মসজিদ, যাদের স্থাপত্যকলাগুলো স্বর্গীয় প্রচ্ছায়ার মতই মনোরম বলে বোধ হয়, তাদের নির্মাণে যেইসব বাদশাহ আর সুলতানেরা পৃষ্ঠপোষকতা করেছেন, তাদের অধিকাংশই তার প্রজাদের উপর কিভাবে জুলুম করতেন? তুমি কি দেখোনি সেই আলেম হন্তারক শাসকদের যারা সুরম্য মসজিদ তৈরিতে অর্থ ব্যয় করেছেন? কিংবা হারাম পথে অর্থোপার্জনকারী সেই সব ব্যবসায়ীদের যাদের অবৈধ অর্থে মসজিদের ভিট মানুষের চেয়েও উঁচু হয়েছে আর শীতাতপ নিয়ন্ত্রণের ব্যবস্থা হয়েছে? কিংবা দেখোনি কি সেই সব রাজকর্মচারী, যারা অবৈধ অর্থের কিয়দংশ এই ভেবে মসজিদে প্রদান করেছে যে এর ফলে তারা জান্নাতের হকদার হয়ে যাবে? তুমি কি জানো, সেই সব মসজিদ আমার সাথে তাদের দুঃখের কথা কয়! তাদের সমস্ত শরীরে তারা মানুষের পাপের অর্থে ঐশ্বর্য বয়ে বেড়াচ্ছে। আর তুমি আমার দিকে তাকাও, তাকাও তোমার ভালোবাসার এই মসজিদের দিকে। এই মুসুল্লিদের দিকে।

এরা সবাই চাষাভুষো। এদের তিতিপড়া মলিন বস্ত্রের দিকে তাকাও। আর এদের গায়ের রৌদ্রদগ্ধ গাঢ় খয়েরি চামড়ার দিকে তাকিয়ে দেখো। এদের অর্থে কোন কলুষতা নেই। এরা সেই আসহাবে সুফফার উত্তরাধিকারী, যাদের কারুরই পরিধানের জন্য পূর্ণ চাদর ছিলো না। তুমি আমার জীর্ণ দশা দেখে দুঃখ পাচ্ছ? তুমি কি জানো না নবীর মসজিদ কেমন ছিলো? তার ছাদ ছিলো খর্জুর বৃক্ষের শাখা আর খুঁটি ছিলো খর্জুর বৃক্ষের গুঁড়ি। আর দেয়াল ছিলো কাঁচা ইটের তৈরি। বরং আমি তো অবয়বের দিক দিয়ে মসজিদের নববীর অধিক নিকটবর্তী!

আমি ছোট্ট মসজিদটির কোন কথাই অস্বীকার করতে পারলাম না। আমি তার কথার রসে এমনভাবেই মজে গেলাম, যেভাবে মাছি ময়রার দোকানের কড়াইয়ের গরম সীরায় পড়ে আটকে যায়। এমনকী মসজিদের বাইরে অপেক্ষমাণ আমার সঙ্গী পাদুকার কথাও আমি বিস্মরণ হয়েছিলাম!

এইভাবে কথা বলতে বলতে ছোট্ট মসজিদটি আমার বুকের মাঝে ঢুকে যায়। কিংবা সে খুব সম্ভবত আমার শৈশব থেকেই আমার বুকের ভিতর বসবাস করে আসছে। সেই রহস্যভেদ করতে গিয়ে আবার আম্মার কথা আমাকে ভাবতে হয়। আমাকে স্তন্যদান থেকে ছাড়ানোর পর পরই আম্মাকে চাকুরীর সুবাদে চলে যেতে হয় আরবদেশে। নিশ্চয় দুধের শিশুকে ফেলে যেতে তার হৃদয় বিদীর্ণ হয়েছিলো। কিন্তু আমরা তখনই জানতাম, হৃদয়ের চেয়েও বড় কিছু এই দেহে থাকে, যার কাছে বিদীর্ণ হৃদয়ের কোন মূল্য থাকতে পারে না। সুদূর আরবে কাজের ফাঁকে ফাঁকে তিনি আমাদের কথা ভেবে কাঁদতেন। বিদেশ থেকে আম্মা একটি টুইন ওয়ান পাঠিয়েছিলেন। ওতে রেডিও এবং টেপরেকর্ডার দুই-ই ছিলো। আব্বা খালি ক্যাসেট কিনে এনে তার মধ্যে কথা রেকর্ড করে পাঠাতেন। আম্মা সেই রেকর্ডেড ক্যাসেটে আমার আধো আধো বোল শুনতে চাইতেন। কিন্তু কি এক অজানা লজ্জা কিংবা আড়ষ্টতায় আমি কখনই রেকর্ডারের সামনে কিছু বলতে পারতাম না। মনে পড়ে, যেদিন আম্মা প্রথম বিদেশ থেকে দেশে ফিরলেন, আমরা, আব্বা ও আমি তাকে আনতে এয়ারপোর্টে গিয়েছিলাম। এয়ারপোর্টে আম্মা আমাকে জড়িয়ে ধরে আদর করেছিলেন কি না, তা আজ আর মনে পড়ে না।

তবে আমি সেই প্রথমবার ঢাকা শহরে `বিকল্প পরিবহণ` নামে একটি ট্যাক্সি ক্যাবে চড়েছিলাম।  আর লেবুর স্বাদযুক্ত খুব মজার এক আইস্ক্রিম খেয়েছিলাম। এবং জ্বালানি তেলের ঘ্রাণে অনভ্যস্ততার দরুণ সেই ট্যাক্সির ভেতর বমি করে সব বের করে দিয়েছিলাম। আম্মা বিদেশ থেকে বড় বড় দুটো বাক্স নিয়ে এসেছিলেন। তাদেরকে লাগেজ নামে ডাকা হতো বলে শুনতাম। যখন লাগেজ খোলা হতো, অদ্ভুত মাদকতাময় এক সুরভি সেখান থেকে বের হয়ে আসতো। সেই ঘ্রাণটাই আমার কাছে বিদেশ বলে মনে হয়। এখনও প্রবাসী কেউ দেশে ফিরলে তার শরীর থেকে সেই ঘ্রাণ আমি আলাদা করতে পারি। আম্মার সেই লাগেজগুলো থেকে আমাদের ও আত্মীয়-স্বজনদের জন্য কতোকিছু যে বের হতো! শার্ট পিছ, প্যান্ট পিছ, সাফারিসুট, পারফিউমের শিশি— আমরা বলতাম সেন্ট, সিকো ঘড়ি, মোজা, খেলনা উট— আরও কতো কি! সেই সবের মাঝখান থেকে আমি পেয়েছিলাম আরব বাদশাদের মতো একখানা সাদা আলখেল্লা, মাথা ঢাকার সাদা রুমাল আর সেই রুমাল আটকে রাখার জন্য কালো সৌদি চাকতি। সেই সব গায়ে চাপিয়ে আমি আমাদের মহল্লার মসজিদে জুম্মা পড়তে যেতাম। ছোট এক আরবশিশু যেন, সকলেই তাকিয়ে দেখতো আমার পোষাক। মসজিদটা ছিলো আধপাকা।

জুম্মার দিন মূল মসজিদে মানুষের জায়গা আঁটতো না। বাইরের বারান্দাতে বসতে হতো। আর আমরা শিশুরা বসতাম বারান্দারও বাইরে। সেখানে বালিগুলো রোদে উত্তপ্ত হয়ে থাকতো। তার উপর বিছানো থাকতো চটের দীর্ঘ থান। আর মাথার উপর এক সাড়ি খেজুর গাছের ঝরোকাকাটা আলো-ছায়া। সেইখানে বসে ইমাম হুজুরের বয়ান আর খুৎবা শুনতে শুনতে দুইচোখ ঘুমে বুজে আসতে চাইতো। মনে হতো যেন আমি আরবের বালুকাময় কোন মরুদ্যানে বসে আছি। জানি না, সেই থেকেই মসজিদ আমার বুকের ভিতর ঢুকে বসে আছে কি না! মসজিদটি আমার বুকের ভিতর থেকে বলে চলে এই যে আমি সালাতের পর পবিত্র দেহমনে যতক্ষণ মসজিদে বসে আছি ততক্ষণ বস্তুত আমি সালাতের মধ্যেই আছি। বুকের মধ্যে মসজিদটির অস্তিত্ব অনুভব করতে পেরে আমি মসজিদ থেকে বের হয়ে যাওয়ার জন্য প্রস্তুত হই। আমি আমার পাদুকাদ্বয়কে আর বাইরে অপেক্ষমাণ রাখতে চাই না। সেই সময় মসজিদটি বলে ওঠে, এই যে তুমি বুকের ভিতর মসজিদকে আবিষ্কার করতে পেরেছো, আর কখনও তোমাকে তা খুঁজে বেড়াতে হবে না। তুমি জঙ্গল-পাহাড় যেখানেই যাও, কিংবা ঢুকে যাও কোন অত্যাচারীর অর্থে গড়া কোন বিশাল মসজিদে, যেখানে তোমার মন সিজদায় সংকোচ করে, তুমি সেসব নিয়ে কখনই চিন্তিত হবে না।

তোমার বুকের ভিতর থেকে ছোট্ট এই মসজিদটিকে বের করে সেখানেই সিজদাবনত হবে। মনে রাখবে, আল্লাহ এই পৃথিবীকে তোমাদের জন্য মসজিদ করেছেন আর মাটিকে করেছেন পবিত্র। আমি মসজিদটিকে বুকে নিয়ে বের হয়ে আসলাম। তখন প্রথম রাতের পবিত্র হাওয়া বইছে পেঁপেগাছগুলোর পাতা ছুঁয়ে ছুঁয়ে। আমি মাটির দেহ নিয়ে পবিত্র মাটির উপর হাঁটতে থাকলাম, রাত্রির হাওয়ার স্পর্শ নিয়ে। যেই মসজিদ আমি বুকের মাঝে খুঁজে পেয়েছি, এই মাটি, এই হাওয়ার স্পর্শ তাকে আর কখনই ভুলতে দেবে না, আমি জেনে গেছি।

লেখক: কবি