তৃষ্ণাকুমারী

পর্ব ৪

আবু তাহের সরফরাজ

প্রকাশিত : নভেম্বর ১৮, ২০১৭

সবুজ মাঠ। উঁচু উঁচু ঘাসে ছাওয়া। পেছনে অস্ত যাচ্ছেন দিনকর। সিঁদুররঙা আভা ছড়িয়ে পড়েছে চারদিক। লাল আর সবুজ মিলেমিশে একাকার। স্বামীকে কাঁধে নিয়ে দৌড়োচ্ছেন রানি। শরীর ভেঙে যেতে চাইছে। পা আর টেনে তুলতে পারেন না। বুকের ভেতর যেন মরুভূমি। তবু দৌড়োচ্ছেন তিনি। আর শুনতে পাচ্ছেন রে-রে-রে-রে ডাক ছেড়ে কারা যেন ছুটে আসছে তার পিছু পিছু। দৌড়োতে দৌড়োতে দেখলেন, সামনে একটা নদী। টলটলে জল। গোধূলির রঙে ঝিলমিল করছে। নরম ঘাস বিছিয়ে রয়েছে তীরে। বসে পড়লেন রানি ঘাসের ওপর। নদীর ওপর দিয়ে ঝিরঝির হাওয়া ছুটে এলো। শরীর জুড়িয়ে গেল তার। কাঁধ থেকে নিচে নামালেন লোকটাকে। ঘুমিয়ে পড়েছে মানুষটা। তার ঘুমন্ত মুখের দিকে চোখ পড়তেই কেঁপে উঠলেন রানি। এ যে সত্যিই তার স্বামী। খাগড়া মুলুকের রাজা।
রে-রে-রে-রে ডাক ছেড়ে ওই তো ছুটে আসছে কারা।
কাঁপতে লাগলেন রানি। আর কোথায় পালাবেন তিনি? সামনে নদী। শরীরও অবশ। আর পারবেন না পা তুলে দাঁড়াতে। কী উপায় এখন? কিছুই যেন আর ভাবতে পারেন না তিনি। বিস্ফোরিত চোখে কেবল চেয়ে থাকেন ছুটে আসা মানুষগুলোর দিকে।
কাছাকাছি চলে এলো তারা। রানি দেখলেন, তাদের প্রত্যেকের হাতে খোলা তলোয়ার। গোধূলির আলোয় ঝলসে যাচ্ছে ধাতব উজ্জ্বলতা। একজন দুহাতে তলোয়ার মাথার ওপর তুলে ধরে বলল, তুমি ভয় পেয়ো না। তোমার সঙ্গে আমাদের কোনও শত্রুতা নেই। আমরা খুন করব তোমার সাথের লোকটাকে।
ছিটকে উঠলেন রানি। ভয়ার্ত গলায় চেঁচিয়ে উঠলেন, না-না। ওকে খুন করবেন কেন আপনারা? উনি তো আমার স্বামী।
হলেও বা তোমার স্বামী। কিন্তু তাকে খুন আমাদের করতেই হবে। আমাদের ওপর এ রকমই নিদের্শ দেয়া হয়েছে।
কে নির্দেশ দিয়েছে?
আমাদের প্রভু।
কে আপনাদের প্রভু?
আমরা তাকে চিনি না। দেখিও নি কোনও দিন। তবে শুনেছি ভীষণ রাগি তিনি। একটুতেই রেগে যান। আর তিনি রেগে গেলে মাটি কেঁপে ওঠে। পাহাড় নড়ে ওঠে। সে বড় ভয়ংকর ব্যাপার।
রানি এবার ঘুমন্ত রাজার বুকের ওপর আছড়ে পড়ে আড়াল তৈরি করলেন।    তাদের দিকে পিঠ পেতে রেখে বললেন, আমার স্বামীকে আপনারা খুন করতে পারবেন না। কিছুতেই না। আমি বেঁচে থাকতে তা হতে দেব না।
আরেকজন বলল, কিন্তু তোমাকে মারার তো কোনও নির্দেশ আমরা পাইনি। তোমাকে মারা যাবে না। আমরা মারব ওই লোকটাকে।
লোকগুলা এগিয়ে এলো।
ভীষণ শীত-শীত করতে লাগল রানির। কাতর গলায় তিনি বললেন, ওকে মারবেন না, ভগবানের দিব্যি... মারবেন না...
লোকগুলো শুনল না তার কথা। জবরদস্তি করে তাকে সরিয়ে ফেলে উদ্ধত তলোয়ার দিয়ে এক কোপেই তারা নামিয়ে ফেলল রাজার মাথা। আর্তনাদ করে উঠলেন রানি। টলতে-টলতে আছড়ে পড়লেন মাথা কেটে ফেলা রাজার শরীরে ওপর। শুনতে পেলেন লোকগুলো নিজেদের ভেতর বলাবলি করছে, এবার নিশ্চয়ই প্রভু আমাদের ওপর সন্তুষ্ট হবেন। চলো, যাওয়া যাক। রানি দেখলেন, লোকগুলো এগিয়ে চলল সেই পোড়ো প্রাসাদের দিকে।
অন্ধকার নেমে আসে চারদিক ঢেকে দিয়ে। হাওয়া কাঁপতে থাকে নদীর ওপর। ফিকে আলো ছড়িয়ে চাঁদ ওঠে আকাশে। তারপর মূঢ় হয়ে বসে রইলেন রানি রাজার মুণ্ডহীন ধরের পাশে। তার এখন ভয় করছে না। কান্না পাচ্ছে। ঢেউয়ের মতো লাফিয়ে-লাফিয়ে কান্না উঠে আসছে বুকের ভেতর থেকে।
ছটফটিয়ে উঠলেন রানি। আর কেঁপে-কেঁপে উঠলেন। বিছনায় উঠে বসলেন। ঘরের একধারে পিলসুজে জ্বলছে প্রদীপ। হালকা আলো ছড়িয়ে আছে ঘরটাতে। তেষ্টায় অসাড় হয়ে গেছে জিভ। তবু দাসীকে ডাকতে পারলেন না তিনি। তার আগেই দেখলেন, পালঙ্কে তিনি একা। রাজার শয্যা শূন্য। গেলেন কোথায় তিনি? ভাবনার মাকড়শা জাল বুনতে থাকে রানির মধ্যে। দুঃশ্চিন্তা আর আতঙ্কে কিছুই তিনি বুঝে উঠতে পারলেন না। কাঁপতে কাঁপতে নেমে এলেন পালঙ্ক থেকে। ভাঙা-ভাঙা স্বরে ডাকলেন, বিমলা-বিমলা।
ছুটে এলো বিমলা, ডাকছেন রানিমা?
একই রকম ভাঙা-ভাঙা স্বরে তিনি বললেন, খাবার জল দে একটু।
চমকে ওঠে বিমলা। দুহাতে রানিকে ধরে সে বলল, রানিমার কী শরীর খারাপ?
বিমলার হাত ছাড়িয়ে দিয়ে রানি বললেন, জল দে বিমলা।
বিমলা এক ঘটি জল এনে দিলে কয়েক ঢোক খেলেন রানি। তারপর হাঁপাতে লাগলেন। তার হাত থেকে ঘটি নিতে নিতে বিমলা বলল, রাজামশাইকে খবর দিই রানিমা?
রানি জিগেশ করলেন, কোথায় তিনি?
বিমলা বলল, ঠাকুরঘরের দিকে যেতে দেখেছি।
পাষাণভার নেমে গেল যেন রানির বুকের ওপর থেকে। স্বস্তির একটা নিশ্বাস ফেলে তিনি বললেন, থাক বিমলা, তোকে আর যেতে হবে না। আমিই যাচ্ছি।
ঠাকুরঘরের দরজায় এসে দাঁড়িয়ে রানি দেখতে পেলেন, হতবিহ্বল হয়ে ঠাকুরের সামনে বসে আছেন রাজা। চোখমুখে আশ্চর্য এক ঝিলিক। যেন এই পৃথিবীতে তিনি নেই। বিড়বিড় করে কী যেন বলে যাচ্ছেন। রানি ডাকলেন, রাজামশাই।
মুখ ফেরালেন রাজা। সারা মুখে আনন্দের রঙ ঝিলমিল করছে তার। অস্ফুট আর কাঁপা-কাঁপা স্বরে তিনি বললেন, রানি, আমাদের সন্তান হবে। আমাদের উত্তরাধিকার জন্ম নেবে রানি।
হকচকিয়ে গেলেন রানি। কিছু সময় কোনও কথাই বলতে পারলেন না। তার মনের অবস্থা বুঝতে পেরেই হয়তো রাজা বললেন, হ্যাঁ রানি, ঠাকুর এতদিনে আমাদের আর্তনাদ শুনেছেন। আমাদের দীনতা বুঝতে পেরেছেন। আমাদের প্রাসাদ আলো করে এবার শারদশশীর উদয় হবে। এসো রানি, ঠাকুরকে প্রণাম করো।
রানি ঘরে ঢুকে ঠাকুরকে প্রণাম করলেন। তারপর মাথা তুলে বললেন, কিন্তু আপনি কীভাবে জানলেন এসব কথা?
রাজা বললেন, ঘুমের মধ্যে আমি আশ্চর্য এক স্বপ্ন দেখলাম। এক সন্যাসী আমাকে বলছেন, ঠাকুরের পেছনে একটি ফুল পাবি। ফুলটি আসলে গর্ভকুসুম। তার গন্ধ নিলে রানি গর্ভবতী হবে। তবে মনে রাখবি, রানি গর্ভবতী হয়ে গেলে গর্ভকুসুমটি ফেলে দিতে হবে। এই বলে মিলিয়ে গেলেন সন্যাসী। ঘুম ভেঙে গেল আমার। ভাবলাম, সন্যাসীর কথা মিথ্যে তো হবার নয়। তারপর ঠাকুরঘরে এলাম। তুমি দেখো রানি ঠাকুরের পেছনে সত্যিই একটা আশ্চর্য ফুল। ঠাকুর যে এভাবে আমাদের কৃপা করবেন, কে ভেবেছিল... কথা বলতে বলতে ঝরঝর করে কেঁদে ফেললেন রাজা।
রানি উঁকি দিলেন ঠাকুরের পেছনে। এবং স্তম্ভিত হয়ে গেলেন। এ তো সেই ফুল যা তিনি দেখেছিলেন স্বপ্নে। মুখে যেন কোনও ভাষা নেই, অবাক চোখে কেবল চেয়ে রইলেন ফুলটার দিকে। রাজা এসে দাঁড়ালেন রানির পেছনে। বললেন, দেখেছো রানি, আমার স্বপ্ন মিথ্যে হয়নি।
বিস্ময়ের ঘোর তখনও কাটেনি রানির। রাজার মুখের দিকে চেয়ে বললেন, একটু আগে স্বপ্নে আমি তো এই ফুলটাই দেখেছি। হ্যাঁ, এই তো সেই ফুল। কণ্ঠস্বর কেঁপে উঠল রানির।
রাজা অবাক হলেন। বললেন, তোমাকেও তবে স্বপ্নে দেখিয়েছে?
হ্যাঁ, দুঃস্বপ্ন। রানির স্বর থমথমে।
রাজা জিগেশ করলেন, কী রকম?
অন্যদিকে মুখ ঘুরিয়ে নিলেন রানি, থাক। আমি আর ভাবতে চাই না সে কথা। আমার বুক কেঁপে ওঠে।
রাজা বললেন, তবে থাক। আমাদের জীবনে সুস্বপ্নের জয় হোক। এসো, তুলে নাও গর্ভকুসুম। গন্ধ নাও রানি। ঠাকুরের সামনেই তোমার গর্ভসঞ্চার হোক।
রানি তুলে নিলেন গর্ভকুসুম। থরো থরো কাঁপছে তার হাত। কী এক আবেগে তিনি আপ্লুত। গন্ধ নিলেন তিনি গর্ভকুসুমের। মুহূর্তে শরীরের ভেতর কী যেন ঘটে গেল তার। মনে হলো, শিরশির ঢেউয়ের একটা কাঁপুনি বয়ে গেল রক্তের মধ্যে। ঝিমঝিম করে উঠল মাথাটা। হালকা মিষ্টি এক রকম গন্ধ মোহিত করে ফেলল তাকে। স্বপ্নে কি এরকম গন্ধই তিনি পেয়েছিলেন? মনে করতে পারলেন না। তবে মনে হলো, দেহের ভেতর কিছু একটা ঘটে চলেছে। নতুন কিছু, যা তিনি এই জীবনে আর কখনও টের পাননি। রাজার উদ্বেগ মেশানো স্বর শুনতে  পেলেন, কী হলো রানি, শরীর অসুস্থ লাগছে? কথার জবাব না দিয়ে রাজার মুখের দিকে চেয়ে তিনি হাসলেন। লাজুক ভঙ্গির হাসি।
ভয়ংকর স্বপ্নের কোনও ছাপ আর রইল না তার মনে।
চলবে...