সৌদিতে সাংস্কৃতিক পরিবর্তন
স্বকৃত নোমানপ্রকাশিত : মার্চ ০৭, ২০১৮
উসমানীয় সামরিক কর্মকর্তা মোস্তফা কামাল আতাতুর্ক যেমন তুরস্ককে রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিকভাবে বদলে দিয়েছিলেন, তেমনি ক্রাউন প্রিন্স মোহাম্মদ বিন সালমান বদলে দিচ্ছেন সৌদি আরবকে। ইসলামের উন্মেষের দেশ, ইসলামের নবির দেশ, কট্টর ইসলামি রাষ্ট্র সৌদি আরবের এই সাংস্কৃতিক পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে কি গোটা মুসলিম বিশ্বে একটা পরিবর্তন আসবে না? হ্যাঁ, নিশ্চয়ই আসবে। তুরস্কের পরিবর্তনের অভিঘাত কিন্তু গোটা মুসলিম বিশ্বে পড়েছিল। সৌদি আরবকে মুসলিম বিশ্ব ‘কেবলা’ মানে। মক্কার দিকে ফিরে মুসলমানরা নামাজ আদায় করে। সেই কেবলায় পরিবর্তন এলে মুসলিম বিশ্বে যে অনিবার্যভাবেই পরিবর্তন আসবে, তাতে কোনো সন্দেহ নেই। সৌদির এই সাংস্কৃতিক পরিবর্তনের নেতৃত্ব দিচ্ছেন যুবরাজ সালমান। এই পরিবর্তনকে কি বিপ্লব বলা যাবে না? আমার মনে হয়, এটিও এক ধরনের বিপ্লব। সাংস্কৃতিক বিপ্লব। বদ্ধ কুয়া থেকে আরব জাতিকে মুক্ত ময়দানে নিয়ে আসবার বিপ্লব।
কী কী পরিবর্তন করেছেন বা করবেন যুবরাজ সালমান? রক্ষণশীলতার খোলস থেকে সৌদিকে বের করে মধ্যপন্থী, উন্মুক্ত ইসলামি রাষ্ট্রে পরিণত করার ঘোষণা দিয়েছেন সালমান। দেশের অর্থনীতিকে খোল-নলচে বদলাতে চান তিনি। তেল নির্ভরতা কমিয়ে নয়া উদারনীতির দিকে যেতে চান। বিশ্বের সব ধর্মের মানুষের জন্য সৌদি আরবের দরজা খুলে দিতে চান। কী বিস্ময়কর! কী যুগান্তকারী পরিবর্তন! ৫০০ বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ করে মিশর ও জর্দানের সঙ্গে স্বতন্ত্র অর্থনৈতিক জোন গঠন করবেন তিনি। যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সৌদির সম্পর্ককে আরো নিবিড় করবেন। মস্কোর সঙ্গেও দীর্ঘ দিনের শত্রুতা ঘুচিয়ে বন্ধুত্বের পথে হাঁটা শুরু করেছে রিয়াদ। শত্রুরাষ্ট্র ইসরায়েলের জন্য খুলে দেয়া হয়েছে সৌদির আকাশ। যে মুসলিম বিশ্ব ইসরায়েলকে শত্রুরাষ্ট্র গণ্য করত, সেই ইসরায়েলের সঙ্গে বন্ধুত্বের হাত বাড়াল সৌদি! ধর্মান্ধ মুসলমানদের গালে কী ভয়ংকর চপেটাঘাত! এটা ঐতিহাসিক ঘটনা।
অপরদিকে, সাড়ে ২৬ হাজার বর্গকিলোমিটার এলাকাজুড়ে সৌদিতে একটি শহরের পরিকল্পনা করা হচ্ছে, যার নাম হবে নিওম। লোহিত সাগরের উপকূলীয় এলাকায় নির্মিতব্য এ শহরটি হবে গোটা বিশ্বের প্রযুক্তি গবেষণার রাজধানী, সামাজিক বিধিনিষেধ থেকে মুক্ত ও যানজটমুক্ত একটি শহর। নিওম হবে ভবিষ্যৎ বিশ্বের স্বপ্নদ্রষ্টাদের শহর। নিওম শহরে উত্তর-আধুনিক বিশ্বের স্বপ্ন দেখাচ্ছেন সালমান। ‘নো রেসট্রিকশন, নো ডিভিশন, নো এক্সকিউজেস, এন্ডলেস পোটেনশিয়ালস’ নীতিতে চলবে এই শহর। অর্থাৎ কোনো বিধিনিষেধ নয়, কোনো বিভাজন নয়, কোনো অজুহাতও নয়, শুধু সীমাহীন সম্ভাবনার শহর হবে নিওম। এই শহরে পুরুষের সঙ্গে নারীরাও একসঙ্গে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে কাজ করবে। তাদের মাথায় থাকবে না কোনো হিজাব। সৌদি আরবে নারীর অধিকারের প্রশ্নেও এসেছে পরিবর্তন। নারীরা ভোট দিতে পারবে এবং নির্বাচনে প্রার্থীও হতে পারবে। আগামী জুন মাস থেকে নারীরা গাড়িও চালাতে পারবে। সৌদি আরবের সকল কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রীরা মোবাইল ব্যবহার করতে পারবে। স্টেডিয়ামে বসে নারীরা খেলাও দেখতে পারবে।
কী অভাবনীয় পরিবর্তন। সালমান কেন করছেন এসব পরিবর্তন? পশ্চিমা দেশগুলোকে খুশি করবার জন্য? বিনিয়োগকারীদের আকৃষ্ট করবার জন্য? হোক খুশি করবার জন্য, হোক আকৃষ্ট করবার জন্য। যে কারণেই হোক, এই পরিবর্তন সম্পূর্ণ ইতিবাচক। সৌদি আরবের এই সাংস্কৃতিক পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে একদিন হয়তো এই দেশটিতে বহুত্ববাদী সমাজ প্রতিষ্ঠিত হবে, বিভিন্ন ধর্মের মানুষ হয়তো সহাবস্থান করতে পারবে, শিয়াদের ওপর নিপীড়নও হয়তো বন্ধ হবে। তার মানে একটা প্রদীপ জ্বলে উঠেছে সৌদি আরবে। এই প্রদীপ হয়তো মুসলিম বিশ্বের অন্ধকারকে কিছুটা হলেও কমাবে। পৃথিবীর কট্টর মুসলমানরা তাদের কট্টরতার পক্ষে এতদিন সৌদি আরবকে রেফারেন্স হিসেবে ব্যবহার করত। ভবিষ্যতে আর পারবে না। তারা ধীরে ধীরে সমবেত হতে থাকবে ওই প্রদীপের তলে। সৌদির এই পরিবর্তনের অভিঘাত নিশ্চিতভাবেই বাংলাদেশেও পড়বে। এটা অনেক বড় ঘটনা। ইসলামের ইতিহাসে মোহাম্মদ বিন সালমান নিজের নামটিকে অক্ষয় করতে চলেছেন। তাকে অভিনন্দন।
লেখক: কথাসাহিত্যিক