সুস্ময় সুমনের গল্প ‘এই রাস্তায় অনেক বেশি অ্যাক্সিডেন্ট হয়’

প্রকাশিত : ডিসেম্বর ১৭, ২০২৩

হাদিউজ্জামান হাঁপাচ্ছেন।
রিকশাঅলা বেশি জোরে টানতে পারছে না। কোথাও একটু ঝাঁকি লাগলেই পারভিন গুঙিয়ে উঠছে। সাত মাসের পোয়াতি সে। হঠাৎ করেই সন্ধ্যা থেকে ব্যথা উঠেছে। হাদিউজ্জামান তখন কেবল ঘরে ফিরেছেন। ফ্রেস হবেন বলে ওয়াশরুমে ঢুকবেন, ঠিক তখনই মেয়ের পেটে তীব্র বেদনা। হাদিউজ্জামান কী করবেন বুঝে উঠতে পারেন না। পারভিন ব্যথায় খাবি খাচ্ছে। চেহারা হয়ে উঠেছে নীল। মনে হলো শ্বাস বন্ধ হয়ে এখনই মারা যাবে।

আর কোনোদিকে তাকানোর সময় নেই। হাদিউজ্জামান সঙ্গে সঙ্গে রিকশা ডেকে মেয়েকে উঠিয়েছেন। অ্যাম্বুলেন্স ডাকতে গেলে দেরি হয়ে যাবে। এখনই পারভিনকে হাসপাতালে নিতে হবে। তিনি রিকশায় বসে ইয়া নফসি ইয়া নফসি করছেন। আর একটু সামনে এগোলেই হাসপাতাল। মেয়ে যেন এটুকু সময় টিকে থাকতে পারে।

এদিকের রাস্তাটা একটু নির্জন।
ল্যাম্পপোস্টে লাইট জ্বলে না। চাপ চাপ অন্ধকার। হাদিউজ্জামান রিকশাওয়ালাকে তাড়া দিয়ে বলেন, বাবা রে, আরেকটু জোরে চালাও না। মেয়েটা আমার আর সহ্য করতে পারছে না।
পারভীন আসলেই সহ্য করতে পারছে না। সে কোনোক্রমে দাঁতে দাঁত চেপে বাবার পাশে বসে আছে।
রিকশার একটু গতি বাড়তেই দুর্ঘটনাটা ঘটলো। পিছন থেকে আসা একটা র‌্যাভ ফোর গাড়ি লাগিয়ে দিল রিকশার সাথে।
পারভিনকে নিয়ে রাস্তার ওপর হুমড়ি খেয়ে পড়লেন হাদিউজ্জামান। মুখ দিয়ে মরণপণ আর্তচিৎকার বেরিয়ে এলো পারভিনের। পরক্ষণেই নিস্তেজ হয়ে গেল শরীর।
হাদিউজ্জামানের কাছে পুরো ব্যপারটা দুঃস্বপ্নের মতো মনে হতে লাগল। সত্যি কি তার সাথে এসব ঘটছে? বাস্তব? আজ কার মুখ দেখে উঠেছিলেন সকালে...
মেয়েকে সামলাবেন কী, হাতিউজ্জামান নিজেই তব্দা মেরে গেছেন। তবে রিকশাঅলা দৌড়ে গিয়ে আটকে ফেলেছে গাড়িঅলাকে।

.
গাড়ি চালাচ্ছিল আশরাফ। সে হালকা ড্রাঙ্ক। বয়স ত্রিশের কাছাকাছি। এক্সপোর্ট-ইমপোর্টের ব্যবসা করে। সন্ধ্যায় একটা পার্টি ছিল, সেই উপলক্ষে হালকা গলা ভিজিয়েছে। কিন্তু এত অল্প খেয়ে এভাবে অ্যাক্সিডেন্ট করে বসবে, সেটা কস্মিনকালেও ভাবতে পারেনি।
রিকশাঅলার সাথে সাথে নুরু নামের এক যুবকও হাজির হয়ে গেছে। সে সোজা কলার চেপে ধরেছে আশরাফের। ঝট করে মাথায় রক্ত উঠে যায় তার। কিন্তু নুরু নামের ওই যুবক যখন চিৎকার করে বলে উঠল, করছস কী তুই নাটকির পো? মানুষ খুন কইরা ফালাইছস!

তখন কেমন যেন হাত-পা অসাড় হয়ে আসর আশরাফের। গলা শুকিয়ে কাঠ। সে কোনোরকমে বলতে পারল, আমার কোনো দোষ নাই, ভাই। রিকশাটা হঠাৎ করে...
ঠাস্।
একটা চড় এসে পড়ল তার গালে।
কানে তালা লেগে গেল আশরাফের। নুরু লোকটা তার কথা শেষ হওয়ার আগেই ঠাঁটিয়ে চড় বসিয়ে দিয়েছে।

আশরাফের একবার ইচ্ছা হলো তালপাতার সেপাই নুরুকে ঝেঁড়ে একটা লাথি কষিয়ে দেয়। তারপর দ্রুত গাড়িতে স্টার্ট দিয়ে সামনে এগোলেই কিসসা খতম।

হঠাৎ সামনের দৃশ্যটা দেখে পাথরের মতো জমে গেল সে। পোয়াতি মেয়েটাকে জড়িয়ে ধরে হাউমাউ করে কাঁদছে মধ্যবয়স্ক এক লোক। মেয়েটার জামাই কিংবা বাপ হবে। মেয়েটা নড়ছে না। চিকন সুতোর মতো একটা রক্তের ধারা ভেসে আসছে মেয়েটার পাজামার ফাঁক দিয়ে।

মাথার ভেতর বিপদ সংকেত বেজে উঠল আশরাফের। মন বলল, যতদ্রুত সম্ভব এখান থেকে পালাতে হবে।
ভাই, আমি টাকা দিচ্ছি... কোনোরকমে তড়বড় করে বলল আশরাফ। প্লিজ, আপনারা দেরি করবেন না। উনাকে জলদি কোনো হসপিটালে নেওয়ার ব্যবস্থা করেন!

নাটকির পোলায় কয় কী! মারমুখি ভঙ্গিতে খিস্তি করে উঠল নুরু। মানুষ মাইরা আবার ট্যাকার গরম দেহাস। তরে আইজ খাইছি!
নুরু কাউকে খোঁজার জন্য এদিক ওদিক তাকাচ্ছে। তবে এলাকাটা নির্জন। লোকজন নেই আশপাশে। থাকলে এতক্ষণে কেলেঙ্কারি যা হওয়ার হয়ে যেত। শুধু রিকশাঅলাটা কোমর চেপে একপাশে দাঁড়িয়ে আছে। বোধহয় কোমরে ব্যথা পেয়েছে।

আমার সাথে পরেও ঝামেলা করতে পারবেন, ভাই, আবারো কঁকিয়ে উঠল আশরাফ, কিন্তু উনাকে তো হসপিটালে নেওয়া দরকার...
আশরাফ বুঝতে পারছে এখানে টাকা দিয়ে ছাড় পাওয়া যাবে না। এরা তাকে পুলিশে ধরিয়েই ছাড়বে।
আচ্ছা, তার কি এখন উচিত নিজের গাড়িতে করে ওই মেয়েটা আর লোকটাকে হাসপাতালে পৌঁছে দেওয়া?
কেমন যেন হাঁপানি উঠে যাচ্ছে। ভয় ছড়াচ্ছে সারা শরীরে।
ভাই, প্লিজ, আপনাদের হাতে কিন্তু সময় কম...

আবার মারার জন্য হাত বাড়াচ্ছিল নুরু, তার আগেই মুখ সরিয়ে নিল আশরাফ। সে জানে একটা ধাক্কা দিলেই তালপাতার সেপাইটা পাচঁ হাত দূরে গিয়ে পড়বে। কিন্তু কেন যেন মন সায় দিল না।
এক ঝটকায় পকেট থেকে মানিব্যাগ বের করল আশরাফ। তারপর সেখান থেকে যা টাকা আছে পুরোটা বের করে ছুঁড়ে দিল নুরুর মুখের ওপর।
এই টাকাগুলা রাখেন। প্লিজ, আমার সাথে ঝামেলা করবেন না। আমাকে যেতে দেন!

টাকাগুলো নুরুর মুখে এসে লেগেছে।
থমকে গেছে নুরু।
মুহূতের্র জন্য থমকে গেল বাকি সবকিছুও। আর এটুকু সময়ই যেন আশরাফের জন্য যথেষ্ট। সে চোখের নিমেষে গাড়ি টান দিয়ে হুশ করে বেরিয়ে গেল।

পারভিন মেয়েটা মরে পড়ে আছে রাস্তায়। তার বৃদ্ধ বাবা তাকে জড়িয়ে ধরে কাঁদছে। রিকশাঅলা লোকটা কী করা উচিত বুঝতে না-পেরে পাছা চুলকাচ্ছে। আর নুরু ধীরেধীরে টাকা কুড়াচ্ছে রাস্তা থেকে...

.
একটা ঘর। আধো আলোছায়া। ধোয়ার রাশি পাক মারছে চতুর্দিকে।
এরই মাঝে দেখা যাচ্ছে লোকটাকে। দেখতে হুবহু হাদিউজ্জামানে মতো। ইয়াবা টানার মগ্নতায় ডুবে আছে সে। তার প্রায় কোলের ওপর উঠে বসে গুটি খাচ্ছে একটা মেয়ে। তার চেহারা পারভিনের মতো। তবে পার্থক্য হলো, এর পেটে কোনো সন্তানের অস্তিত্ব টের পাওয়া যাচ্ছে না। রিকশঅলা করিম চিৎ হয়ে পড়ে আছে একপাশে। বাংলা মদ আর গুটি একসাথে খেয়ে বেহুঁশ হয়ে গেছে সে। আর একদিকে নুরু...

আর একদিকে নুরু ভাবছে...এরপরের প্ল্যানটা কী করা যায়? গতকাল মাঙ্গের পোলার কাছ থেকে তো বেশি টাকা ম্যানেজ করা যায়নি। তার বোন আর দুলাভাই এই টাকা বেশিদিন রাখতে পারবে না।...বোনটা যেভাবে দুলাভাইয়ের কোলে উঠে বসে মাল খাচ্ছে তাতে তো মনে হচ্ছে...
নাহ্, ঝুটা বাপ-মেয়ের সম্পর্ক দেখিয়ে, অ্যাক্সিডেন্টের খেলা খেলে আর চলবে না। এবার নতুন কোনো প্ল্যান ভাবতে হবে।
ওই রাস্তায় নতুন করে আর কোনো অ্যাক্সিডেন্ট ঘটানো যাবে না...