হিটলারের জার্মানির সংসদ এবং সাংসদদের নিয়ে মন্তব্য

রাহমান চৌধুরী

প্রকাশিত : অক্টোবর ২৯, ২০১৯

বয়সে কম ছিলাম বলে পত্রপত্রিকার মাধ্যমে সংসদীয় রাজনীতির প্রতি আমার আকর্ষণ বেড়ে যায়। সেই আকর্ষণ আমি বহুদিন পর্যন্ত ঝেড়ে ফেলে দিতে পারিনি। কিন্তু পরিস্থিতি বিবেচনায় যেটা প্রথমেই আমার নজরে পড়ে সেটা হলো, সংসদ সদস্যদের ভেতর স্পষ্টত এককভাবে দায়িত্ব এড়িয়ে চলা। সংসদের এক একটা আইন গৃহীত হওয়ার পর দেশের জন্য চরম দুর্দশা ডেকে এনেছে। কিন্তু তার জন্য কাউকে দায়ী করা যায়নি। কোনো একক ব্যক্তিকে কারণ দর্শাবার জন্য প্রশ্ন করাও সম্ভব নয়। সংসদীয় গণতন্ত্রের মাধ্যমে নির্বাচিত নেতাদের যারা জনসাধারণের দ্বারা নির্বাচিত সদস্য, বিশেষ কোনো কার্যকলাপের জন্য তাদের কাছে কি হিসেব চাওয়া সম্ভব? নাকি এইসব তথাকথিত নির্বোধ রাজনৈতিক ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে কোনো সুনির্দিষ্ট গঠনমূলক পরিকল্পনা আশা করা যায়? বলা বাহুল্য, সেই সংসদ সদস্যদের বেশির ভাগ হয়তো জাল ভোটের দ্বারা নির্বাচিত।

সংসদ সভা কি কোনোদিন কোনো মূল্যবান রাজনৈতিক মতবাদ গবেষণা চালিয়ে তার মূল্য নিরূপন করে তবে তা গ্রহণ করেছে? নির্বাচনকে যদি খুব গুরুত্ব দেয়া হয়, প্রশ্ন থাকে বাস্তব পৃথিবীতে প্রতিভাবান ব্যক্তির প্রতিভা কি অলস এবং জড় জনতার দ্বারা সদাসর্বদা প্রতিহত হয়নি? এইরকম পরিস্থিতিতে কি সত্যিকার চরিত্রবান একজন রাষ্ট্রনেতার পক্ষে নির্বাচিত হওয়া সম্ভব? সত্যিকারের একজন নেতা নিশ্চয়ই নিজেকে রাজনৈতিক ঠিকাদারের পর্যায়ে নামিয়ে আনার কথা চিন্তা করবে না। ঠিক বিপরীত দিকে প্রতিটি রাজনৈতিক ঠিকাদার কি রাজনৈতিক খেলায় মত্ত থাকবে না যা তার জন্য সুবিধাজনক? রাষ্ট্রের অগণিত জনসাধারণের উপর কার প্রভাব কাজ করে? রাজনৈতিক ঠিকাদাররাই কি রাজনীতির নামে তাদেরকে নিয়ন্ত্রণ করে না? সুতরাং নিশ্চিতরূপেই বলা যায় যে, সংখ্যাধিক্যের নির্বাচিত সংসদীয় এই গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে কি মারাত্মক সঙ্কট রয়ে যাচ্ছেন না? সংসদীয় গণতান্ত্রিক সরকার কি একজন সত্যিকারের রাষ্ট্রনেতার আদর্শকে ধ্বংসের পথে নিয়ে চলছে না?

সংসদীয় রাজনীতি বা এই প্রতিষ্ঠানগুলিই রাজনীতিতে অতি সাধারণ লোকেদের ভিড় বাড়াবার জন্য দায়ী। এইসব বাস্তবের সম্মুখীন হয়ে একজন মানুষ যার ভেতরে সত্যিকারের রাষ্ট্রনেতা হবার যোগ্যতা আছে, সে চেষ্টা করবে রাজনীতির প্রাঙ্গণ এড়িয়ে যেতে। কারণ রাজনীতির এই পরিবেশ, যার গঠনমূলক কাজ করবার ক্ষমতা আছে তা তাকে করতে দেবে না। বরং যার পক্ষে অধিকাংশের ভিড়ে যাওয়া সম্ভব, এই ধরনের রাজনীতি তাকেই আকর্ষণ করবে। ফলে এই ধরনের রাজনৈতিক ধ্যানধারণা সংকীর্ণমনাদের জন্য এবং তাদেরই টানবে। মানসিক দিক থেকে সংকীর্ণমনা এবং জ্ঞানের দিক থেকে অপ্রতুল এইরকম রাজনীতির সঙ্গে বিচক্ষণ মানুষরা যুক্ত হতে পারে না। জ্ঞানভাণ্ডারের সীমাবদ্ধতার কারণেই এই সকল রাজনীতিবিদরা জনতার মন যুগিয়ে কথা বলবে যাতে তাদের প্রতিভা বা বুদ্ধিমত্তার দুর্বলতা কেউ বুঝতে না পারে। আমাদের এই ক্ষয়িত যুগে এই কারণেই সম্ভবত উচ্চ ধীশক্তিসম্পন্ন রাজনীতিজ্ঞর অভাব ঘটেছে।

সাংসদরা বর্তমান সময়ে কোনোরকম দায়দায়িত্ব গ্রহণের উদ্বিগ্নতা থেকে মুক্ত। কারণ প্রথম থেকেই তার রাষ্ট্রনৈতিক খেলার ফলাফল নির্ধারিত, নিজের ব্যক্তিত্ব প্রকাশের সুযোগ সেখানে নেই। যত বেশি সাংসদরা সংসদীয় গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে একক ব্যক্তির উপর নির্ভরশীল হয়ে পড়বে, তত তাদের ক্ষমতা কমে আসবে। সত্যিকারের রাজনৈতিক প্রতিভাসম্পন্ন কেউ এই ধরনের হাঁসের ঝাঁকের ভিড়ে এসে উচ্চ কণ্ঠস্বরে দিগদিগন্ত নিনাদিত করতে চাইবে না বা পারবে না। সংসদের সভাপতির একমাত্র সান্ত¦না যে, যেসব সাংসদদের তাকে পরিচালিত করতে হয়, তাদের বুদ্ধিমত্তা তার চেয়ে বেশি নয়। সুতরাং সকলে প্রায় একই ধরনের বুদ্ধিমত্তা সম্পন্ন হওয়ায় বিতর্ককালে সকলের কণ্ঠে একই ধরনের সুর ধ্বনিত হয়। এই ধরনের গণতন্ত্রের একটা অদ্ভুত দিক হচ্ছে, তা প্রচণ্ডরকম অপকার ছড়ায় সমাজে। আর সেটা হলো আমাদের জন্য একদল তথাকথিত রাজনৈতিক নেতা উৎপাদন। যখনই কোনো জরুরি বিষয়ের অবতারণা হয়, তারা তক্ষুণি সংখ্যাধিক্যের পিছনে মুখ লুকায়।

সংসদীয় রাজনীতির এইসব রাজনৈতিক কৌশলগুলি একটু মনোযোগ দিয়ে পর্যবেক্ষণ করলে দেখা যাবে কীভাবে মিষ্টি কথায় সংখ্যাধিক্য সদস্যদের ভুলিয়ে ভালিয়ে সে যা করতে চায় তার মতামত আদায় করে নিচ্ছে। আর এসবই হলো মূল কারণ যার জন্য সাহসী এবং চরিত্রবান কোনো রাজনৈতিক নেতার কাছে এই পুরো ব্যাপারটাই ঘৃণ্য। কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে নীচুস্তরের লোকদের ঠিক এইগুলিই প্রচণ্ড আকর্ষণ করে, যারা নিজেদের কাজকর্মের দায়িত্ব নিতে অনিচ্ছুক কিন্তু সবসময় নিজেদের কৃতকর্মের জন্য একটা আবরণ খুঁজে বেড়ায়। যদি কোনো জাতীয় নেতা আদর্শের নীচুস্তরের থেকে আসে তবে তার মধ্যেও এইসব দুষ্ট কৌশল প্রবেশ করবে। কারোর পক্ষেই তখন সাহসের সঙ্গে কোনো সঠিক পথ নেয়া সম্ভব নয়। তখন তারা গালাগাল, ভয়ের কাছে নতি স্বীকার করে নিয়ে সাহসের সঙ্গে কোনো মত প্রকাশ করবে না। এইভাবে একজনকেও খুঁজে পাওয়া যাবে না যে তার ভবিষ্যত আর বর্তমানকে বাঁধা রেখে রাজনীতির সঠিক রাস্তায় নিজের মতামত ব্যক্ত করতে প্রয়াসী।

সংখ্যাধিক্য শুধু অজ্ঞতাই প্রকাশ করে না, কাপুরুষও হয় বটে। যেহেতু একশো বোকা একজন জ্ঞানীর সমতুল্য নয়, ফলে এর পরিণতি বোঝাই যাচ্ছে। সবসময় স্মরণ রাখা দরকার যে, সংখ্যাধিক্য কখনো একজন সচেতন বা বিজ্ঞ ব্যক্তিত্বের পরিপূরক হতে পারে না। সত্যি বলতে কষ্টসহিষ্ণু চরিত্রবান বিজ্ঞ রাজনীতিকের পক্ষে রাজনীতির ক্ষেত্রে যা করা সম্ভব, একশোটা কাপুরুষের পক্ষে তা সম্ভব নয়। বর্তমান ক্ষয়িষ্ণু সংসদীয় গণতন্ত্রের আদর্শের মতো অন্তঃসারশূন্য আর কোনো আদর্শ খুঁজে পাওয়া যাবে না। খুব সত্যি যে, মাত্র অল্পসংখ্যক জনসাধারণের ইচ্ছা বা প্রয়োজনই মাত্র এই তথাকথিত গণতান্ত্রিক নির্বাচনে প্রতিফলিত। প্রত্যেকে, যাদের কিছুটা রাজনৈতিক চেতনা আছে এবং জনসাধারণের রাজনৈতিক বুদ্ধিমত্তার দিকটা বোঝে, তারা সবাই জানে যে সাধারণ জনগণের রাজনৈতিক বিচারবুদ্ধি অত্যন্ত কম, তাই তাদের পক্ষে এমন কাউকে নির্বাচন করাও সম্ভব নয় যে তাদের চিন্তাকে রূপ দিতে সক্ষম।

সংসদ নামক প্রতিষ্ঠানে পেঁচা ধরনের লোকদেরই আকৃষ্ট করে থাকে, যারা দিনের আলো সহ্য করতে অপারগ। সাহসী এবং চরিত্রবান ব্যক্তি যারা নিজের কাজের দায়িত্ব নিতে প্রস্তুত, তারা কখনোই এই ধরনের প্রতিষ্ঠানের প্রতি আকৃষ্ট হবে না। সংসদের শ্রোতা বলতে মাত্র কয়েকশো লোক। সাংসদদের বেশিরভাগই সেখানে উপস্থিত থাকে তাদের জন্য ধার্য দৈনিক ভাতা পাওয়ার ধান্ধায়, জ্ঞানের অলোকবর্তিকার শিখা বাড়াবার জন্য নয়। তারা যখন সংসদের সভ্যপদ অলংকৃত করে, তখন তাদের অনুগামীদের দল কোনো এক অত্যাশ্চর্য কিছু ঘটবে ভেবে আশা নিয়ে বাইরে অপেক্ষা করে। স্বভাবতই জনগণের চাহিদা মতো কোনো অবাক করা ঘটনা ঘটে না, ঘটতে পারে না। শীঘ্রই আন্দোলনের অনুগামীর দল হতাশ এবং অধের্য হয়ে পড়ে, কারণ তারা সংবাদপত্রে যা পাঠ করে তার সঙ্গে নির্বাচনের কোনো প্রতিশ্রুতির মিলই এই সকল ভোটদাতারা খুঁজে পায় না।

যতোই বলি না কেন ‘গণমত’, কিন্তু বাস্তবে অতি অল্প সংখ্যক লোকের চিন্তাধারা এবং অভিজ্ঞতা প্রসূত হলো এই মতামত। সবশেষে দেখা যায় এর বেশিরভাগ ফলাফলই আসে জনসাধারণের কাছে ফুলিয়ে ফাঁপিয়ে নিপুণভাবে পরিবেশিত হয়ে, যার সঙ্গে বাস্তবের কোনো সঙ্গতি নেই। সংসদে এই যে পাঁচশো সদস্য যারা জনগণের ভোটে নির্বাচিত, যদি কেউ চিন্তা করে এই নির্বাচিত পাঁচশো প্রতিনিধি হলো উৎসাহ এবং বুদ্ধিমত্তার দিক থেকে শ্রেষ্ঠ তাহলে সেটা মস্ত ভুল। এমন নির্বোধ সম্ভবত একজনও পাওয়া যাবে না যে নাকি ভাবে যে এই তথাকথিত ভোটের কাগজগুলি থেকে হঠাৎ শয়ে শয়ে রাষ্ট্রনেতা বেরিয়ে আসবে। নির্বাচিতরা আর যাই হোক সাধারণের চেয়ে একবিন্দু বেশিও বুদ্ধি রাখে না। ভোটের দ্বারা নির্বাচিত সত্যিকারের একজন রাষ্ট্রনেতার সন্ধান পাওয়ার চেয়ে সম্ভবত একটা ছুঁচের সূতো গলার ফাঁক দিয়ে পুরো একটা উট গলে যাওয়া সহজ।

যদি ঘটনাক্রমে একজন যোগ্য লোক সংসদে নির্বাচিত হয় যে সোজাসাপ্টা কথা বলার লোক, শেষমেশ দেখা যাবে হয়তো পরিবেশের চাপে পড়ে বিনা আপত্তিতে তাকেও ব্যাপারগুলি মেনে নিতে হচ্ছে; জনসাধারণ তার ওপর যে বিশ্বাস করে সংসদে তাকে পাঠিয়েছিলো সেটাকে তার প্রতি বিশ্বাসঘাতকতাই বলা চলে। ব্যাপারটা হলো সংসদে কোনো একক ব্যক্তিত্ব যদি কোনো বিশেষ আলোচনায় নিজের মতামত ব্যক্ত করে বা আলোচনায় অংশ না নেয়, তাতে কিন্তু পরিস্থিতির বিন্দুমাত্র পরিবর্তন হয় না। কিন্তু তার সম্মানটাই মাঝের থেকে ধূলিসাৎ হয়ে যায়। যদি সে সত্যি কথাগুলি বলতে পারে শেষে হয়তো সেই সদস্য নিজেকে বোঝাতে সমর্থ হয় যে, আর যাই হোক দলের মধ্যে সে নিকৃষ্ট নয়। প্রশ্ন থেকে যায়, যদি বিশেষ কোনো সমস্যা সমাধানের জন্য মাত্র কয়েকজনের জ্ঞান থাকে তাহলে আর পাঁচশো লোককে নির্বাচন করা কেন? আসলে আমাদের আধুনিক গণতান্ত্রিক সংসদীয় পদ্ধতিটার উদ্দেশ্যই হলো একদল অবিবেচক, যাদের দৃষ্টিভঙ্গি সম্পূর্ণভাবেই অন্যের ওপর নির্ভরশীল তাদেরকে নিবাচিত হয়ে আসার সুযোগ করে দেয়া, যাতে সহজেই তাদের পরিচালনা করা যায়। সত্যি বলতে এই একটা উপায়েই দলীয় আদর্শ আজকের দিনের দুষ্ট লক্ষ্য অর্জনে কাজে লাগানো হয়।