সংগৃহীত ছবি

সংগৃহীত ছবি

স্লোভেনিয়া: ইউরোপের যে ছোট্ট দেশটির প্রতি সবার আগ্রহ

নিজস্ব প্রতিবেদক

প্রকাশিত : ফেব্রুয়ারি ১৮, ২০২৪

স্লোভেনিয়া—পূর্ব এবং পশ্চিম ইউরোপের মধ্যকার সেতু রচনা করা ছোট্ট একটা দেশ। দেশটি নয়নাভিরাম প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের জন্য; বিশেষ করে বিভিন্ন পাহাড়—পর্বত, হৃদ এবং স্কি রিসোর্টের জন্য অত্যন্ত সুপরিচিত। ভৌগোলিকভাবে মধ্য ইউরোপে অবস্থিত এ দেশটি এক সময় সাবেক যুগোস্লাভিয়ার অংশ ছিল।

দেশটির রাজধানীর নাম লুবলিয়ানা। শহরটির নামের ইংরেজি অনুবাদ করলে দাঁড়ায় “দ্য লাভড ওয়ান”। স্লোভেনিয়ার সাধারণ মানুষ তাদের শহরগুলোকে খুবই ভালোবাসে এবং এ কারণে তারা তাদের রাজধানীর এমনটি নামকরণ করেছে। লুবলিয়ানা দেশটির প্রধান শহর এবং যাবতীয় প্রশাসনিক ও সাংস্কৃতিক কার্যকলাপের প্রধান কেন্দ্রবিন্দু, অত্যন্ত ছোটো একটি শহর এবং পায়ে হেঁটে এক ঘণ্টার মধ্যে পুরো শহরের গুরুত্বপূর্ণ অংশগুলোর স্বাদ নিতে পারবেন।


দেশটির অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ নগরীর মধ্যে রয়েছে মারিবোর, ক্রান, ছেলইয়ে, নভো মেস্তো, কপার এবং নোভা গরিছা। টোলার এক সময় দেশটির জাতীয় মুদ্রা হিসেবে পরিচিত থাকলেও ২০০৭ সাল থেকে দেশটির জাতীয় মুদ্রা হিসেবে ইউরো গৃহীত হয়। এক সময় কমিউনিজমভিত্তিক শাসন ব্যবস্থার প্রচলন ছিলও এমন রাষ্ট্রগুলোর মধ্যে সবার প্রথম স্লোভেনিয়া ইউরো জোনে প্রবেশ করে।


হাঙ্গেরির সীমানা পেরিয়ে আপনি যখন স্লোভেনিয়াতে প্রবেশ করবেন, তখনই দেখতে পাবেন সুউচ্চ সারি সারি পর্বতমালা।
হাঙ্গেরির সীমানা পেরিয়ে আপনি যখন স্লোভেনিয়াতে প্রবেশ করবেন, তখনই দেখতে পাবেন সুউচ্চ সারি সারি পর্বতমালা।

 

মধ্য ইউরোপে অবস্থিত এ দেশটিকে অনেকে পূর্ব এবং পশ্চিম ইউরোপের মধ্যেকার সেতু হিসেবে বিবেচনা করতে চান। এর পেছনে ভৌগোলিক কিছু কারণ যেমন রয়েছে, ঠিক তেমনি রাজনৈতিক কারণও রয়েছে। বিগত শতাব্দীর নব্বইয়ের দশক পর্যন্ত এ পুরো পৃথিবীতে দুটি পরাশক্তির রাষ্ট্র মাথা উঁচু করে দাম্ভিকতার সঙ্গে পুরো বিশ্বের ওপর তাদের প্রতিপত্তি খাটানোর চেষ্টা করতো; এদের একটি হচ্ছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং অপরটি হচ্ছে সোভিয়েত ইউনিয়ন। সোভিয়েত ইউনিয়নের মূল আদর্শিক কাঠামো ছিলও কমিউনিজম বা সমাজতন্ত্র। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পাশাপাশি সোভিয়েত ইউনিয়ন যখন নিজদেরকে পরাশক্তি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে শুরু করে, তখন থেকে রাজনৈতিকভাবে পূর্ব ইউরোপের দেশগুলোকে নিজেদের নিয়ন্ত্রণে নিতে শুরু করে। এক সময় এ দেশগুলোতে সমাজতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থা চালু করে।


পূর্ব ইউরোপের মধ্যে এক মাত্র রাষ্ট্র ছিল গ্রিস, যেখানে সোভিয়েত ইউনিয়নের কোনো প্রভাব ছিলও না। সোভিয়েত ইউনিয়ন যে ধারার সমাজতান্ত্রিক কাঠামোর ওপর নির্ভরশীল ছিলও সে ধরনের কাঠামোতে মুক্তবাজার অর্থনীতিসহ বেশ কিছু বিষয় ছিল ট্যাবুর মতো। কিন্তু তদানীন্তন যুগোশ্লাভিয়ার অন্তর্ভুক্ত এ সকল দেশগুলোতে বিরাজমান সমাজতান্ত্রিক কাঠামো সোভিয়েত ইউনিয়নের মতো রক্ষণশীল ছিলও না।


যুগোশ্লাভিয়া সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র হওয়া স্বত্বেও মুক্তবাজার অর্থনীতিকে তারা অগ্রাহ্য করেনি এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, গ্রেট ব্রিটেন, পশ্চিম জার্মানি, কানাডা—এ সকল পশ্চিমা দেশগুলোর সঙ্গে সখ্যতা ছিল। যুগোশ্লাভিয়ার নাগরিকদের কোনো বিধি—নিষেধ ছিলও না এ সকল পশ্চিমা দেশগুলোতে ভ্রমণের ব্যাপারে। অর্থাৎ সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র হওয়ার পরেও পশ্চিমা দেশগুলোর রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিক অবস্থানের প্রতি তারা যেমন উদার ছিলও। অপরদিকে সোভিয়েত ইউনিয়ন এবং পূর্ব ইউরোপের দেশগুলোর সঙ্গে আদর্শিকভাবে তারা মিশে থাকতে পেরেছিলও।


যদিও মার্শাল টিটো যুগোস্লাভিয়ার অন্তর্ভুক্ত দেশগুলোকে স্ট্যালিনের প্রভাব থেকে অনেকখানি দূরে রেখেছিলেন এবং প্রকৃতপক্ষে যুগোস্লাভিয়ার অর্থনৈতিক কাঠামো ছিল বাজার অর্থনীতি এবং সমাজতান্ত্রিক অর্থ ব্যবস্থা এ দুইয়ের মাঝামাঝি। ভৌগোলিকভাবে স্লোভেনিয়া ছিলও যুগোস্লাভিয়ার সবচেয়ে পশ্চিমের অংশ। এ কারণে স্লোভেনিয়াকে অনেকে পূর্ব এবং পশ্চিম ইউরোপের মধ্যেকার সেতু হিসেবে বিবেচনা করতে চান।


দেশটির প্রধান ধর্ম রোমান ক্যাথলিক খ্রিস্টানিটি এবং স্লোভেনিয়ার অধিবাসীদের গড় আয়ু ৮১ বছরের কাছাকাছি। স্লোভেনিয়াতে খ্রিস্টানের পর সবচেয়ে বেশি সংখ্যক মানুষ ইসলাম ধর্মে বিশ্বাস করে, যা দেশটির মোট জনসংখ্যার শতকরা তিন ভাগের কাছাকাছি। এ সকল জনগোষ্ঠীর বেশিরভাগ মানুষই বসনিয়া ও হার্জেগোভিনা এবং আলবেনিয়া (প্রকৃতপক্ষে কসোভো) থেকে যুগোসস্নাভ যুদ্ধের সময় স্লোভেনিয়াতে পাড়ি জমানো ইমিগ্র্যান্ট।


একজন মানুষ সর্বোচ্চ কতটুকু সাঁতার কাঁটতে পারেন? হিসেব করলে স্লোভেনিয়া অনেকখানি এগিয়ে। মার্টিন স্টে্রল নামক স্লোভেনিয়ার এক অধিবাসী ড্যানিউব, ইয়াংৎজে এবং মিসিসিপি নদীর সমগ্র দৈর্ঘ্যের সমান সাঁতার কেটে বিশ্ব রেকর্ড করেছিলেন। আবার ১৯৯০ সালের ০৭ অক্টোবর প্রথম বিবাহিত দম্পতি হিসেবে পৃথিবীর সর্বোচ্চ পর্বতশৃঙ্গ মাউন্ট এভারেস্টের চূড়ায় পা রাখার কৃতিত্ব অর্জন করা আন্দে্রই এবং মারিয়া স্টে্রমফেলি। তারা ছিলেন স্লোভেনিয়ার অধিবাসী।


বিশ্বের সবচেয়ে হালকা স্তন্যপায়ী প্রাণীর নাম এট্রুস্কান শ্রু। প্রকৃতিগতভাবে যার গড় ওজন দুই গ্রামের মতো। সামান্য পরিচিত এবং আকর্ষণীয় এ প্রাণীটি স্লোভেনিয়াতে দেখতে পাওয়া যায়। দেশটির সাধারণ মানুষের জীবনে লিনডেন গাছের গুরুত্ব অপরিসীম। লিনডেন গাছ স্লোভেনিয়ার অধিবাসীদের জীবনে একটি প্রতীক হিসেবে কাজ করে। লিনডেন গাছের আয়ুষ্কাল কয়েকশ বছর এমনকি এক হাজার বছরের মতোও হতে পারে এবং স্লোভেনিয়াতে লিনডেন গাছ প্রেম, ভালোবাসা বন্ধুত্ব ও আনুগত্যের প্রতিনিধিত্ব করে। ধারণা করা হয় প্রাচীনতম লিনডেন গাছগুলো আধুনিক ইউরোপেরও তুলনায় বহু পুরোনো। পৃথিবীর দীর্ঘতম আর্ক আকৃতির পাথরের তৈরি ব্রিজটি স্লোভেনিয়াতে দেখতে পাওয়া যায়। ‘সোলকান ব্রিজ’ নামে পরিচিত এ সেতুটি স্লোভেনিয়ার বোহিনি রেলওয়ে রুটের ওপর অবস্থিত।


স্লোভেনিয়াতে এক ধরনের বিশেষ দৌড় প্রতিযোগিতার প্রচলন রয়েছে যার নাম ‘দ্য হিল অব ডেথ’ বা মৃত্যুর পাহাড়। চারশতও মিটার লম্বা এ দৌড় প্রতিযোগিতাকে অনেকে ‘উল্লম্ব ম্যারাথন’—হিসেবে আখ্যা দিয়ে থাকেন; কারণ এ দৌড় প্রতিযোগতায় অংশ নিতে চাইলে একজন প্রতিযোগীকে উল্লম্বভাবে চারশত মিটার দৈর্ঘ্য অতিক্রম করতে হবে। রোমা কর এ দৌড় প্রতিযোগিতার বাণিজ্যিক নাম হচ্ছে ‘দ্য রেড বুল ৪০০’।

পর্যটকদের জন্য স্লোভেনিয়ার মূল আকর্ষণ হচ্ছে অসংখ্য সুন্দর লেক, পাহাড়—পর্বত, দুর্গ ইত্যাদি। স্লোভেনিয়ার রাজধানী এবং বৃহত্তম শহর লুবলিয়ানাতে বারোটির মতো মিউজিয়াম রয়েছে এবং এ সকল মিউজিয়াম খুবই কাছাকাছি অবস্থিত হওয়ায় একদিনে সবগুলো মিউজিয়াম ঘুরে ফেলা সম্ভব।

স্লোভেনিয়া দেশটি এতো ছোটো যে আপনি এর একদিকে ইতালি এবং অন্যদিক থেকে চোখ রেখে সহজেই ক্রোয়েশিয়া দেখে ফেলতে পারবেন। বলা হয়ে থাকে গোটা ইউরোপ মহাদেশে সুইডেন এবং ফিনল্যান্ডের পর সবচেয়ে বেশি ঘন জঙ্গলাবৃত দেশটির নাম স্লোভেনিয়া, দেশটির প্রায় অর্ধেকই ঘন জঙ্গলে পরিপূর্ণ। হাঙ্গেরির সীমানা পেরিয়ে আপনি যখন স্লোভেনিয়াতে প্রবেশ করবেন, তখনই দেখতে পাবেন সুউচ্চ সারি সারি পর্বতমালা। দেশটির বিভিন্ন জায়গায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা ঘন বন—জঙ্গল ও সুউচ্চ পর্বতমালা এবং ব্রাউন বেয়ারের কারণে স্লোভেনিয়াতে সব সময় প্রকৃতিপ্রেমী মানুষের আনাগোনা লেগেই থাকে।