মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ

মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ

সাম্প্রদায়িক শব্দের যথেচ্ছ ব্যবহার এবং তার রাজনীতি

পর্ব ১১

রাহমান চৌধুরী

প্রকাশিত : অক্টোবর ৩১, ২০২০

গান্ধী তারপর থেকে কংগ্রেসের অবিংসবাদী নেতা হয়ে দাঁড়ালেন, তাঁর নির্দেশেই চলতে থাকে কংগ্রেসের প্রতিটি কর্ম। হিন্দু-মুসলমানরা মিলিতভাবে খুব উৎসাহ নিয়ে খিলাফত আন্দোলন আরম্ভ করলেন। কিন্তু তুরস্কর কামাল পাশা নিজেই প্রচলিত অকার্যকর খলিফার পদ তুলে দিলেন, যখন তিনি তুরস্কের ক্ষমতা দখল করলেন। ফলে মুসলমানদের দিক থেকে খিলাফত নিয়ে আন্দোলন করার আর যৌক্তিকতা থাকলো না। ইতিমধ্যে ভারতের রাজনীতিতে উলামাদের প্রভাব বিস্তৃত হয়েছে। ভিন্ন দিকে খিলাফত আন্দোলনের নামে সাধারণ মানুষের মধ্যে, কৃষকদের মধ্যে আরম্ভ হলো ভয়াবহ ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলন। জিন্নাহ পরবর্তীকালে খিলাফত আন্দোলনের নামে সাধারণ মানুষের আন্দোলনের এই অংশের সমর্থন করে প্রশংসাবাক্য লিখেছিলেন। কারণ খিলাফতের দাবিকে ছাড়িয়ে তা তখন ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলন হয়ে ওঠে। গান্ধী যখন বুঝলেন, জনগণ ব্রিটিশ প্রশাসনের বিরুদ্ধে মারমুখি হয়ে উঠেছে আর এরকম ঘটলে আন্দোলন তার নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাবে; ব্রিটিশ শাসকরা দুর্বল হয়ে পড়বে। তিনি মাঝপথে হঠাৎ একক সিদ্ধান্তে আন্দোলন বন্ধ করে দিলেন। গান্ধীর এই স্বৈরাচারি সিদ্ধান্তে ক্ষুব্ধ হলেন চিত্তরঞ্জন, মতিলাল, সুভাষচন্দ্র, নেহরু সহ কংগ্রেসের বহু নেতা। জিন্নাহ তখন কংগ্রেস ছেড়ে দিয়েছেন, বলতে গেলে মুসলিম লীগের সঙ্গেও যুক্ত নন।

খিলাফতকে ঘিরে জনগণের বিটিশ বিরোধী আন্দোলন যখন ব্যাপক আকার নেয়, মুসলমান নেতারা খিলাফতের সঙ্গে যখন ভারতের স্বাধীনতার দাবি তোলে; গান্ধী সেই রকম পরিস্থিতিতে নিজের একক সিদ্ধান্তে আন্দোলন থামিয়ে দিলেন। মুসলমানরা মাঝপথে আন্দোলন থামিয়ে দেয়াকে মনে করলেন, ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলন যখন চূড়ান্ত পর্যায়ে গান্ধী তখন এরকম সিদ্ধান্ত নিয়ে মুসলমানদের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করেছেন। ফলে ভুল বুঝাবুঝির ভিতর দিয়ে হিন্দু-মুসলিম দাঙ্গা বেধে গেল। জিন্নাহ বহু আগেই এরকম ভবিষ্যত বাণী দিয়ে রেখেছিলেন; তিনি বলেছিলেন, গান্ধী যে পথে আগাচ্ছে সেপথে হিন্দু-মুসলমানের ঐক্য হতে পারে না, বরং বিরোধ অবশ্যম্ভাবী হয়ে দাঁড়াবে। গান্ধী তখন কংগ্রেসের অবিংসবাদী নেতা, যার নির্দেশই কংগ্রেস চলছে। কংগ্রেসে নতুন কিছু কনিষ্ঠ নেতাদের নিয়ে গান্ধী তখন কংগ্রেসে নিজের একাধিপত্য প্রতিষ্ঠা করেছেন। জিন্নাহর পক্ষে সেখানে কাজ করা তো দূরের কথা; মতিলাল নেহরু, চিত্তরঞ্জন, বিপিনচন্দ্র প্রমুখ টিকতে পারছেন না গান্ধীর স্বৈরাচারী নীতির কাছে। মুসলিম লীগ নেতাদের অনুরোধে জিন্নাহ এ সময়ে নতুনভাবে মুসলিম লীগের দায়িত্ব নিতে রাজি হন। তিনি মুসলিম লীগের সভাপতি হিসেবে নির্বাচিত হবার পর সংবাদপত্র সহ সকল মহলকে বললেন, তাঁর লক্ষ্য হবে পূর্বের মতোই হিন্দু-মুসলিম ঐক্য। তিনি বিশ্বাস করেন, হিন্দু মুসলমান ঐক্য না হলে ব্রিটিশকে তাড়ানো সহজ হবে না। মুসলিম লীগের সভাপতি হিসেবে তারপর দীর্ঘদিন ধরে তিনি সেই চেষ্টা চালিয়ে যান। কিন্তু বাধা হয়ে দাঁড়ালেন স্বয়ং গান্ধী আর হিন্দু মহাসভার নেতারা।

সকল ঐক্যের জন্য কিছু শর্ত থাকে। গান্ধীর নেতৃত্বাধীন কংগ্রেস কিছুতেই মুসলিম লীগের কোনো দাবি মেনে নিতে রাজি হলো না। মুসলিম লীগের দাবি ছিল সংখ্যালঘু মুসলামদের জন্য কিছু আসন সংরক্ষণ আর ভারতে মুসলমান জনগোষ্ঠীর রাজনৈতিক নিরাপত্তা বিধান। গান্ধী আর নেহরু বললেন, চাকরি-বাকরি আর অন্যান্য সকল ক্ষেত্রে প্রতিযোগিতা করে সবাইকে পদ লাভ করতে হবে। পশ্চাদপদ মুসলমানের জন্য আসন সংরক্ষণ তারা মানতে রাজি ছিলেন না। চিত্তরঞ্জন দাশ কিন্তু বাংলা প্রদেশে চাকরি বাকরির ক্ষেত্রে পশ্চাদপদ মুসলমানদের আসন সংরক্ষণ করার ব্যাপারে বিরাট ভূমিকা রাখেন। গান্ধী ব্যাপারটা পছন্দ করেননি। কংগ্রেস এসময় মুসলিম লীগকে দেয়া নানা প্রতিশ্রুতি বারবার ভঙ্গ করে। গান্ধীবাদী শৈলেশকুমার বন্দ্যোপাধ্যায়, বিজেপি নেতা যশোবন্ত সিংহ, বাম রাজনীতিক সুনীতি কুমার ঘোষ, আইনজ্ঞ বিমলানন্দ শাসমল, ইতিহাস গবেষক মৃণালকান্তি চট্টোপাধ্যায়ের লেখা  বইগুলি পাঠ করলে তা জানা যাবে। জিন্নাহ যখন মুসলিম লীগের দায়িত্ব নিয়ে সংখ্যালঘু এবং পশ্চাদপদ মুসলমানদের স্বার্থ রক্ষার কথা বললেন, তখন তাঁকে সাম্প্রদায়িক বলা হলো। মুসলিম লীগকে সাম্প্রদায়িক দল হিসেবে চিহ্নিত করা হলো।

জিন্নাহ চেয়েছিলেন পশ্চাৎপদ জনগোষ্ঠী হিসেবে সংখ্যালঘু মুসলমানদের স্বার্থ রক্ষা করতে। তিনি ইসলাম ধর্ম নিয়ে কখনো কথা বলেননি। নিজে ধর্মকর্ম করতেন না। মদ্যপান করতেন, শুকরের মাংস খেতেন। বর্তমান সময়ে বা বর্তমান বিশ্বে সংখ্যালঘুর স্বার্থ রক্ষা করাকে যথেষ্ট গুরুত্ব দিয়ে বিচার করা হয় আর সেটাকে ইতিবাচক আন্দোলন হিসেবে দেখা হয়। কংগ্রেস কিন্তু সেদিন জিন্নাহ বা মুসলিম লীগের ভূমিকাকে সেভাবে বিচার করেনি। জিন্নাহকে সাম্প্রদায়িক তকমা লাগিয়ে দিয়েছিলেন। ভিন্ন দিকে আম্বেদকর যখন দলিত সম্প্রদায়ের স্বার্থ রক্ষার কথা বলেছেন, তখন তাঁকে সাম্প্রদায়িক বলা হয়নি। শিখরা যখন তাদের সম্প্রদায়ের স্বার্থ রক্ষার জন্য নানা প্রস্তাব রেখেছে, তখনো তাদের সাম্প্রদায়িক বলা হয়নি। মুসলিম লীগ আর জিন্নাহর রাজনীতিকে বলা হলো সাম্প্রদায়িক। ফলে দেখা যাবে এরকম নানা ভুল বুঝাবুঝির মধ্য দিয়ে ভারতে হিন্দু-মুসলমান বিরোধ আরম্ভ হয়েছিল আর সেটা এখনো চলছে। জিন্নাহ এবং মুসলিম লীগ কিন্তু পশ্চাদপদ গোষ্ঠীর প্রতিনিধি আম্বেদকরের দাবিকে সমর্থন জানিয়েছিল, কংগ্রেস যা পছন্দ করেনি।

কংগ্রেস আম্বেদকরের দাবি-দাওয়া সামান্য সমর্থন করেনি। দলিতদের স্বার্থ রক্ষা করতে চায়নি। কিন্তু ভীমরাও আম্বেদকরকে সাম্প্রদায়িক বলেনি কারণ কংগ্রেস নেতারা তাঁকে হিন্দু বলেই মনে করতো। কিন্তু আম্বেদকর নিজেকে হিন্দু মনে করতেন না। তিনি দলিত হিসেবে হিন্দুদের সঙ্গে থাকতে চাননি, নির্বাচনে দলিতদের জন্য পৃথক আসন চেয়েছিলেন। ব্রিটিশ সরকার দলিতদের পক্ষে আম্বেদকরের দাবি মেনে নিলে গান্ধী তার বিরুদ্ধে কারাগারে বসে অনশন আরম্ভ করেন। বড় বড় বণিক থেকে শুরু করে কংগ্রেসের নেতারা তখন আম্বেদকরকে চাপ দেন তার ন্যায্য দাবি ফিরিয়ে নেবার জন্য। দলিত আম্বেদকর বড় বড় ব্যক্তিতদের চাপ না এড়াতে পেরে গান্ধীর ইচ্ছা মেনে নিতে বাধ্য হলেন। গান্ধী তারপর অনশন বন্ধ করেন। পরের বছর উনিশশো পঁয়ত্রিশ সালের শেষে আম্বেদকর এক ভাষণে বলেন, ‘জন্মসূত্রে আমি অস্পৃশ্য হিন্দু। দুর্ভাগ্যবশত, জন্ম আমার ইচ্ছাধীন ছিল না। কিন্তু এই অসম্মান নিয়ে হিন্দু ধর্মে থাকব না। স্পষ্ট জানাচ্ছি, একজন অস্পৃশ্য হিন্দু হিসেবে মরব না।’ তিনি কথা রেখেছিলেন। স্বাধীন ভারতে তিনি মৃত্যুর দুমাস আগে, ভারতের সংবিধানের রচয়িতাদের প্রধান ব্যক্তি আম্বেদকর উনিশশো ছাপ্পান্ন সালের অক্টোবর মাসে তিনলক্ষ দলিতদের নিয়ে বৌদ্ধধর্মে দীক্ষিত হন। পরদিন আরো লক্ষাধিক মানুষ তার কাছে দীক্ষা নেন। চলবে