হুমায়ূন আহমেদের কোন বইটি পড়া জরুরি

মারুফ ইসলাম

প্রকাশিত : নভেম্বর ১৩, ২০১৯

প্রশ্নটা ক্লিশে, পুরনো, বহুল চর্চিত— ‘কী আছে হুমায়ূন সাহিত্যে?’ অর্থাৎ হুমায়ূন সাহিত্যে কী এমন গুপ্ত, যার কারণে তিনি এত জনপ্রিয়? মূলত হুমায়ূনের উত্থানের পর থেকে তাঁর মৃত্যুর এত বছর পরও এই প্রশ্নচর্চা প্রবহমান। এর উত্তরও পুরনো, বহুচর্চিত এবং একই কক্ষপথে ঘুর্ণায়মান—‘মধ্যবিত্ত জীবনের ছোট ছোট আবেগ অনুভূতির হাস্যরসাত্মক উপস্থাপন, টেস্টি ও ক্রিস্পি গদ্যে গল্পের বয়ান, বই পড়ে সিনেমাপ্রতিম বিনোদন লাভ, এতে নেই কোনো জীবন ও জগতের গুঢ় দার্শনিক বার্তা যা মস্তিষ্কে শিরপীড়া তৈরি করে ইত্যাদি।’

এসবের বাইরে কি হুমায়ূন সাহিত্যে আর কোনো উপাদান নেই? কেন তাঁর আলোচনাকারী-সমালোচনাকারী-সাহিত্যবোদ্ধারা সেই চিরায়ত ঘুর্ণাবর্তের বাইরে গিয়ে আর কোনো উপাদান চোখে দেখেন না? বোধকরি এ কারণে চোখে দেখেন না যে, তাদের একপক্ষের চোখে রয়েছে মুগ্ধতার চশমা আর অপরপক্ষের চোখে রয়েছে ঘৃনার ঠুলি। ফলে একটা আক্ষেপ নিয়েই মারা গেছেন হুমায়ূন আহমেদ। হুমায়ূনের আক্ষেপ, তিনি তাঁর সমগ্র গল্প-উপন্যাসে একটা ইঙ্গিত দিয়ে গেছেন, কিন্তু সেই ইঙ্গিত ধরতে পারেননি তাঁর পাঠক-সমালোচক কেউই।

কী সেই ইঙ্গিত? হুমায়ূনের জবানীতে সরাসরি জানা যাক—‘এই মহাবিশ্বের বেশিরভাগ প্রশ্নেরই উত্তর আমাদের জানা নেই। আমরা জানতে চেষ্টা করছি। যতই জানছি ততই বিচলিত হচ্ছি। আরো নতুন সব প্রশ্ন দেখা দিচ্ছে। বিজ্ঞানীরা নিদারুণ আতঙ্কের সঙ্গে লক্ষ করছেন তাঁদের সামনে কালো কঠিন পর্দা যা কোনোদিনই উঠানো সম্ভব হবে না। কী আছে এই পর্দার আড়ালে তা জানা যাবে না। আমার যাবতীয় রচনায় আমি ওই কালো পর্দাটির প্রতি ইঙ্গিত করি। আমি জানি না আমার পাঠক পাঠিকারা সেই ইঙ্গিত কি ধরতে পারেন, নাকি তারা গল্প পড়েই তৃপ্তি পান?’ (সূত্র: এই আমি; হুমায়ূন আহমেদের আত্মজৈবিনিক রচনা)

যারা বলেন হুমায়ূন সাহিত্যে কোনো বার্তা নেই, নেই কোনো মেসেজ তারা সম্ভবত হুমায়ূনের রচনায় এই কালো পর্দার তালাশ পান না। নতুন সময়ের পাঠক, সমালোচক ও বোদ্ধারা যদি হুমায়ূনকে নিবিড়ভাবে পাঠ করতে আরম্ভ করেন এবং অতি অবশ্যই মুগ্ধতার চশমা ও ঘৃনার ঠুলি খুলে তা করেন তবে নিশ্চিভাবেই বলা যায়, হুমায়ূনের কালো পর্দা তাদের আঁখিপটে তীব্রভাবে উন্মোচিত হবে।

হুমায়ূন আহমেদের মৃত্যুর পর অসংখ্যবার সূর্য ডুবে গেছে এবং উঠেছে, চাঁদ আলো বিলিয়েছে এবং জোছনার ফুল এঁকেছে, বৃষ্টি ঝরিয়ে গেছে আকাশ। পেরিয়ে গেছে পাঁচ বছরাধিক কাল। এই পাঁচ বছরে হুমায়ূনকে নিয়ে যত লেখালেখি হয়েছে, যত অনুষ্ঠান হয়েছে, তার সবগুলিই মূলত স্মৃতিচারণমূলক। কেউ বলেন তিনি বদমেজাজী ছিলেন, কেউ বলেন তিনি অদ্ভূত ছিলেন, কেউ বলেন তিনি আমার পারিবারিক বন্ধু ছিলেন, কেউ বলেন তার সমস্ত আড্ডায় তিনি নিমন্ত্রণ পেতেন, কেউ বলেন তিনি জাদু ভালোবাসতেন, কেউ বলেন তিনি মানুষকে চমক দিতে পছন্দ করতেন ইত্যাদি। কেউ বলেন না, হুমায়ূনের তিন শতাধিক বইয়ের মধ্যে এই এই এই বই পড়া জরুরি। এই এই বই তাঁকে নতুনভাবে ভাবিয়েছে কিংবা এই এই বই তার জীবনদর্শন পাল্টে দিয়েছে অথবা এই এই বই পড়ে ভীষণভাবে বিরক্ত হয়েছি। এসব বলেন না বলেই হুমায়ূনের কালো পর্দা আজও অধরা।

এখন, এই নতুন সময়ে, হুমায়ূনের জনপ্রিয়তার তত্ত্বতালাশের জন্য হলেও অন্ততঃ হুমায়ূনের নিবিড় ও নির্মোহপাঠ জরুরি। হুমায়ূন সাহিত্য নিয়ে প্রাতিষ্ঠানিক গবেষণা হওয়া এখন সময়ের দাবি। হুমায়ূন যে কালো পর্দার কথা বলেছেন, সেই কালো পর্দা সত্যিই তাঁর সাহিত্যে উপস্থিত কিনা তাও খুঁজে দেখা প্রয়োজন। বাংলা সাহিত্যের নতুন গতিপথ নির্মাণের জন্যই সেটা খুব বেশি আবশ্যক।

তাই পুরনো, ক্লিশে এবং বহুচর্চিত প্রশ্নের বাইরে এসে, আসুন হুমায়ূন আহমেদ সম্পর্কে নতুন নতুন প্রশ্নের অবতারণা করি। শুরুটা না হয় আমিই করলাম—‘হুমায়ূনের কোন কোন বই পড়া জরুরি?’ আমার উত্তর কমেন্টে।

লেখক: গল্পকার