সানোয়ার রাসেল

সানোয়ার রাসেল

সানোয়ার রাসেলের চারটি কবিতা

প্রকাশিত : আগস্ট ১৩, ২০২১

জেরুসালেম

অন্ধকারে হেঁটে যাচ্ছে মানুষ। কালো কালো গাছেরা দু`পাশ বেয়ে সরে যাচ্ছে। অন্ধকারেও আকাশ জ্বলে।
দ্যুতিময় আকাশ―
যেন সমান্তরাল কালোর বুক চিরে এগিয়ে আসছে
জলে ধোয়া ক্যানভাসের মতো।
পথের পাথর বিগতযৌবনা পিচের স্মৃতি নিয়ে
পায়ের নিচে মুচুর মুচুর শব্দ তুলছে। অন্ধকারে জ্বলছে
ইঁদুরের চোখ। জ্বলজ্বলে চোখে ইতিউতি তাকিয়ে
গর্ত থেকে বের হচ্ছে―
ছুটে যাচ্ছে ভাঁড়ারের দিকে। যেখানে আছে প্রচুর খাবার। আর গৃহিণীর বিশ্বাস, যা একটু পরেই কুটি কুটি হবে।
ইঁদুরেরা ছুটছে। অন্ধকারে হেঁটে যাচ্ছে মানুষ।
ওদিকে রাত শেষ হলে
একটা দুঃখী ইহুদি― যার হাতে কোনো রক্ত লেগে নেই― ডাকছে,
শোনো হে ইসরায়েল, আমাদের প্রভুই একমাত্র।

অভিশাপ

তোমাকে অভিশাপ দিলাম―
একদিন তুমি বদলে যাবে।
এমন বদলাবে যে
লোকেরা নিজের হাত কামড়ে ধরবে
নিজের কানকে অবিশ্বাস করবে
আর নিজের হাতকে ভাববে বেঈমান।
যে লোকটি বিশ্বাস করতে রাজি ছিল যে
নদীর স্রোত উলটো বইতে পারে অথচ
তুমি কখনও বদলাতে পারো না
সেও নিজের মাথা খামচে ধরে দেখবে―
তুমি বদলে গেছ।

তোমাকে অভিশাপ দিলাম―
একদিন তুমি বদলে যাবে।
তোমার মাথায় থাকবে টুপি
তোমার হাতে থাকবে তসবিহ
তোমার মুখে থাকবে জিকির

তোমাকে অভিশাপ দিলাম―
একদিন তুমি বদলে যাবে।
সবার আগে মসজিদে যাবে
প্রথম কাতারে বসবে
লোকের দোষ ধরা দূরে থাকুক
পরনিন্দা শুনলেও কান চেপে ধরবে
বেগানা নারীর আভাস পেলে চোখ বন্ধ করে ফেলবে
দুখিদরিদ্রের কল্যাণে প্রাণপাত করবে।

তোমাকে অভিশাপ দিলাম―
একদিন তুমি বদলে যাবে।
তুমি আটপৌরে সংসারী হবে
তুমি সন্তানের কাছে হবে আদর্শতম
তুমি স্ত্রীর কাছে হবে পুতপবিত্র

তোমাকে অভিশাপ দিলাম―
একদিন তুমি বদলে যাবে।
তুমি খুঁজে খুঁজে ঋণগ্রস্তের ঋণ পরিশোধ করবে
তুমি দ্বীনের দাওয়াতে হবে প্রামাণ্য রাহবার
তুমি কলেমা পড়তে পড়তে মরে যাবে।

তারপর―
তুমি রোজ হাশরে হাসতে হাসতে বেহেস্তের দিকে যাবে
তোমাকে অভিশাপ দিলাম―
তুমি হাসতে হাসতে বেহেস্তের দিকে যাবে
আর মাঝপথে আমি দু`হাত পেতে বলবো
একদিন আমাকে যে দুঃখ দিয়েছিলে তা ফিরিয়ে নাও
আমার দুঃখ ফিরিয়ে নিতে নিতে নিতে নিতে
তোমার পুণ্যের ঝুলি শূন্য হয়ে যাবে
আর সেই শূন্যতার হাহাকার তোমার হৃদয়ে
হাবিয়া দোজখ হয়ে জ্বলবে অনন্তকাল।

তুমি বুঝবে,
ফিরে যেতে কেমন লাগে।
তুমি বুঝবে,
কাকে বলে অনন্ত দুঃখ।

তোমাকে অভিশাপ দিলাম―
একদিন তুমি বদলে যাবে।

মহররম

হায় হোসেন... হায় হোসেন...

মর্সিয়া গেয়ে রাজপথে তুমি
করছো যখন শোকের মাতম
যুগের এজিদ চোখের পরে
করছে তোমার ইমান খতম।

ইমাম হোসেন কারবালাতে
জিহাদ করেছে বাতিলের সাথে
তোমার জিহাদ শেষ হয়ে যায়
হায় হায় করে বুক চাপড়াতে!

ন্যায়ের স্বার্থে কাকে বলি দিলে,
ক`জন করেছো বাদ-প্রতিবাদ?
ইমামবাড়ায় মোম জ্বালিয়েই
অন্ধকারে আনবে প্রভাত?

ইমামের ঘোড়া সেও সয়েছে
তীরের আঘাত সঙ্গী হয়ে
অথচ তোমার মুখ খোলে না তো
রক্তলোলুপ তাগুতের ভয়ে।

মহররমের মিছিলে বন্ধু
তোমার আমার নাই অধিকার
কালো জামা গায়ে মর্সিয়া মুখে
তুমি-আমি বুকে পুষছি সীমার।

ভবনটি তখনও দাঁড়িয়ে ছিল

ভবনটি তখনও দাঁড়িয়ে ছিল, যখন মানুষেরা ফোঁপাচ্ছিল― অজানা আশঙ্কায়― মনে মনে― যে কেউ যে কোনো দিন যে কোনো সময় আক্রান্ত হতে পারে জেনেও যখন মুনাফাখোরি চলছিল― চলছিল জমিদখল, নদীদখল, কোম্পানি টেকওভারিং, মনোপলিস্টিক হেলথ বিজনেস― আর ভেজা বাতাস রোদে শুকাতে না শুকাতেই ফের বৃষ্টি― টিভির পর্দাজুড়ে অজস্র নাটক আর সেসবের অনলাইন প্রমোশন; স্লিভলেস পরা মেয়েরা ছুটছিল, ছুটছিল জোব্বা পরা ছেলেরা, ছুটছিল মানুষের হতাশা ও সন্দেহ― গন্তব্যকে অতিক্রম করে যাবে যেন― যেন তাতেই মুক্তি কিংবা আদৌ তারা মুক্তি নিয়ে চিন্তিত নয়, কেবল ছুটে চলা নিয়েই ভাবছিল হয়তো, নিষিদ্ধ করা হচ্ছিল শ্রেণিভেদে বিভিন্ন যান― বিভিন্ন রাস্তায়, ভুল নিয়মে কিছু অর্ধনমিত পতাকা দোকান থেকে কাত হয়ে ঝুলছিল, উদযাপিত ছিল বাধ্যতামূলক শোকসভা, দিনশেষে শোডাউন আর ধাওয়া পাল্টাধাওয়া, ছেড়া পোস্টার, ভাঙা প্লাস্টিকের চেয়ার― আর সেই সব বিদীর্ণ করে এম্বুলেন্সের ভীতিজাগানিয়া সাইরেন লো টু লাউড হয়ে ক্রমশ দূরে সরে যাচ্ছিল― শ্রাব্যতার সীমার বাইরে, আর ঘাসগুলো বড় হচ্ছিল অথচ ঘোড়ারা থাকছিল ক্ষুধার্ত, দিশাহীন মানুষ বানের জলের পানার মতো এ ধার থেকে ওধারে, এধার থেকে ওধারে ভাসছিলো আর চ্যাপচ্যাপে ভেজা ফ্লোরের চায়ের দোকানে বসে বিড়ি ফুঁকতে ফুঁকতে ষাটোর্ধ্ব ক্ষয়িষ্ণু মানুষেরা অযথা ব্যাজস্তুতিতে ছিল লিপ্ত, যখন ফুলের মূল্যে বুলেট পাওয়া যাওয়ার বিজ্ঞপ্তিতে শহরের দেওয়াল ছিল ঠাসা, ওদিকে দেওয়ালের পর দেওয়াল গড়ে উঠছিল গ্রাম-শহর নির্বিশেষে মানুষের অবচেতনে, আর সালভাদরের পেইন্টিং-এর গলে যাওয়া ঘড়ির মতো গলে যাচ্ছিলো মন ও মগজ― ভবনটি তখনও দাঁড়িয়েছিল লুই আই কানের ডিজাইনের বিকৃতিসমেত সতর্ক প্রহরীর অবসাদগ্রস্ত প্রহরার নিরাপদ নির্বিকার বলয়ের মাঝখানে।