সালমান শাহকে নিয়ে লেখা গল্পগ্রন্থ ‘কয়েদি’
লুনা আহমেদপ্রকাশিত : মার্চ ০৭, ২০১৯
একটি গল্পগ্রন্থ যার ভিতরে লিখে রাখা হয়েছে দীর্ঘশ্বাস, কারাবন্দি জীবন আর সেইসব জীবনের হতাশা। যে জীবনগুলো বাঁচতে চায়, হাসতে চায়। অথচ মুক্তি নেই তাদের। তারা পারে না নির্বিঘ্নে শান্তির আকাশে উড়তে।
বলছিলাম অঞ্জন হাসান পবন লিখিত গল্পগ্রন্থ ‘কয়েদি’ নিয়ে। এটিতে মোট সাতটি গল্প আছে। মহানায়ক সালমান শাহকে নিয়ে লেখা মূলত একটি গল্পই কয়েদি বইয়ের মগজ অথবা হৃদপিণ্ড। বাকি গল্পগুলো বইটির অন্যান্য অঙ্গপ্রত্যঙ্গ। বইটি উৎসর্গ করা হয়েছে মহানায়ক সালমান শাহ’র নীলা চৌধুরীকে।
বইয়ের উৎসর্গ তুলে ধরছি এখানে—
যিনি এখনও লড়াই করে চলছেন
প্রিয় পুত্রের মৃত্যুর রহস্য উন্মোচনে।
সন্তান আসে, মায়ের চোখ ভেজে
সন্তান যায়, মায়ের বুক কাঁপে।
একটি রহস্যজনক কিছু লুকিয়ে আছে বইয়ের উৎসর্গেই। মোট চারটি লাইন কী দারুণ! কী করুণ! কী এক উদ্ভুত সত্য! উৎর্সগ পড়েই পাঠকের মনে প্রশ্ন জাগবে তাহলে কী সেই রহস্য, কিভাবে মারা গেলেন সালমান শাহ? মা কিভাবে আজও সেই রহস্য উন্মোচনের চেষ্টা করছেন, অথচ পারছেন না!
এই সব প্রশ্নের উত্তর দেবে বইয়ের ভিতরের গল্প। এরপর আস্তে আস্তে বইয়ের পৃষ্ঠা উল্টিয়ে ভিতরের দিকে গেলে সেখানে দেখা যায় লেখকের নিজস্ব মন্তব্য বা কিছু লেখা। লেখাটা এমন— কয়েদি গল্পের মাধ্যমে আমি চেষ্টা করেছি একটি চরিত্রের মাধ্যমে সমাজের চার দেয়ালে বন্দি কিছু নারীর বেদনার্ত জীবনকাহিনির প্রতিচ্ছবি ফুটিয়ে তুলতে।
আকর্ষণ এখানেই, প্রকট আকার ধারণ করে বইটি পড়বার। চরম বাস্তবিক কিছু সত্যকে গল্পকার গল্প বলে চালিয়ে দিয়েছেন। বইটির প্রথম গল্প, ‘শুভরাত্রি’। প্রাথমিকভাবে মনে হবে, শুভরাতকে শুভরাত্রি হিসেবে বলা হয়েছে। কিন্তু আসলে ব্যাপারটা তা না। এখানেই আছে দারুণ একক চমক। আর কী সেই চমক সেটা বুঝতে হলে পড়তে হবে বইটি।
এই গল্পে রয়েছে বেশ কিছু চরিত্র যাদের ভিতর রিফাত অদ্ভুত এবং সাইকো টাইপের। তার ভিতরে একসাথে কাজ করে কয়েকটি সত্তা। বাবা মারা যাওয়া, মায়ের ভিক্ষাবৃত্তি, সংসারের টানাপোড়ন, তার পড়াশুনা করার প্রগাঢ় ইচ্ছে, প্রেমঘটিত সমস্যা ইত্যাদি বৃত্তের ভিতরে থেকে থেকে দিনকে দিন তার মাথায় সামান্য বিদঘুটে চিন্তাভাবনা কাজ করা শুরু করে। তার মাথায় ঘুরপাক খায় আজগুবি সব প্রশ্ন—
এক. কলাগাছ একবার ফল দেয়ার পর মরে যায় কেন?
দুই. ইলিশ মাছের কলিজার ইংরেজি কী?
তিন. কলাপাতার ইংরেজি কী?
চার. যিনি প্রথম ঘড়ি আবিষ্কার কররেন, তিনি কিভাবে জেনেছিলেন তখন কয়টা বাজে?
পাঁচ. পিঁপড়াদের মগজ কোথায় থাকে?
ইত্যাদি ইত্যাদি...
প্রশ্নগুলো উত্তর কি আপনি জানেন? না জানলে পড়তে হবে ‘শুভরাত্রি’ গল্পটি। গল্পটিতে আছেন মুস্তাক আহমেদ আর নীলিমা বেগম। দুজন দুজনকে ভালোবাসেন। তাদের ভালোবাসা প্রগাঢ় অথচ, একজন আরেকজনকে ছেড়ে দূরে আছেন। তার একটাই কারন, তাদের নিজেদের মেয়ে। কী এমন কারণ? আর নিজের মেয়েই কেন এতে দায়ী? বিশাল এক রহস্য এখানেও।
গল্পে পাওয়া যাবে আরো দুজন স্বপ্ন দেখা দম্পতি— নাঈম চৌধুরী আর কথা। তারা স্বপ্ন দেখেন দুঃখ আকাশে উড়িয়ে দুঃখীদের সুখী করা। শেষপর্যন্ত তারা কি সফল হতে পেরেছিলেন? গল্পে উঠে এসেছে সমাজের পিশাচসুলভ কিছু আচরণ। রাস্তায় বসে বিকিনি বিক্রিকে কিভাবে দূর থেকে দাঁড়িয়ে কিছু অসুস্থ মগজধারীরা অশ্লীল মন্তব্য আর মেয়েদের নিয়ে বাজে মন্তব্য করে সচরাচর তার কিছু বাস্তব চিত্র।
পরকীয়া নামক অভিশাপে কিভাবে তিলে তিলে শেষ হচ্ছে পরিবার, সমাজ তাও রেহাই পায়নি লেখকের নজর এড়াতে। উঠে এসেছে পথশিশুর জীবনকথা। উঠে এসেছে হকারি, ফুটপাত বিক্রেতার কথা।
পুরো গল্পটি পড়তে পড়তে আমার কখনো মনে হয়নি এটা গল্প। তবে শেষে এসে গল্পকার গল্পটির সৌন্দর্য নষ্ট করে ফেলেছেন বলে আমার মনে হয়েছে। সবার এমনটা মনে হবে ব্যাপারটা এমনও নয়। আমার মনে হয়েছে কাকতালীয় ভাবে গল্পটির পরিসমাপ্তি হয়েছে। যেভাবে বাস্তবতার ছোঁয়া দিয়ে প্রথম থেকে লিখেছেন শেষটায় তিনি সম্ভবত তাড়াহুড়ো করে শেষ করেছেন। গল্পটি আরো আবেগী হয়ে সমাপ্ত হতে পারতো।
সবমিলিয়ে ভালো খারাপের সংমিশ্রণে ‘শুভরাত্রি’ গল্পটি একটি অসাধারণ গল্প। বইটির বাকি ছয়টি গল্প নিয়ে পড়ে না হয় বলি। ভালোবাসা রইলো ‘কয়েদি’ লেখকের প্রতি। শুভকামনা কয়েদিদের প্রতি।
‘কয়েদি’র প্রকাশক জেব্রাক্রসিং। দাশ দুশো টাকা। পৃষ্ঠা সংখ্যা একশো তিন।
লেখক: কবি
























