৪০ লক্ষাধিক বইসমৃদ্ধ লাইব্রেরির গপ্পো

সাইফুল ইসলাম

প্রকাশিত : আগস্ট ২৭, ২০২০

আমরা প্রায় বলি থাকি, আমাকে যদি একটি লাইব্রেরি দেয়া হয়, তাহলে আর কিছু চাইবো না। সারাক্ষণ সেখানে বসে পড়াশোনা করবো। বইপোকারা সবাই এসব ডায়লগ হরহামেশাই দেয়। জানি না সবার বিষয়টি কি! আমার বেলায় এটা কেবল গালগল্পই রয়ে গেছে। কেন বললাম এই কথা?

আচ্ছা খোলাসা করি। আমার বাসার নিকটে এমন একটি লাইব্রেরি আছে, যাতে রয়েছে ৪০ লক্ষ ছাপা বই, এক কোটি ২০ লক্ষ ইলেক্ট্রনিক ভার্সন বই, পাঁচ লক্ষ ৫০ হাজার প্রাচীন ও দুর্লভ বই, ১২ লক্ষ অডিও ফাইল, এক কোটি ২০ লক্ষেরও বেশি রিপোর্ট ও আর্টিকেল। পাশাপাশি লাইব্রেরিটির ওয়াফাই দিয়ে আন্তর্জাতিক বড় বড় জার্নালে এক্সেস করে ফ্রিতে পেইড আর্টিকেল নামিয়েও পড়া যায়।

শুধু তাই না, আরও আছে একটি রেস্টুরেন্ট, মসজিদ, হলরুম, বেকারি এবং বেশ কয়েকটি ক্যাফে। যেখানে পানি, হরেকরকম কফি ও চা ফ্রিতে পাওয়া যায়। বই পড়তে পড়তে ক্লান্ত হলে লবিতে বসে স্বচ্ছ কাচে নয়নাভিরাম প্রেসিডেন্ট প্রাসাদের দিকে তাকিয়ে এক কাপ কড়া কফি খেয়ে আবার বইয়ে ডুব দেয়া যায়।

এত কিছু থাকার পরেও সেখানে আমার তেমন একটা ঢুঁ মারা হয় না। যা-ও সেখানে যাই, কিছুক্ষণ বইটই ঘাটাঘাটি করে, এত এত বইয়ের যাঁতাকলে পড়ার ভয়ে কোনো রকম পালিয়ে আসি। যদিও এই লাইব্রেরিতে ঢুকলে প্রশান্তিতে হৃদয় ছেয়ে যায়। ইচ্ছে করে আরও কিছুক্ষণ থাকি।

আচ্ছা, এত গীত যার গাইছি তার পরিচয়ই তো দেয়া হয়নি। হ্যাঁ, বলছিলাম তুরস্কের সর্ববৃহৎ লাইব্রেরি, তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রিজেপ তাইয়্যেপ এরদোয়ানের আঙ্কারার প্রেসিডেন্সিয়াল প্যালেসে অভ্যন্তরে প্রেসিডেন্সিয়াল মিল্লেত কুতুপানে Cumhurbaşkanlığı Millet Kütüphanesi (Presidential Library), প্রেসিডেন্সিয়াল লাইব্রেরির কথা।

যেখানে একসাথে পাঁচ হাজার মানুষ বই পড়তে পারে। সবচেয়ে মজার ব্যাপার হলো, ১৩৪টি ভিন্ন ভিন্ন ভাষায় প্রকাশিত বইগুলোর যে সেলফ রয়েছে, তাদের মোট দৈর্ঘ্য প্রায় ঢাকা থেকে নোয়াখালীর দূরত্বের সমান। মানে সবগুলো সেলফের দৈর্ঘ্য যোগ করলে হয় ২০১ কি.মি.। দৃষ্টিনন্দন এই লাইব্রেরিটি কেবল আমার আপনার মতো সুস্থ-সবল মানুষের জন্যই, তা কিন্তু নয়। গ্রন্থাগারটির অভ্যন্তরে প্রবেশে প্রতিবন্ধীদের জন্য হুইলচেয়ার থেকে শুরু করে দৃষ্টি প্রতিবন্ধী এবং শ্রবণ প্রতিবন্ধী উভয়ের জন্য রয়েছে অত্যাধুনিক প্রযুক্তি সম্বলিত কক্ষ।

আমরা সাধারণত পাঠাগারে বাচ্চাদের নিতে চাই না। কিন্তু এই নয়া গ্রন্থাগারটিতে শিশুদের জন্য রয়েছে বিশেষ ব্যবস্থা। ৫-১০ বছর বয়সের বাচ্চাদের জন্য বিখ্যাত তার্কিশ হাস্যোরসিক লেখক নাসিরুদ্দিন হোজ্জা কক্ষ, যা সাজানো হয়েছে বাচ্চাদের উপযোগী ২৫ হাজার বই ও মাল্টিমিডিয়া আর্ট গ্যালারি দ্বারা। বিরল বই, চিত্র ও বিভিন্ন ধরনের মজার ১২ হাজার বই নিয়ে সাজানো ১০-১৫ বছরের কিশোরদের জন্য তৈরিকৃত কক্ষের নাম দেয়া হয়েছে যুব লাইব্রেরি। পাশাপাশি বিশেষভাবে গবেষণা লাইব্রেরিকে ২০টি পৃথক স্টাডি রুমের মাধ্যমে ২০ হাজার বই দিয়ে সাজানো হয়েছে।

ষোলটি গ্রেট তুর্কি সাম্রাজ্যের কথা মনে করিয়ে দেয়ার জন্য বিশেষ জিহানুমা (ওয়ার্ল্ড অ্যাটলাস) হলটিকে সাজানো হয়েছে ১৬টি কলামের মাধ্যমে। যাতে ২,০০,০০০ বইয়ের সংগ্রহ রয়েছে এবং ৩,৫০০ বর্গমিটার জায়গাতে একসাথে ২২৪ জন পাঠকের জন্য বসার ব্যবস্থা রয়েছে।

পৃথিবীর যে সকল দেশে তুরস্কের কূটনৈতিক মিশন রয়েছে, এমন প্রায় সকল দেশ থেকেই এই গ্রন্থাগারটিতে বই নিয়ে আসা হয়। বিভিন্ন দেশের বিখ্যাত ব্যক্তিবর্গ তাদের সংগ্রহে থাকা দুর্লভ বই লাইব্রেরিটিতে দান করে দেয়। নতুন গ্রন্থাগারটির কারুকার্য দর্শনার্থীদেরকে মনে করিয়ে দিবে ঐতিহ্যবাহী সেলজুক, অটোমান, আনাতোলিয়া এবং সমসাময়িক তুর্কি ইতিহাসের কথা। আলো-আঁধারি হলের গম্বুজে খোদাই করে লেখা কোরআনের ক্যালিগ্রাফিগুলো আপনার মনে এনে দেবে এক মোহনীয় প্রশান্তি।

উল্লেখ্য, ইতিপূর্বে তুরস্কের বৃহত্তম গ্রন্থাগার ছিলো, মিল্লি কুতুপানে বা জাতীয় গ্রন্থাগার, যা ৪৫,০০০ বর্গমিটার ভূমিতে নির্মিত হয়েছিল। নতুন গ্রন্থাগারটি হচ্ছে ১২৫,০০০ বর্গ মিটার বা ১.৩৫ মিলিয়ন বর্গফুট। যা এখন তুরস্কের সর্ববৃহৎ লাইব্রেরি।

প্রেসিডেন্ট এরদোয়ানের সরাসরি তত্ত্ববধান, তার্কির শীর্ষস্থানীয় বুদ্ধিজীবী, গ্রন্থাগারিক, এনজিও এবং সিভিল সোসাইটির সার্বিক সহযোগিতার মাধ্যমে ২০ ফেব্রুয়ারি ২০২০ সালে উদ্বোধন হওয়া এই রাষ্ট্রপতি গ্রন্থাগারটি তুর্কি প্রজাতন্ত্রের ইতিহাসে বৃহত্তম একক গ্রন্থাগার এবং এটি তুরস্কের প্রথম গ্রন্থাগার যা সমন্বিত বইয়ের কনভেয়র সিস্টেম ব্যবহার করে করা হয়েছে।

শুরু করছিলাম, লাইব্রেরিতে সারাক্ষণ পড়ে থাকা নিয়ে। এই লাইব্রেরিটিতে চাইলে ২৪ ঘণ্টা থাকা যায়, কেবল এটা নয়, তুরস্কের প্রায় সকল বড় লাইব্রেরিগুলোই ২৪ ঘণ্টা খোলা থাকে। আশ্চর্যের বিষয় হচ্ছে, ২৪ ঘণ্টাই শিক্ষক, গবেষক ও শিক্ষার্থীরা লাইব্রেরিগুলোতে সময় কাটান। আমার মনে আছে, করোনা পূর্ব সময়ে জাতীয় গ্রন্থাগারে রাত ৩টায় গিয়েও সিট খালি পাওয়া দুষ্কর ছিল।

আর আমি! ভ্যাকেশনে চুপিচুপি গিয়ে দুই-চারটা ছবি তুলে, সবার নিবিষ্ট মনে পড়াশোনার হাল-হাকিকত দেখে চলে আসি। কিন্তু বলার সময় ঠিকই বলি, বাসার পাশে এমন একটি লাইব্রেরি হলে আর কিছু চাই না। হা হা হা। ফাঁকিবাজ বাঙালি বলে কথা। তবে ইচ্ছা আছে, করোনামুক্ত পৃথিবীতে এমন লাইব্রেরিকে নিত্যদিনের রুটিনে নিয়ে আসার।