সৌদি আরব বনাম ভারত: করোনাকালে কার ভূমিকা কতটা প্রগতিশীল

রাহমান চৌধুরী

প্রকাশিত : জুন ১১, ২০২১

প্রায় সময় আমরা আমাদের দৃষ্টিভঙ্গিকে একপেশে করে রাখি। ফলে অনেক সময় সত্য অনুসন্ধান আর করা হয় না। মুসলমানরা কট্টর, বিজ্ঞানমনস্ক নয়; এ কথাটা বাজারে খুব চালু। কথাটা যে একেবারে মিথ্যা তাও নয়। সার্বিকভাবে মুসলমানদের বৃহৎ একটা অংশ বহুদিন ধরে কুসংস্কার আচ্ছন্ন আর বিজ্ঞানবিরোধী চিন্তাকে লালন করছে। কিন্তু সেটাই সব সত্য নয়। মুসলমানদের চেয়ে আরো কুসংস্কারাচ্ছন্ন মানুষ, আরো ধর্মীয়ভাবে কট্টর এবং উন্মাদ মানুষ কি বিশ্বে আর নেই? কিন্তু তাদের কথা খুব আলোচনায় আসেনা কেন? আমাদের তথাকথিত প্রগতিশীলরা তা বলার সময় আমরা পিছপা কেন? মুসলমানদের চেয়ে আরো ভয়াবহ কুসংস্কার আচ্ছন্ন মানুষরা কেন তাদের দৃষ্টির আড়ালে চলে যায়, ভিন্ন দিকে বারবার মুসলমানদেরকেই কেন কট্টর আর ধর্মান্ধ হিসেবে দেখানো হয়? মুসলমানদের অন্ধত্বের পক্ষ নেয়া এ কথাগুলি বলার লক্ষ্য নয়। লক্ষ্য সত্য অনুসন্ধান। মুসলমানরা যে মধ্যযুগে যথেষ্ট প্রগতিশীল ভূমিকা রেখেছিল সে কথাটা বলাও এখানে লক্ষ্য নয়। ভিন্ন একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রসঙ্গ অবতারণা না করে পারা গেল না করোনা মহামারীর কথা মাথায় রেখে। করোনা মহামারীর সময় ইসলামের সুতিকাগার সৌদি আর রাষ্ট্র হিসেবে বৃহৎ ভূখণ্ড ভারতের মধ্যে কার ভূমিকা ছিল সার্বিকভাবে বিজ্ঞানমনস্ক?

যখন সার্স ২ বা কোভিড ১৯ ছড়িয়ে পড়তে শুরু করে মধ্যপ্রাচ্যের মুসলিম দেশগুলি খুবই ইতিবাচক ভূমিকা রাখে। লক্ষ্য করলে দেখা যাবে সৌদ আরবের মানুষদেরকে অনেকেই মনে করে বর্বর। যদিও সেমিটিকরা একটি অনেক পুরানো সভ্যতার ধারক, তা সত্ত্বেও সৌদি জনগণ বা সৌদি আরব দেশটি নিয়ে মানুষের মনে খুব ভালো ধারণা নেই। কিন্তু করোনা ভাইরাস সংক্রমণ প্রতিরোধে বলা যাবে সৌদি আরব একটি যুগান্তকারী বা ঐতিহাসিক পদক্ষেপ নিয়েছে। ইসলাম ধর্মের সূতিকাগার আর ইসলামের পয়গম্বরের জন্ম যেখানে, সেই সৌদি আরব প্রথমেই কাবা শরীফ বন্ধ ঘোষণা করে। মসজিদে গিয়ে নামাজ পড়া নিষিদ্ধ করে দেয়। সকল সময় বলা হয়, ইসলাম একটি কট্টর ধর্ম। বলা হয়, মুসলমানরা অন্ধ আর কুসংস্কারাচ্ছ; যাদের জ্ঞানবিজ্ঞানের প্রতি সামান্য আগ্রহ নেই। করোনা ভাইরাসের আক্রমণে সারা বিশ্বে সবচেয়ে ইতিবাচক পদক্ষেপটি গ্রহণ করে কিন্তু সেই সৌদি আরব। ধর্মীয় সমস্ত কুসংস্কারকে বাতিল করে বিজ্ঞানসম্মত পথ ধরে হাঁটতে শুরু করে। রাষ্ট্রের ভিতরে কারো সাহস হয়নি তার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করা। ধর্ম পালন রাষ্ট্র নিষেধ করেনি, ধর্ম পালনের সম্পূর্ণ স্বাধীনতা সকলের ছিল। কিন্তু ধর্ম সৌদি আরবের মানুষের স্বাস্থ্যসেবার উপর প্রভুত্ব বিস্তার করতে পারেনি। স্বাস্থ্য বা মানুষের জীবন আগে তারপরে ধর্মীয় বাড়াবাড়ি। সৌদি আরবে গত বছর হজ্জ পালিত হয়নি আর সম্ভবত আগামী বছরে হজ্জ পালিত হবে না করোনা ভাইরাস সংক্রমণ প্রতিরোধের কারণে। কিন্তু হজ্জ সৌদি আরবের একটি বড় উপার্জনের জায়গা। সৌদি আরব সেটা নিয়ে সামান্য মাথা ঘামাচ্ছে না। স্বীকার করতেই হবে, করোনা ভাইরাসের আক্রমণ প্রতিরোধে সৌদি আরব বহু বিজ্ঞানসম্মত দেশের চেয়ে নিজের বিজ্ঞাসমনস্কতার পরিচয় দিয়েছে।

বিষয়টা লোক দেখানো ব্যাপার ছিল না। সৌদি আরব করোনা আক্রমণের ভয়াবহতা বুঝতে পেরেছিল। ধর্ম পালনের নাম করে জনগণকে জমায়েত করতে দিলে যে প্রাণহানী ঘটবে, রাষ্ট্র সেটা বুঝতে পেরেছিল। রাজতন্ত্র সম্পর্কে যতোই নেতিবাচক হোক মানুষের ধারণা, সৌদি রাজপরিবার জনগণের জানমাল নিয়ে যে দুশ্চিন্তা করে তার প্রমাণ রেখেছে। গণতান্ত্রিক বহু দেশ তার জনগণের নিরাপত্তা বিধানে সেটুকু করার চেষ্টা দেখায়নি। ফলে সৌদি আরবকে চট করে বর্বর বলার আগে বহুবার বিবেচনা করতে হবে, রাজতন্ত্র তার প্রজার জন্য যা পেরেছে, ভারত এবং বাংলাদেশ সহ বহু রাষ্ট্রের সরকার কি জনগণের মঙ্গলের জন্য সেরকম কোনো উদাহরণ সৃষ্টি করতে পেরেছে? জনগণের মঙ্গলের জন্য সৌদি আরব ধর্মীয় স্পর্শকাতর বিষয়গুলিকে সামান্য পাত্তা দেয়নি। জুম্মার নামায, ঈদের জামাত সব বাতিল করে দিয়েছে। কিন্তু সকল রকম জমায়েত নিষিদ্ধ করার পরেও দেখা যাবে, সেখানে আক্রান্তের সংখ্যা ছিল প্রথম দিকে অনেক। সাড়ে তিন কোটি মানুষের দেশে আক্রান্তের সংখ্যা প্রায় সোয়া লাখ। যদি কাবা শরীফে নামাজ পড়া, উমরাও করার অধিকার দান, জুম্মার নামাজ আদায় করা ইত্যাদি ধর্মীয় বিষয়গুলি চালু রাখা হতো তাহলে আক্রান্তের সংখ্যা কতোগুণ বাড়তো? ফলে সরকার যথাসময়ে সঠিক সিদ্ধান্ত নিয়েছিল। কিন্তু সবচেয়ে বিস্ময়ের ব্যাপার, যখন রচনাটি তৈরি হচ্ছে তখন সৌদি আরবে আক্রান্ত জনসংখ্যা হলো ১১২২৮৮ আর মৃতের সংখ্যা মাত্র ৮১৯। সৌদি আরবকে কি তাহলে বর্বর দেশ বলা যাবে? জন বিচ্ছিন্ন দেশ বলা যাবে? করোনা আক্রমণের প্রথম দিকে যখন সৌদি আরবে মৃতের সংখ্যা ৮১৯ তখন কানাডাতে আক্রান্ত ৯৭১২৫ জনের মধ্যে মৃতের সংখ্যা ৭৯৬০।

মধ্যপ্রাচ্যের আরো কয়েকটি দেশ সম্পর্কে এখানে আলোচনা করার ইচ্ছা আছে। করোনা রোগ বিস্তারের প্রথম পর্বে কাতারে আক্রান্তের সংখ্যা ৭৩৫৯৫ আর মৃতের সংখ্যা মাত্র ৬৬। ইউনাইটেড আরব আমিরাতে আক্রান্তের সংখ্যা ৪০৫০৭ আর মৃতের সংখ্যা ২৮৪। কুয়েত আক্রান্তের সংখ্যা  ৩৩৮২৩, মৃতের সংখ্যা ২৭৫। ওমানে আক্রান্তের সংখ্যা ১৮৮৮৭, মৃতের সংখ্যা ৮৪। সবগুলি দেশের সংখ্যা যদি যোগ করে মিলিয়ে দেখা হয়, তাহলেও মৃতের শতকরা হার এক শতাংশ হচ্ছে না। দাঁড়াচ্ছে মাত্র ০.৬ এর কাছাকাছি। কিন্তু সারা বিশ্বের গড় মৃতের হার সেখানে ৫ শতাংশের বেশি। সবচেয়ে বেশি মৃতের হার ফ্রান্সে প্রায় আঠারো শতাংশের বেশি, ব্রিটেনে ১৪ শতাংশের বেশি, স্পেনে ১০ শতাংশের মতো। ব্যাপারটা কি তাহলে এমন হতে পারে যে, সৌদি বা মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলি মার্স ভাইরাসের আক্রমণের পর এ ব্যাপারে প্রস্তুতি নিয়ে রেখেছিল বা মার্স ভাইরাসের আক্রমণের অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগিয়েছে? না হলে এরকম সাফল্য খুব সচরাচর ঘটে না। যদি লক্ষ্য করি দেখা যাবে ভিয়েতনাম, সিঙ্গাপুর সবচেয়ে বেশি সাফল্যের পরিচয় দিয়েছে। দ্বিতীয় বৃহত্তম ঘনবসতিপূর্ণ শহর সিঙ্গাপুরে আক্রান্তের সংখ্যা ৩৯৩৮৭ জন হলেও মৃতের সংখ্যা মাত্র ২৫ জন। ভিয়েতনামে মৃতের সংখ্যা নেই আর আক্রান্তের সংখ্যা দীর্ঘদিনেও সাড়ে তিনশোর বেশি হতে দেয়নি। বিষয়টা কি এমন কিছু যে, সার্স ১ এর অভিজ্ঞতা তাদেরকে এ ব্যাপারে সতর্ক হতে সাহায্য করেছিল। করোনা নিয়ন্ত্রণে সব মিলিয়ে এশিয়ার সাফল্য পাশ্চাত্যের চেয়ে বহুগুণ বেশি। মৃতের সংখ্যা পাশ্চাত্যের চেয়ে প্রাচ্যে অনেক কম। নিশ্চয় এর কারণ নিয়ে পরবর্তীত বিজ্ঞানীদের গবেষণা করার সুযোগ থাকবে। মার্স সম্পর্কে তখন বিশ্ব স্বাস্থ্য তখনি একটি ভবিষ্যত বাণী করেছিল যে, মার্স ভাইরাসটি পরে আরো বড় মহামারী আকারে বিশ্বে আবার দেখা দিতে পারে। সে কারণে এ নিয়ে গবেষণার প্রস্তাবও রেখেছিল। কিন্তু বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার সে প্রস্তাব ধনী দেশগুলির কাছে গুরুত্ব পায়নি। বিশ্বের ধনী দেশগুলি নিজেরাও গবেষণায় তেমন আগ্রহ দেখায়নি। কিন্তু তখন থেকে গবেষণা চালিয়ে গেলে বর্তমানে করোনা ভাইরাসের আক্রমণে বিশ্বের সকল দেশকে এভাবে দিশেহারা হতে হতো না।

যদি আমরা পাশাপাশি ভারতের দিকে তাকাই তাহলে কী দেখি? ভারত কি করোনাকালে তার ধর্মপ্রতিষ্ঠানে মানুষের সমাগম নিষিদ্ধ করেছে বা করতে পেরেছে বা করতে চেয়েছে? ধর্মপ্রতিষ্ঠানের প্রচারিত নানা কুসংস্কার যা করোনা বৃদ্ধির সহায়ক, তার ব্যাপারে ভারত সরকারের দৃষ্টিভঙ্গি কী ছিল? সামগ্রিকভাবে জনগণের ভূমিকাটাই বা কী ছিল? ভারতের ধর্ম প্রতিষ্ঠান থেকে সেখানে বহুক্ষেত্রে বলা হয়েছে গরুর মলমূত্র মানুষকে রক্ষা করবে। কিছু রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে যুক্ত মানুষরা তাকে পৃষ্ঠপোষকতা করেছে। সরকার এ কাজে বাধা দিয়েছে বলে জানা যায় না। বরং সরকার পক্ষের লোকদের অনেকের এ ব্যাপারে সমর্থন ছিল। বর্তমান সভ্য যুগে ভারতের মানুষ গায়ে গোবর মেখেছে করোনার হাত থেকে রক্ষা পাবার জন্য। করোনা দেবির মন্দির বা নতুন করে করোনা দেবিকে পূজা করার খবর পর্যন্ত এসেছে। দুটো দেশের দিকে তাকালে সার্বিকভাবে কার ভূমিকা প্রগতিশীল আর বিজ্ঞানমনস্ক?

ভারতের কিছু মানুষের সারা গায়ে গোবর মাখার ফলাফল এখন কী দাঁড়িয়েছে। বর্তমান যুগে দাঁড়িয়ে ভারতের মানুষ শুধু গোরক্ষার কথা বলছে না, গরুর মূত্র পান করছে। বিশ্বে এরকম কুসংস্কার কটা দেশে পাওয়া যাবে। ভারত সরকার আর তার শিক্ষিত সমাজের ভূমিকা কী এটাকে বাধা দেয়ার ক্ষেত্রে? পশ্চিমবঙ্গে বামফন্ট্রের জমানায় বহু সরকারী কার্যালয়ে দেবদেবী আর কালীর মূর্তি চোখে পড়েছে। বহু বামফ্রন্টের সাথে যুক্ত তথাকথিত প্রগতিশীল মানুষের গৃহে লোকনাথ সহ কালী দেবীর পূজা হতে দেখেছি। কালীর পূজক রামকৃষ্ণকে তো বহুমানুষ মাথায় করে রাখে নিজেদের পূজনীয় হিসেবে। সাধারণ জনগণকে দোষ দিয়ে লাভ নেই। শিক্ষিত মানুষের বিরাট সংখ্যকরা ধর্মীয় কুসংস্কার আর জাতপাত খুব মেনে চলে। বর্তমান সরকার ধর্মের বুলি আউরিয়ে আর হিন্দুত্বের পক্ষে দাঁড়িয়ে সে-কারণেই বারবার ক্ষমতায় আসতে পেরেছে। ভারতের শিক্ষিতদের বড় একটা অংশ হিন্দুত্বের বা হিন্দুরাষ্ট্রের পক্ষে। না হলে বর্তমান সরকার ক্ষমতায় টিকে থাকে কী করে?

ভারত রাষ্ট্র্রের সত্যিকারের প্রগতিশীল মানুষরা, যাদের সংখ্যা ভারতে খুব কম; তাঁরা অসম্ভব প্রাণপণ সাধ্য করে নানারকম ইতিবাচক ভূমিকা রাখছেন। জ্ঞানবিজ্ঞানের জগতে তাঁদের অবদান অনেক। জ্ঞানবিজ্ঞান চর্চায়, চিন্তাচেতনায় তাদের উদাহরণ খুব কম মিলবে সারা বিশ্বে। ভারতের কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয়ে এমনকি কিছু কিছু মহাবিদ্যালয়ে কিছু কিছু জ্ঞানী মানুষকে পাওয়া যাবে, সারা বিশ্বের তুলনায় যাঁদের ইতিহাসবোধ অনেক বেশি ধারালো। কিন্তু কজন তাঁদের কথা বা লেখনিকে গুরুত্ব দেয়? বাকিরা তাঁদের পাত্তা না দিলেও, নিজের মতো করে তাঁরা কাজ করে চলেছেন ইতিহাসের প্রগতিশীল ধারাকে টিকিয়ে রাখবার জন্য। কিন্তু বাকি বিরাট সংখ্যক তথাকথিত শিক্ষিত আর কুসংস্কার আচ্ছন্ন মানুষরা বড় বড় কথা বলছে বটে কিন্তু কুসংস্কার ছাড়তে পারছে না। মুসলমানদের পশ্চাদপদতা নিয়ে সর্বক্ষণ বিষোদগার করছে, কিন্তু নিজেদের পশ্চাদপদতা দেখতে নারাজ। ভারতে প্রাতিষ্ঠানিকভাবে শিক্ষিত মানুষের সংখ্যা তো একেবারে কম নয়। যথেষ্ট মেধাবী তাঁদের মধ্যে একদল মানুষ। যদি তাঁরা সকলে বিজ্ঞানমনস্ক হতেন তাহলে কি ভারতের মানুষ করোনা রোগের চিকিৎসা হিসেবে গরুর মূত্র পান করতে পারে? গায়ে গোবর মাখতে যাবে কোন্ দুঃখে যদি শিক্ষিতরাই কুসংস্কারে আচ্ছন্ন না হবেন? ভারতের তথাকথিত শিক্ষিতরা কতোটা জাতপাত আর কুসংস্কারে বিশ্বাসী তার প্রমাণ ভীমরাও আম্বেদকরের লেখনী আর তার জীবনের নানা ঘটনা। স্বাধীনতার সত্তর বছর পরেও ভারতের মতো এত বৈচিত্রপূর্ণ সংস্কৃতির অধিকারী দেশ, যে দেশে কত বড় বড় মনীষীরা জন্মেছেন, সেখানে কী করে এরকম কুসংস্কার টিকে থাকে? কারা টিকিয়ে রাখে?

সবসময় কথা বলার আগে আমাদের নিজেদের দৃুষ্টিভঙ্গিকে প্রশ্ন করতে হবে, প্রয়োজন মতো দৃষ্টিভঙ্গি পাল্টাতে হবে। ভারতে মহামারীর আকারে ব্লাক ফাঙ্গাস ছড়িয়ে পড়ার কারণ বলা হচ্ছে, মানুষের শরীরে দুষিত গোবরা মাখা। ভারতের ধর্মীয়ভাবে বিশ্বাসী বহু মানুষের কাছে যা খুবই পবিত্র সম্পদ তা হলো গরুর গোবর আর মূত্র। করোনায় তার নেতিবাচক প্রভাব লক্ষ্য করা গেছে ভয়াবহভাবে। করোনা ব্যবস্থাপনায় ভারত আর সৌদি আরবের মধ্যে আসলে কার ভূমিকা অধিক ইতিবাচক? ভারতের জনসংখ্যা সৌদি আরবের প্রায় চল্লিশ গুণ। ভারতে করোনায় আক্রান্ত মানুষের সংখ্যা বর্তমানে প্রায় তিনকোটির কাছাকাছি। মৃতের সংখ্যা তিনলাখ তেষট্টি হাজার। করোনায় আক্রান্তের দিক থেকে ভারতের অবস্থান এখন দ্বিতীয়। ভিন্ন দিকে সৌদি আরবে আক্রান্তের সংখ্যা চার লাখ বাষট্টি হাজার পাঁচশো আটাশ। মৃতের সংখ্যা সাড়ে সাত হাজার। প্রথম দিকে সৌদি আরবে আক্রান্তের সংখ্যা ছিল সোয়া একলাখ, এক বছরের বেশি সময় পর তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে সাড়ে চার লাখের বেশি। ভারতে সে তুলনায় প্রথম দিকের তুলনায় আক্রান্তের সংখ্যা কতগুণ বেশি বেড়েছে?

স্মরণ রাখতে হবে, সৌদি আরবের চেয়ে ভারতের লোক সংখ্যা চল্লিশ গুণ বা তার চেয়ে সামান্য কম। যদি সে বিচারে সে হার মাথায় রেখে দেখা হয়, তাহলেও সৌদি আরবে আক্রান্তের সংখ্যা আর মৃতের সংখ্যা ভারতের চেয়ে যথেষ্ট কম। বিশেষ করে আক্রান্তের সংখ্যা ভারতের তুলানায় চৌষট্টি শতাংশ। ভারত আক্রান্তের তালিকার দিক থেকে সৌদি আরবের চেয়ে প্রথম বেশ নীচে ছিল। পরে লাফিয়ে লাফিয়ে উপরে উঠে যায়। বর্তমানে তালিকার দ্বিতীয়। ভারতের চিকিৎসকরা বরং সেক্ষেত্রে অনেক বেশি সাফল্য রেখেছেন। মৃতের সংখ্যা তাঁরা আক্রান্তের তুলনায় অনেক কমিয়ে রাখতে পেরেছেন। কিন্তু মানুষের আক্রান্ত হবার সংখ্যা আটকবার ক্ষমতা ভারতের চিকিৎকদের হাতে ছিল না। সেটা ছিল রাষ্ট্রের ব্যবস্থাপনার হাতে। যদি রাষ্ট্র বা প্রশাসন সে ক্ষেত্রে ইতিবাচক ভূমিকা রাখতে পারতো, জনগণ নিশ্চয় কুসংস্কারের পথে হাঁটতেন না। ভারতের জনগণ নানারকম কুসংস্কারের শিকার না হতেন, তাহলে আক্রান্তের সংখ্যা এবং মৃতের সংখ্যা অনেক কমে যেতো ভারতে।

নিজেদের দৃষ্টিভঙ্গিকে বিচার করার জন্য এই কথাগুলি বলা। বিশেষ কোনো রাষ্ট্রের প্রতি বা তার জনগণের প্রতি বিদ্বেষ থেকে নয়। যাঁরা অন্ধের মতো নানারকম মতামত দিয়ে বসেন, যদি আক্রমণ করে থাকি তাঁদেরকেই করেছি। যাঁরা নিজের বিভ্রান্তিকর মতামতের দ্বারা মানবতার ক্ষতি করছেন, তাঁদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে বা মতাদর্শগত সংগ্রাম চালাতে আমার আপত্তি নেই।

লেখক: শিক্ষাবিদ ও প্রাবন্ধিক